থাইল্যান্ডের নির্বাচনের ফলাফল সামরিক বাহিনী ও রাজতন্ত্রকে যে বার্তা দিয়েছে
থাইল্যান্ডের সামরিক-বাহিনী সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী প্রাউত চান-ওচার বিরুদ্ধে বিস্ময়কর রাজনৈতিক পুনরুত্থান হয়েছে দেশটির গণতন্ত্রকামী দলগুলোর। খবর ব্লুমবার্গের
সাধারণ নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলে- একক দল হিসেবে সর্বোচ্চ ১৫১টি আসন পেয়ে রীতিমতো চমকে দিয়েছে মুভ ফরোওয়ার্ড পার্টি (এমএফপি)। 'সংস্কারপন্থী দল' হিসেবে খ্যাতি লাভ করা এই দলের নেতৃত্বে রয়েছেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র পিটা লিমজারোয়েনরাত।
ধারণা করা হচ্ছে, এমএফপি প্রতিনিধি পরিষদের ৫০০ আসনের মধ্যে ২৮৬ আসনে জয়লাভ করবে।
গণতন্ত্রকামী অপর দল ফিউ থাইয়ের সঙ্গে জোট করে এমএফপি সরকার গঠন করতে পারে।
সে যাই হোক, থাইল্যান্ডের পরবর্তী সরকার প্রধানের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জই অপেক্ষা করছে। এরমধ্যে অন্যতম হলো – ৫০৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিকে সঠিকভাবে পরিচালনার ভার। থাইল্যান্ডের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হলো চীন। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সম্পর্ক অবনতির দিকে। এই বাস্তবতার ভেতরেই ওয়াশিংটন ও আসিয়ান জোটের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হবে নতুন প্রধানমন্ত্রীকে।
তার সিদ্ধান্তের ওপর আরো নির্ভর করবে এশিয়ার অন্যতম বাজে পারফর্ম করা থাই পুঁজিবাজারের ভাগ্য। অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখা পর্যটন খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার গুরুদায়িত্বও হবে নতুন প্রধানমন্ত্রীর।
এপর্যন্ত জানা যাচ্ছে, সংস্কারপন্থী এমএফপি ও পিউ থাই ৫০০ সদস্যের পার্লামেন্টের ৫৮ শতাংশ আসনে জয়ী হতে চলেছে। ফলে গণতান্ত্রিক শিবিরের হাতেই থাকবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের সুযোগ। এক্ষেত্রে অবশ্য পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের পাশাপাশি, ২৫০ সদস্যের উচ্চ কক্ষ সিনেটের অনুমোদনও প্রয়োজন হবে।
সিনেটে আছে সামরিক বাহিনী সমর্থিত আইনপ্রণেতাদের আধিপত্য। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনেও তারা এভাবে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাবে। থাই রাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জোট সরকার গঠনের আগে আগামী কয়েক সপ্তাহ বা মাসব্যাপী এনিয়ে নেপথ্য আলোচনা চলবে উভয় পক্ষের।
নির্বাচনের ফলাফল থাইল্যান্ডের জন্য কোন ধরনের ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত দিচ্ছে?
সামরিক জান্তা দাবি করে এসেছে, তাদের শাসনকালে তুলনামূলক স্থিতিশীল ছিল থাই রাজনীতি। মুভ ফরোওয়ার্ড পার্টির বিশাল জয় এই দাবিকে অসার প্রমাণ করছে। কারণ, সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকারের আমলেই দেশটি তরুণদের ব্যাপক বিক্ষোভ যেমন প্রত্যক্ষ করেছে, তেমনি অর্থনীতিরও অবনতি হয়েছে।
থাইল্যান্ডের রাজা বা রাজ পরিবারের সদস্যদের অবমাননা করলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম কঠোর এ আইনের আওতায় সর্বোচ্চ ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। এমএফপি ইতঃপূর্বে এ আইনে সংস্কার আনার অঙ্গীকার করে। তাদের জয় সংস্কারের পক্ষে জনগণের বড় অংশের সমর্থনকেই তুলে ধরেছে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাসিত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী থাকসিন সিনাওয়াত্রা সমর্থিত ফিউ থাই এর জন্যও এমএফপির জয় একপ্রকার নিরাশাজনক। থাকসিনের কন্যা পায়েতংত্রাং দলটির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী।
থাকসিনের বড় সমর্থন আছে গ্রামীণ এলাকায়। ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি কৃষক-বান্ধব নীতি নিয়েছিলেন। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবার উদ্যোগও ছিল। তাই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি, নির্বাসিত থাকলেও তার পক্ষে গ্রামীণ জনসমর্থন ভালোই ছিল। কিন্তু, ভোটের ফলাফলে এমএফপির এগিয়ে যাওয়া প্রমাণ করছে জনপ্রিয়তার প্রতিফলন ব্যালটে সেভাবে পড়েনি।
তাছাড়া, এই প্রথমবারের মতো থাকসিন সমর্থিত নয় এমন একটি দল পার্লামেন্টের নিম্ন-কক্ষে বেশি আসন পেয়েছে। অর্থাৎ, জনতার কাছে থাকসিনের আবেদন কমছে- এমনটাই প্রতিভাত হয়।
এরপর যা হতে পারে
ইতিহাস বলে, থাই রাজনীতিতে অনেক বাঁক-বদল ও চমক আগামীতেও থাকতে পারে।
যদিও আজ সোমবার (১৫ মে) এমএফপি ও ফিউ থাই- এর শীর্ষ নেতারা বলেছেন, পিটার নেতৃত্বে একটি জোট সরকার গঠনের বিষয়ে তাদের মধ্যে ঐক্যমত্য হয়েছে। জোট সরকারে আরো চারটি দলও থাকবে।
রাজ অবমাননা আইনের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনাতেও আগ্রহী ফিউ থাই।
তবে কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, পিটা লিমজারোয়েনরাত এর প্রধানমন্ত্রীর পদলাভে বাধা দেবে সিনেট। ফলে অন্য মিত্রদের সাথে জোট করে সরকার গঠনের সুযোগ পাবে ফিউ থাই। দলটি রক্ষণশীল মধ্যপন্থী রাজনৈতিক শক্তির সাথেও হাত মেলাতে পারে। আবার গাঁজা বৈধ করার পক্ষে থাকা ভূমজয়থাই দলের সাথেও সমঝোতা করতে পারে।
আশার কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী প্রাউত চান-ওচা বলেছেন, তিনি নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিয়েছেন। যদিও এই ভোটযুদ্ধে তার দল পেয়েছে মাত্র ৩৬ আসন।
আর কে হতে পারেন প্রধানমন্ত্রী?
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক চাত্র ৪২ বছরের পিটা যদি পার্লামেন্টের অনুমোদন লাভে ব্যর্থ হন, তাহলে ফিউ থাই দলের প্রার্থী পায়েতংত্রাং (৩৬) এবং সাবেক রিয়েল এস্টেট মোগল স্রেত্থা থাভিসিনের (৬০) জন্য সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এছাড়া, সামরিক অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রাউতের মতো রক্ষণশীল নেতাকেই সমর্থন দিতে পারে সিনেট। নির্বাচনী ফলাফলে তৃতীয় স্থানে থাকা ভূমজয়থাই দলের প্রধান আনুতিন চার্নভিরাকুলের ভাগ্যেও শিকে ছিঁড়তে পারে।