মশলার বাড়তি দামে এবার উৎসবের মুখরোচক খাবারের খরচও বাড়াবে
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মশলার পাশাপাশি ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এবার আমদানি করা মশলার দামও চড়া। যা আসন্ন কোরবানির ঈদে নানা পদের মুখরোচক রান্নার আয়োজনের ব্যয় বাড়িয়ে দিবে বেশ খানিকটা।
ঢাকার পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, জিরার বাজারে সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা চলছে। দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। পাইকারী বাজারে যে জিরা ২০০-৩০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হতো সেটাই এখন ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা খুচরা বাজারে গিয়ে হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
জানা যায়, রপ্তানিকারক দেশ ভারতে এবার জিরার উৎপাদন কম হয়েছে, ফলে সেখানে দাম বেড়েছে। এ কারণে দেশটি থেকে জিরা আমদানি কমে গেছে।
নিজেদের চাহিদা মেটাতে ভারত রপ্তানির বদলে উল্টো তুরষ্ক, আফগানিস্তান, সিরিয়া থেকে আমদানি করছে। যে কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম বেড়েছে এবং এর প্রভাবে বাংলাদেশেও রেকর্ড দামে মশলাটি বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, ডলার সংকট, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও বিভিন্ন দেশ থেকে তৈরি হওয়া রপ্তানি জটিলতার কারণে আমদানি করা মশলা পণ্যের দাম বেড়েছে এবং সরবরাহও কমেছে। অন্যদিকে দাম বেশি হওয়ার কারণে স্থানীয় বাজারেও চাহিদা অনেকটা কমে গেছে।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দারুচিনি ১৬.৪৭ শতাংশ, লবঙ্গ ৩৮ শতাংশ, ধনে ৬৩ শতাংশ, আমদানি করা আদা ২৪১ শতাংশ, দেশি আদা ২১৯ শতাংশ, দেশি রসুন ১০০ শতাংশ, দেশি পেঁয়াজ ৮১ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
মৌলভীবাজারের মসলার পাইকারি ব্যবসায়ী মো. রুবেল টিবিএসকে বলেন, 'কিছু মশলার দাম বেশি। এখানে আমদানি জটিলতা, ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব রয়েছে। কিন্তু কোরবানির ঈদের আগে যে বিক্রি হওয়ার কথা সেটা এবারে নেই। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বিক্রির পরিমাণ অন্তত ৪০ শতাংশ কম হচ্ছে।'
বগুড়া মশলা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য বলছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ টন মশলার চাহিদা রয়েছে, যেখানে ৫০ প্রকারের মশলা ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ৪৯ লাখ টনের কিছু বেশি মশলা দেশে উৎপাদিত হয়েছে। বাকিটা আমদানির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে মশলার বাজার এখন প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার।
মশলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার টিবিএসকে বলেন, 'চাহিদার প্রায় 80 ভাগ মশলাই এখন দেশে উৎপাদন হয়। তবে আদা, রসুন, পেঁয়াজ, কাচঁমরিচের উৎপাদন থাকলেও এসব পণ্যের একটা অংশ আমদানির উপর নির্ভরশীল। যেমন আদার চাহিদা থেকে উৎপাদন ৫০ শতাংশেরও কম। এই জায়গাগুলোতে আমরা কাজ করছি।'
এলাচের দাম অবশ্য সবসময়ই বেশি থাকে। উৎসব কেন্দ্রিকও খানিকটা বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এলাচের আমদানির বেশিরভাগই হয় গুয়াতেমালা থেকে। একটা অংশ আসে ভারত থেকে। দাম বেশি হওয়ার কারণে বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় পুরোপুরি আমদানি হচ্ছে গুয়াতেমালা থেকে।
সাধারণ মানের এলাচ পাইকারী বাজারে দেড়-দুইশ টাকা বেড়ে এখন ১৩০০-১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যেটা খুচরা বাজারে গিয়ে ২৫০০-৩০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কয়েকমাস ধরে বড় জটিলতা তৈরি হয়েছে আদা নিয়ে। চীন, ভারত, মায়ানমার থেকে আদা আমদানি হলেও বেশিরভাগটাই আসত চীন থেকে।
ব্যবসায়ীরা জানান, দাম বেশি হওয়ার কারণে প্রায় দুই মাস ধরে চীন থেকে আদা আমদানি বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। যে কারণে দেশি আদার উপরই নির্ভরতা বেড়েছে, আমদানির বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে মিয়ানমার থেকে। কিন্তু আদা স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা কেজি দরে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সারাবছর ৪.৫ লাখ টন আদার চাহিদা থাকে। যেখানে প্রায় দুই লাখ টনের মত আদা দেশে উৎপাদন হয় এবং বাকিটা আমদানি করতে হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনের তথ্যে আমদানি পরিস্থিতির হিসেবে দেখা যায়, দেশে আদার সরবরাহ সংকট রয়েছে। ১১ মাসে চাহিদার চেয়ে ৭৭ হাজার মেট্রিক টন আদার সরবরাহ কম রয়েছে। এর কারণগুলোর মধ্যে ডলার সংকটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপকহারে মূল্যবৃদ্ধির ভুমিকা রয়েছে।
চলতি মাসের ৮ তারিখের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭২ শতাংশ বেশি দামে আন্তর্জাতিক বাজারে আদা বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহকারীদের মধ্যে অন্যতম দেশ চীন রপ্তানি সীমিত করার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এবারে চীন থেকে আদার আমদানি বন্ধ থাকার কারণে নতুন সোর্সিং কান্ট্রি হিসেবে আমদানি বাড়ছে মিয়ানমার থেকে। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে দেশটি থেকে ৮০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি আদা আমদানি হয়েছে। প্রতি মাসেই এই আমদানির পরিমাণ বাড়ছে। যার পুরোটাই আসছে টেকনাফ বন্দর দিয়ে।
এদিকে ব্যবসায়ীরাও বলছেন, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় মশলাগুলো কয়েকমাস ধরেই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে অস্থিরতা রয়েছে পেঁয়াজের দামে। প্রায় মাসখানেক আগে পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা পেরিয়ে গেলে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু আমদানি শুরু হলেও এই দাম খুব একটা কমেনি।
দেশি পেঁয়াজ এখনো ৮০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজের খরচ ৩০ টাকার আশপাশে থাকলেও সেটা বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে।
খাবারের স্বাদ ও গন্ধে পরিবর্তন আনতে রান্নায় ব্যবহার করা হয় দারুচিনি। চীন ভিয়েতনাম থেকেই বেশি আসে এই পণ্যটি। এবার এই পণ্যের দামও চড়া।
টিসিবির তথ্য বলছে, বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি দারুচিনিতে ১০০ টাকা বেড়ে তা ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।