পেপারফ্লাই-এর উড়াল শেষ
ব্যবসার পরিবেশে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোকে থার্ড পার্টি লজিস্টিকস (টিপিএল) সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান- পেপারফ্লাই গত সপ্তাহে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করেছে। এমনটা না ঘটলে, প্রতিষ্ঠানটি হতে পারতো দেশজুড়ে গ্রাহকের দ্বারপ্রান্তে সেবা পৌঁছে দেওয়ার এক অগ্রদূত।
আকস্মিক এ ঘটনায় প্রায় ১,০০০ কর্মী বেকার হয়েছেন।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের থেকে প্রতিশ্রুত তহবিল না পাওয়া, এবং ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান- সিভিসি ফাইন্যান্সের কাছে তাদের তহবিল আটকে থাকার ঘটনাকে এজন্য দায়ী করেছে কোম্পানিটি।
কিন্তু, দুঃখজনক এ পরিণতির আরও অনেক কারণ আছে। পেপারফ্লাই- এর পতনের নেপথ্য দৃশ্যপট জানার চেষ্টা করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনাকাঙ্ক্ষিত বেশকিছু ঘটনার এক চক্রই রয়েছে এ পতনের মূলে।
কোম্পানিটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানায়, 'বোর্ডের সাথে আলোচনার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে' প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ই-ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এম শাহাব উদ্দিন বলেন, 'তহবিল সংকটে পেপারফ্লাই যদি কার্যক্রম চালাতে না পারে, তাহলে দেশে এ শিল্পের জন্য সেটি হৃদয়বিদারক ঘটনা হবে। দেশের ই-কমার্স ইকোসিস্টেমের অপরিহার্য চাহিদা– লাস্ট মাইল ডেলিভারি (গ্রাহকের দ্বারপ্রান্তে পণ্য সরবরাহের সেবা)। পেপারফ্লাই এর মতো প্রতিষ্ঠান যা জোরালো করতে অবদান রেখেছে।' প্রতিষ্ঠানটি 'কমপ্ল্যায়েন্ট ভাবেই' বিকশিত হচ্ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
উত্থান ও পতন
২০১৬ সালে স্থানীয় চার উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠা করেন পেপারফ্লাই। ২০২১ সালে ভারতের টিপিএল ব্যবসার জায়ান্ট ইকম এক্সপ্রেস থেকে ১০০ কোটি টাকা শেয়ার বিনিয়োগ পাওয়ার পরে পেপারফ্লাই গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ ও সংগ্রহ (পিকআপ সার্ভিস)- উভয় ধরনের সেবা প্রদানের মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে।
কুরিয়ার সার্ভিসকে স্মার্ট লজিস্টিকসে রূপান্তরের এই যাত্রায় ২০২২ সালের এপ্রিলে আরও ১০২ কোটি টাকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পায় তারা। কিন্তু, এরমধ্যে বৈশ্বিক বিনিয়োগের পরিবেশে ব্যাপক পরিবর্তন আসার পর– তা আর রক্ষা করা হয়নি।
এদিকে আসন্ন এই অর্থপ্রাপ্তির ওপর আস্থা রেখে পেপারফ্লাই ২০০-র বেশি সরবরাহ কেন্দ্র গড়ে তোলার মাধ্যমে তাদের পরিধি বিস্তার করে। নিয়োগ দেয় ২ হাজারের বেশি কর্মীকে। এক্ষেত্রে তারা উদ্যোক্তা-বিনিয়োগকারীদের সমর্থনপুষ্ট স্মার্ট লজিস্টিকস ফার্ম- রেডএক্সের সাথে ব্যাপক প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে।
দারাজ- এর মতো বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর সেবাদাতা রেডএক্স। বাজারের এই অংশ নিয়ে তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে পেপারফ্লাইকে।
মহামারিকালে যখন বিশ্বব্যাপী সুদহার কম ছিল, তহবিল পাওয়া ছিল সস্তা, তখন বিনিয়োগকারীরা যেকোনো মুল্যেই হোক নব-উদ্যোগগুলো যেন ব্যবসা সম্প্রসারণ করে- সেদিকে জোর দিয়েছিল। কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার ঘটনা এবং সুদহার নতুন উচ্চতা লাভ করায়– তারা এখন প্রযুক্তি-ভিত্তিক স্টার্টআপের ওপর বাজি ধরার বিষয়ে সর্তক হয়েছেন। পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সংরক্ষণবাদী মনোভাবই দেখা যাচ্ছে।
মহাখালীর এসকেএস টাওয়ারে ছিল পেপারফ্লাইয়ের প্রধান কার্যালয়। বিনিয়োগ প্রবাহে এই মন্দ অবস্থায় চলতি বছরের শুরুতে এই অফিস তারা সরিয়ে নেয় নিকটবর্তী তাদের একটি ওয়্যারহাউজে। এভাবে খরচ কিছুটা কমলেও, তখনও তাদের প্রায় এক হাজার কর্মী ছিল, যাদের পেছনে প্রতিষ্ঠানের মাসিক ব্যয় হচ্ছিল ৭০ লাখ টাকা।
পেপারফ্লাই এর ৮০ শতাংশের মালিকানা রয়েছে ইকম এক্সপ্রেসের কাছে। ইকমের অভ্যন্তরীণরা জানান, ১০ কোটি টাকায় এই মালিকানা বিক্রির চেষ্টা করা হচ্ছিল।
এবিষয়ে মন্তব্য চেয়ে ইকম এক্সপ্রেসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা টিএ কৃষ্ণান এবং চিফ প্রসেস অফিসার প্রশান্ত গাজিপুরের সাথে যোগাযোগ করে টিবিএস, কিন্তু তারা এতে সাড়া দেননি।
সিভিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মামুনুর রশিদ মোল্লা টিবিএসকে জানান, তার ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পেপারফ্লাই ১১ কোটি টাকার আমানত রেখেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্ততায় মাসিকভাবে এই আমানতের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা হয়। এরমধ্যেই মোট আমানতের দুই-তৃতীয়াংশ দেওয়া হয়েছে।
সিভিসি ফাইন্যান্স এখন নিয়মিতভাবে মাসিক অর্থপ্রদান করছে বলেও যোগ করেন তিনি।
কিন্তু, এখানেই শেষ নয়। জালিয়াতির ঘটনায় বন্ধ হওয়া ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালি লজিস্টিক সেবার বিল বাবদ ৭ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করেনি। পেপারফ্লাই এই টাকা এখনও আদায় করতে পারেনি।
হিসাবের অতিরঞ্জন ও অতি-নির্ভরশীলতা
দেশে প্রযুক্তি খাতের একজন সুপরিচিত উদ্যোক্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর। তিনি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম আজকেরডিল, লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠান ডেলিভারি টাইগার এবং শীর্ষস্থানীয় চাকরির পোর্টাল বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা। তার মতে, মহামারিকালে বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারে ব্যাপক স্ফীতি ঘটে, এর অন্যতম কারণ ছিল- এসময়ে দেশজুড়ে ইভ্যালি, ধামাকা, ই-অরেঞ্জ এবং আলেশা মার্টের মতো পঞ্জিস্কিম ভিত্তিক প্লাটফর্মের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়া। ফলে ২০২২ সালে এসেই এ প্রবৃদ্ধি আর থাকেনি।
একইসময় লজিস্টিকস শিল্প, ই-কমার্স খাতের আরও শক্তিশালী অবস্থা অনুমান করে, প্রকৃত চাহিদার চেয়েও অন্তত পাঁচগুণ বেশি সরবরাহ সক্ষমতা বাড়ায়। বাড়তি এই সক্ষমতার কারণে এ শিল্পে মূল্য কমানোর যুদ্ধ শুরু হয় বলেও জানান মাশরুর।
'বিদেশি অর্থায়নপুষ্ট লজিস্টিকস ফার্মগুলো সেবাপ্রদানের মূল্য ব্যাপকভাবে কমিয়ে বাজার দখলের খেলায় নামে; এই ধরণের আগ্রাসী মূল হ্রাসের সাথে টিকতে না পেরে তাদের অনেক প্রতিযোগীই কোণঠাসা হয়ে পড়ে'- যোগ করেন তিনি।
এই প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে কিছুটা সংরক্ষণমূলক অবস্থান ছিল পাঠাও ও স্টিডফাস্টের মতো লজিস্টিকস কোম্পানির। তারা রাজধানীর বাইরে পণ্য সরবরাহে ১২০-১৪০ টাকা চার্জ করতো, কিন্তু দারাজের মতো গ্রাহক ধরার লক্ষ্যে তাদের আগ্রাসী প্রতিযোগী পেপারফ্লাই ও রেডএক্স এর মতোন প্রতিষ্ঠান ডেলিভারি চার্জ ৭৫-৮০ টাকায় নামিয়ে আনে বলেও জানান তিনি।
এদিকে দারাজের নিজস্ব লজিস্টিকস বহরও বিশাল। তাদের রয়েছে হাজারেরও বেশি ভ্যান; এবং দিনে ৮০ থেকে এক লাখ ২০ হাজার অর্ডার ডেলিভারির সক্ষমতা। ফলে তাদের দর কষাকষির সক্ষমতাও অনেক বেশি। দারাজের ওপর অতি-নির্ভরশীলতা পেপারফ্লাইয়ের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়– যখন চলতি বছরের শুরুতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আমদানি বিধিনিষেধের ফলে ই-কমার্স খাতের শীর্ষ এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাই মন্থর হয়ে পড়ে।
এছাড়া, গত বছরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর, পণ্য ডেলিভারির খরচও বাড়ে। কিন্তু, লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠানগুলো সে অনুযায়ী চার্জ বাড়াতে পারেনি, ফলে তাদের হাতে নগদ অর্থ কমতে থাকে বলেও জানান মাশরুর।
পেপারফ্লাই এর কুরিয়ার ও কার্গো শাখার সাবেক প্রধান আহসানুল হক মো. শামীম বলেন, 'এটা প্রোডাক্ট-মার্কেট ফিট (সঠিক বাজারে সঠিক পণ্য সরবরাহের) সমস্যাও ছিল। ফলে বাজারে টেকসই প্রভাব বিস্তার করতে না পারার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও উচ্চকাঙ্খী প্রতিষ্ঠানটি এজন্য চড়া মূল্য দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পণ্যের পরিমাণ বেশি না থাকায় গ্রামীণ এলাকায় গ্রাহকের দ্বারে দ্বারে পণ্য পৌঁছানো আর্থিকভাবে লাভজনকও ছিল না।
এদিকে দেশের কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর নির্দিষ্ট কিছু পণ্য সরবরাহের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে। অথচ তাদের সাথে তাড়াহুড়ো করে প্রতিযোগিতায় নামে স্মার্ট লজিস্টিকস শিল্প। তাই মাঠ পর্যায়ে অব্যবস্থাপনার ফলে তাদের কাছে অনেক পণ্য নষ্ট হয়েছে। এজন্য তাদের ক্ষতিপূরণও দিতে হয়েছে ক্লায়েন্টদের'- বলছিলেন আহসানুল।
ই-ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহাব উদ্দিন বলেন, আগ্রাসী এসব প্রতিষ্ঠান ও তাদের বিনিয়োগকারীদের মিলিত প্রচেষ্টা হয়তো সফলই হতো, কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই পিছু হটেছেন বিনিয়োগকারীরা।
তবে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের বাজার নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ই-ক্যাবের এই নেতা। বর্তমানে এই বাজারে দৈনিক অর্ডারের সংখ্যা আড়াই থেকে চার লাখ পর্যন্ত।
অবশ্য প্রতিবেশী ভারতের তুলনায় তা খুবই কম। ২০২২ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে ভারতে দিনে এক কোটির বেশি অর্ডার ডেলিভারি করা হয়েছে।