দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে চট্টগ্রামের ১০টি আসনে অস্বস্তিতে আওয়ামী লীগ-জাপা
বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ছাড় দেওয়ার কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে দুই আসনে জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ছাড় দিতে দলীয় প্রার্থীদের মনোয়ন প্রত্যাহার করেছে দলটি। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী মাঠে না থাকায় তাই খোশ মেজাজে থাকার কথা জাপার দুই প্রার্থীর। কিন্তু না, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেও মাঠে রয়েছে দলটির হেভিওয়েট স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা। আর এটিই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জাপার দুই প্রার্থীর জন্য।
শুধু যে জাপাই অস্বস্তিতে তা নয়, জেলার অন্য আসনগুলোতেও দলের হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে খোদ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরাও। চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে ১০টি আসনেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নৌকা-লাঙ্গলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
ছাড় পেয়েও অস্বস্তিতে জাপার দুই প্রার্থী
১৪ দলীয় জোটের শরিক জাপাকে এবারও চট্টগ্রাম–৫ (হাটহাজারী) ও চট্টগ্রাম–৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই দুই আসন থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছে দলটির নেতারা।
সাত মাসের সংসদ সদস্য চট্টগ্রাম–৮ আসনের নৌকা মনোনীত প্রার্থী নোমাল আল মাহমুদকে প্রত্যাহার করেছে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ আসনে জাপার সোলায়মান আলম শেঠকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান ও নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম। স্থানীয় আওয়ামী লীগ তাকে সমর্থন দেবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে সোলায়মান আলম শেঠ বলেন, 'জোটগত নির্বাচন না করলেও প্রধানমন্ত্রী এই আসনে জাতীয় পার্টিকে সম্মান করে দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করিয়েছেন। সে হিসেবে সুষ্ঠ ভোট হলে এই আসনে লাঙ্গল প্রতীক নির্বাচিত হবে।' তবে আবদুচ ছালাম স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করলেও মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ পদে থাকায় ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের প্রভাব নিয়ে চিন্তামুক্ত নন শেঠ।
চট্টগ্রাম–৫ আসনে ১৪ দল মনোনীত হয়েছেন জাপার কো–চেয়ারম্যান ও টানা দুইবারের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাথে সমন্বয় না থাকায় দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তাকে আসন ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে নারাজ ছিলেন। এ আসনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ সালাম। তাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মুহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী। স্থানীয় আওয়ামী লীগ তার পক্ষ নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে জাপার প্রার্থীর অস্বস্তির কারণ হতে পারেন শাহজাহান।
স্বস্তিতে নেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাও
একইভাবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া হেভিওয়েট প্রার্থীরাও এবার অস্বস্তিতে পড়ছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে।
চট্টগ্রাম–১ (মিরসরাই) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন এই আসনের সাতবারের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে মাহবুব উর রহমান রুহেল। তার বিপরীতে মাঠে আছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। তাকে শক্ত প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মিরসরাইয়ের রাজনীতিতে মোশাররফ বিরোধী শিবির গিয়াসের পক্ষে মাঠে নেমেছে। এই আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে মনে করছেন স্থানীয়রা।
চট্টগ্রাম–২ (ফটিকছড়ি) আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনি। এই আসনে আগের দুইবার ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে ছাড় দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এবার তার ভাতিজা বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদ মাইজভাণ্ডারীও আওয়ামী লীগের ছাড় আশা করেছিলেন। কিন্তু চাচা-ভাতিজা দুজনকেই নিরাশ করেছে আওয়ামী লীগ।
অবশ্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনির 'মাথা ব্যথা' হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা হোসাইন মুহাম্মদ আবু তৈয়বকে। স্থানীয় রাজনীতিতে তার প্রভাব থাকায় নৌকার প্রার্থী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
চট্টগ্রাম–১০ (খুলশী, পাহাড়তলী, হালিশহর) আওয়ামী লীগ প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মো. মহিউদ্দিন বাচ্চু মনোনয়ন পেলেও তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে সাবেক সিটি মেয়র এম. মনজুর আলমকে। এই আসনে আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী নগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ। তিনিও নৌকার প্রার্থীর জন্য কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম–১১ (পতেঙ্গা–বন্দর) থেকে টানা তিনবার নির্বাচিত ব্যবসায়ী এমএ লতিফকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছে। বিপরীতে শক্ত অবস্থান আছে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও স্থানীয় কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমনের। বন্দর ও চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ কেন্দ্রীক বিরোধ-দ্বন্দ্বের কারণে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রক দুই নেতা এমএ লতিফের বিরোধী অবস্থানে আছেন। এ কারণে জিয়াউল হক সুমনকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম–১২ (পটিয়া) আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। তার বিপরীতে আছেন থেকে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য (আওয়ামী লীগ) হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। স্থানীয় রাজনীতিতে তিনি প্রভাবশালী। তাকেও শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত।
চট্টগ্রাম–১৪ (চন্দনাইশ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন টানা দুইবারের সংসদ সদস্য মো. নজরুল ইসলামী চৌধুরী। তার বিপরীতে আছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার চৌধুরী। স্থানীয় রাজনীতিতে তাদের দুজনেরই প্রভাব রয়েছে। ফলে এই আসনেও নৌকার চ্যালেঞ্জ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী।
এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে চট্টগ্রাম–১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসন। এই আসনে নৌকার প্রার্থী হয়েছেন টানা দুইবারের সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী। তার বিপরীতে আছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শিল্পপতি আবদুল মোতালেব। গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় রাজনীতিতে তাদের দ্বন্দ্ব-বিরোধ প্রকাশ্যে। জামায়াত থেকে আসা নদভীকে ঠেকাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা কোমড় বেঁধে নেমেছেন। আসনটি নিয়ে শুরু থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছে।
চট্টগ্রাম–১৬ (বাঁশখালী) আসনে এবারও নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের টানা দুইবারের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। তার বিপরীতে আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শিল্পপতি মুজিবুর রহমান। এই অঞ্চলে তাদের দুজনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-বিরোধ দীর্ঘদিনের। এর আগেও মুজিবুর আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন।
অস্ত্র প্রদর্শন, মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাসহ নানা বিতর্কিত কমকাণ্ডের জন্য বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর সমালোচিত। এই আসনেও লড়াই জমবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।