অপারেশন সার্চলাইট: ১৯৭১ জেনোসাইডের সূচনা
১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ যে এখনও প্রাসঙ্গিক, সে কথা আমাদের সদাসর্বদা মনে রাখতে হবে। যতদিন না ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন পাক সামরিক বাহিনী এবং তাদের বিহারি ও বাঙালি দোসরদের দ্বারা সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় আমরা করতে পারব, ততদিন এই বিষয়ের কোনো গ্রহণযোগ্য সমাপ্তি হবে না।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এই স্বীকৃতি আদায় করতে পারলে:
১. পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বাধ্য হবে জেনোসাইডের অপরাধের জন্য সরকারিভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে। তাতে জেনোসাইড ভিকটিমদের ও পরিবারবর্গের ট্রমা কিঞ্চিৎ হলেও উপশম হবে। তাঁদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।
২.পাকিস্তান বাধ্য হবে তাদের দেশের যেসব জেনোসাইডাররা এখনও বেঁচে আছে, তাদের বিচারের মুখামুখি করতে। অন্তত সেই ১৯৫ জনের তালিকা দিয়ে কাজটি শুরু করা যায়। এই তালিকা বঙ্গবন্ধুর আমলেই তৈরি হয়। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন ১৯৭৩-এর আইসিটি আইনে এদের বিচার করতে। পরবর্তীতে আটকে পড়া বাংলাদেশের নাগরিকদের দেশে ফেরত আনার স্বার্থে এবং পাকিস্তান কর্তৃক তাদের দেশে নিয়ে এদের বিচার করার অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লী ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে সন্মত হয়ে ৯ হাজার ৩০০০ যুদ্ধবন্দি বিনিময়ের সাথে এদেরও পাকিস্তানে ফেরত দেয়া হয়। বলাবাহুল্য, পাকিস্তান তার প্রতিশ্রুতি রাখেনি।
৩. জেনোসাইডের ক্ষতিপূরণ দেওয়াও পাকিস্তানের ওপর বর্তায়।
৪. যুদ্ধপরবর্তী চুক্তি অনুযায়ী আমরা আমাদের সব ইচ্ছুক নাগরিকদের ফেরত এনেছি। তারা তা করেনি।আংশিক প্রত্যাবাসন করে সেই কাজ বন্ধ করেছে।এখনও বেঁচে থাকা তাদের সেসব নাগরিকদের তারা ফেরত নিক।
৫.১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের স্থিতি অনুযায়ী দেশের সম্পদের আনুপাতিক হিস্যা আমাদের বুঝিয়ে দিতে হবে।
এই সমাপ্তি উভয় দেশের জনগণের জন্যই প্রয়োজন। কেবল তাহলেই আমরা উভয় দেশ একসাথে ভবিষ্যতে কাজ করতে ও এগিয়ে যেতে পারব। শত্রুতা চিরস্থায়ী রাখা কোনো কাজের কথা নয়।
আজকাল পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মের এক ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে এইসব প্রশ্ন উঠেছে। তারা বুঝতে পারছে যে গত অর্ধশতাব্দী তাদের শাসকশ্রেণি তাদের কাছে সত্য আড়াল করেছে।
২০১৭ সালে আমাদের মহান সংসদে আইন পাশ করে ২৫ মার্চ তারিখকে বাংলাদেশ জেনোসাইড স্মরণ দিবস হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত হয়। এই দিনটি যথাযথ সম্মান ও গুরুত্বের সাথে পালন করা অতি প্রয়োজন।এই দিনেই জেনোসাইডে নিহত ও অত্যাচারিত সব মানুষ ও তাদের পরিবারবর্গকে আমরা যথাযোগ্য সম্মান দেখাতে ও জাতির মুক্তিতে তাঁদের আত্মত্যাগের জন্য কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, জেনোসাইড কেবল গণহত্যা নয়। এটা ১৯৪৮-এ জাতিসংঘ জেনোসাইড কনভেনশনে পাশ হওয়া একটি আন্তর্জাতিক ফৌজদারি অপরাধ। কোনো জনগোষ্ঠীকে (জাতীয়তাভিত্তিক, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, বর্ণ ভিত্তিক) আাংশিক বা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা বা তা বাস্তবায়নই জেনোসাইড। গণহত্যা, শারিরীক বা মানসিকভাবে আহত করা, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করা, নারী নির্যাতন, ধর্মান্তরিতকরণ, জাতিগত পরিচয় বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টা—এই সব অপরাধ দিয়েই জেনোসাইড কার্যকর করা হয়। এর প্রতিটি অপরাধ পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দোসররা আমাদের ওপর করেছে।
আমাদের জোর আওয়াজ তুলতে হবে ১৯৭১ জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য। স্বস্তির ব্যাপার, ইতোমধ্যেই জেনোসাইড নিয়ে কাজ করা চারটি আন্তর্জাতিক সংগঠন আমাদের এই স্বীকৃতি দিয়েছে।
আমাদের সিভিল সমাজ, প্রচারমাধ্যম, প্রগতিশীল নাগরিক ও রাজনৈতিক শক্তি, প্রবাসী দেশপ্রেমিক শক্তি, সর্বোপরি দেশের সরকারকে এই বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালীভাবে তুলে ধরতে হবে।
কষ্টকর পথ পাড়ি দিতে হবে। তবু সাফল্য আমাদের পেতেই হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার যে সুফল আমরা আজ ভোগ করছি,তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭১ জেনোসাইড ভিকটিমদের আত্মবলিদানের মাধ্যমে।
এই মহান দিনে সরকার দেশে একটি জেনোসাইড ডিনায়াল অ্যাক্ট (জেনোসাইড অস্বীকৃতির আইন) চালু করুক, সেটা আমাদের কাম্য। বহু উন্নত দেশে এ-জাতীয় আইন চালু আছে। এ-জাতীয় আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারিভাবে গৃহীত তথ্য-উপাত্তকে মেনে না নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হয়।
জেনোসাইড একটি ইংরেজি শব্দ, এমন কথা বলে এই শব্দটি ব্যবহার করতে অনেকের অনীহা আছে। তবে শব্দটি মোটেই ইংরেজি ভাষার নয়। ১৯৪৩ সালে জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ পোলিশ আইনজীবী রাফায়েল লেমকিন তাঁর Axis rule in Occupied Europe বইয়ে গ্রিক শব্দ জেনোস (জনগোষ্ঠী) ও রোমান শব্দ সেডেরো (নিশ্চিহ্ন করণ) এই দুই শব্দের সমাহারে জেনোসাইড শব্দ প্রথম ব্যবহার করেন। সমৃদ্ধ ভাষা ইংরেজি এই গুরুত্বপূর্ণ শব্দটি ঠিকই আত্মীকরণ করেছে।
পৃথিবীর অনেক ভাষাই জেনোসাইড শব্দ বিনাবাক্যব্যয়ে ব্যবহার করে আসছে। আমরা সবাই জানি যে বিভিন্ন বিদেশি ভাষার শব্দাবলি একটি ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও এর ব্যতিক্রম নয়। বহু ভাষার বহু শব্দ বহুদিন ধরেই বাংলায় ব্যবহার হয়ে আসছে। টেলিভিশন, টেলিফোন, চেয়ার, দলিল, দস্তাবেজ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারে আমাদের কোনোই অসুবিধা হয় না। সেক্ষেত্রে জেনোসাইড শব্দটিও একইভাবে আমরা ব্যবহার করতে পারি।
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।