জ্বলন্ত আমাজন কি মানুষের অদূরদর্শিতার সাক্ষ্য
‘আক্ষরিক অর্থেই আমাদের বাড়ি পুড়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর ফুসফুস আমাজনের বনে আগুন। এটি একটি আন্তর্জাতিক সংকট।”
গত ১৫ আগস্ট থেকে অগ্নিকাণ্ডে জ্বলতে থাকা আমাজন রক্ষার আহ্বান জানিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এক টুইটে এ কথা লেখেন।
বলা হয়ে থাকে, আমাজনের ভাগ্য আর এই পৃথিবীর ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা। একে বলা হয় ‘পৃথিবীর ফুসফুস’। কেননা, পৃথিবীর যতটুকু অক্সিজেন আছে তার ২০ শতাংশ আসে আমাজন বন থেকে। আবার প্রতিবছর ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে এই বন।
অথচ গত এক দশকে আমাজনে এমন ভয়াবহ আগুন লাগেনি। ভাবুন একবার। দিকে দিকে সে আগুনে ছড়িয়ে পড়ছে আর তাতে পুড়ে কয়লা হচ্ছে শতসহস্র বর্গমাইলের চিরহরিৎ বন। প্রাণ বাঁচাতে আগুনের মুখে ছুটছে অবলা সব প্রাণি। আশ্রয় খুঁজে না পেয়ে সেখানেই পুড়ে কয়লায় পরিণত হচ্ছে। যেন কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সে আগুন। সর্বশেষে ৪৪ হাজার সেনা সদস্য মোতায়েন করার পরেও এখনও সেখানে ১৬শ’র বেশি আগুন সক্রিয়। পুড়ে ছাই হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম এই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল। রয়টার্সের তথ্যমতে, এ বছর এ পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৭৮,৩৮৩ বার। যার প্রায় অর্ধেকই আগস্ট মাসের।
আমাজন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
প্রায় ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের আমাজন বন আকারে ইউরোপ মহাদেশের প্রায় অর্ধেক আর এটি বাংলাদেশের প্রায় ৩৮ গুণ। এটি ব্রাজিলের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেশির ভাগ এলাকা, কলম্বিয়া, পেরুসহ দক্ষিণ আমেরিকার নয়টি দেশে বিস্তৃত। তবে এই বনের সিংহভাগ (৬০%) পড়েছে ব্রাজিলে। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ আমাজনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রশস্ত নদী আমাজনসহ অনেকগুলো নদ-নদী।
এটি বিশ্বের একক বৃহত্তম ও সর্বাধিক প্রজাতিসমৃদ্ধ বন। এই বনে রয়েছে প্রায় ৩০ লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী। মাত্র ১ বর্গ কিমি এই রেইন ফরেস্টে ৯০,০০০ টনেরও বেশি জীবন্ত উদ্ভিদ থাকতে পারে। সর্বমোট ৩ মিলিয়ন উদ্ভিদ এবং প্রাণী প্রজাতি এবং প্রায় ১০ লাখ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বাস এখানে। বিশ্বের মোট মিঠা পানির প্রায় এক তৃতীয়াংশের জোগান দেয় এই বন। পৃথিবীর বাস্তুসংস্থার ১০% শতাংশ কার্বন ধারণ করে এই বন।
কিন্তু বাস্তবতা হল, প্রতি বছর বেলজিয়ামের আকারের সমপরিমাণ জায়গা এই চিরহরিৎ বন থেকে সাফ করে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। গত ৪০ বছরে আমাজনের শতকরা প্রায় ২০ ভাগ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ২০০৪ সালে আমাজনের ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার বন উজাড় হয়েছিল। আর ২০১৯ সালে এই বনাঞ্চলের ১৮৬২৭ বর্গ কিলোমিটারের মত জায়গা উজাড় হয়। প্রতিদিন, প্রতি মিনিটে ১৫০ একর এবং বছরে ৭৮ মিলিয়ন একর করে ধ্বংস হচ্ছে আমাজন।
এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে বনটির ৪০ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
আমাজনে অগ্নিকাণ্ডের কারণ
ব্রাজিলের ফেডেরাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের এক দল বলছেন, শুকনো মৌসুমে আমাজনের জঙ্গলে দাবানল একটা প্রচলিত ঘটনা। সেখানে শুকনো মৌসুমের সময়কাল জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। এই দাবানল তৈরি হতে পারে প্রাকৃতিক কারণে, যেমন বাজ পড়লে। কিন্তু কৃষক এবং কাঠুরেরাও ফসল উতপাদনের জন্য অথবা পশু চরানোর জন্য জমি পরিষ্কার করার কারণে জঙ্গলে আগুন দিয়ে থাকে।
তবে সমস্ত অগ্নিকাণ্ডকে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক হিসাবে দেখতে নারাজ স্থানীয় পরিবেশবিদরা।
সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের গবেষক ও জলবায়ু বিজ্ঞানী কার্লোস নোব্রে বলেন, গবাদি পশুর চারণভূমি হিসেবে জমি ব্যবহার করতে চাওয়া কৃষকরা জায়গা পরিষ্কার করতে শুকনো আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। এ সময় বন দাহ্য হয়ে থাকে এবং খুব সহজেই তাতে আগুন লাগে।
এদিকে খনিজ পদার্থের ভাণ্ডার হওয়ায় আমাজন অরণ্যে প্রতি মিনিটে একটি ফুটবল খেলার মাঠের সমান বনাঞ্চল জঙ্গল লাগাতার সাফ করে খনন কাজ চালানো হয়। ফলে গাছপালা কমে যাওয়ায় স্বল্প বৃষ্টিপাত ঘটে। এটিও আমাজনে আগুন লাগার কারণ হতে পারে।
আমাজনে মানবসৃষ্ট কারণ ছাড়াও বজ্রপাত, প্রচণ্ড গরমের সময় গাছের ডালে ডালে ঘর্ষণসহ নানা প্রাকৃতিক কারণও এসব অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী।
অগ্নিকাণ্ডের জন্য পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
অগ্নিকাণ্ডের প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি রাজনৈতিক কারণকেও দায়ী করছেন অনেকে। আমাজনে ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য ব্রাজিলের দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর নীতিকে দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হল, তিনি ক্ষমতায় এসে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই আমাজন অঞ্চলকে চাষ ও খনিজ উত্তোলনের কাজে ব্যবহারের ঘোষণা দেন। তাঁর এ উদ্যোগের ফলে বন উজাড় হয়ে যেতে পারে বলে আন্তর্জাতিক মহলের আশঙ্কা তিনি আমলেই নেননি। ফলে ব্রাজিলে অবস্থিত ৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার আমাজন বন হুমকির সম্মুখীন হয়। তার প্রমাণ মেলে আমাজন অববাহিকায় ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের জুলাই মাসের মধ্যে বন উজাড়ের হার ৫০ শতাংশ বেড়ে যাওয়া।
ওদিকে, সম্প্রতি ফাঁস হওয়া ব্রাজিল সরকারের একটি গোপন নথি থেকে জানা যায়, আমাজন অঞ্চলকে বহুপক্ষীয় সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে যে প্রকল্পের কথা ভাবা হচ্ছে, তা বাস্তবায়নের বিরোধী বলসোনারোর সরকার। গত জানুয়ারিতে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়া বলসোনারো এই প্রকল্প রুখতে কৌশলগতভাবে আমাজন এলাকা ‘দখল’ করতে চান বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে।
গত ২২ আগস্ট বলসোনারো আমাজনে আগুনের জন্য দায় চাপান বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) উপর। তাঁর ভাষায়, “সব কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে, এনজিওগুলোই আমাজনের বনে আগুন লাগাচ্ছে। কে এই আগুন লাগিয়েছে, আমি জানি না। কৃষক, এনজিও, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী— যে কেউ এই আগুন লাগিয়ে থাকতে পারে।”
তবে এর স্বপক্ষে তিনি জোরালো কোনো প্রমান দেখাতে পারেননি।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আমাজন বনাঞ্চলে চলতি বছরের রেকর্ড অগ্নিকাণ্ডকে ‘আন্তর্জাতিক সংকট’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বিষয়টি জি-৭ সম্মেলনের আলোচ্যসূচির শীর্ষে থাকা উচিত বলেও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের মন্তব্যের সমালোচনা করে বলসোনারো বিদেশি কোনো শক্তিকে এ ব্যাপারে নাক না গলানোর পরামর্শও দেন।
অপরদিকে, ব্রাজিলের কংগ্রেস সদস্য ও নিম্নকক্ষের পরিবেশবিষয়ক কক্ষের নেতা নিলতো তাত্তো বলেন, এনজিওগুলোর প্রতি বোলসোনারোর এ অভিযোগ ব্রাজিলের ৩০ বছরের পরিবেশ সুরক্ষা নীতিতে তাঁর প্রশাসনের ব্যর্থতা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা।
আমাজনের এমন দুরবস্থার পেছনে বোলসোনারোকে দোষারোপ করেছেন রক্ষণশীলেরাও। বোলসোনারো কাঠুরে ও কৃষকদের জমি সাফ করতে উৎসাহিত করছেন বলে বারবার বনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
গ্রিনপিসের মার্সিয়ো আস্ট্রিনি বনাঞ্চল উজাড় ও দাবানলকে প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর ‘পরিবেশবিরোধী’ নীতির ফলাফল বলে মন্তব্য করেছেন। সংগঠনটি অভিযোগ করেছে, বলসোনারোর সরকার স্থানীয় কৃষকদের আমাজনে আগুন দিতে উৎসাহ দিচ্ছে। এই উৎসাহের কারণেই প্রায় দু’ সপ্তাহ আগে শুরু হওয়া আমাজনের অগ্নিকাণ্ড এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক ও জলবায়ুবিজ্ঞানী কার্লোস নোব্রে বলেন, গবাদিপশুর চারণভূমি হিসেবে জমি ব্যবহার করতে চাওয়া কৃষকেরা জায়গা পরিষ্কার করতে শুকনো মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করেন। এ সময় বন দাহ্য হয়ে থাকে এবং খুব সহজেই তাতে আগুন লাগে।
তিনি আরও বলেন, আমাজনে কর্মরত এনজিওগুলো কৃষিকাজে আগুন ব্যবহার করে না। তারা বরং গ্রামীণ লোকজনকে আগুন এড়াতে উৎসাহিত করে।
অগ্নিকাণ্ডের অতীত রেকর্ড
ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ (ইনপে) জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে আমাজনে রেকর্ডসংখ্যক আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এ বছর ৮৫ শতাংশ বেশি আগুন লেগেছে।
স্যাটেলাইট ছবি গবেষণা করে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ স্পেস রিসার্চ (ইনপে) দেখতে পেয়েছে, গত জানুয়ারি মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত আমাজনের বনে ৭২,৮০০টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০১৩৬ বার।
২০১৩ সালে পুরো ব্রাজিলে যত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল (৩৫,৫৬৭ বার), চার মাস বাকি থাকতেই এ বছর তার চেয়ে বেশি আগুন লেগেছে। শুষ্ক মৌসুমে, বিশেষ করে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আমাজনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা একেবারেই ঘটে না তা নয়। তবে এবারের মতো এত ভয়াবহ আগুনে কখনও পোড়েনি এই বনাঞ্চল।
বারবার এমন অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে ব্রাজিলের উত্তরাংশের রাজ্যগুলো। বিশেষ করে উত্তরাংশের চারটি রাজ্যে গত চার বছরে আগুন লাগার হার বেড়েছে ব্যাপকভাবে। পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, আমাজনে লাগা আগুনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোরাইমা, একর, রন্ডোনিয়া ও আমাজোনাস— এই চারটি প্রদেশ। গত চার বছরে রোরাইমাতে ১৪১, একরে ১৩৮, রন্ডোনিয়ায় ১১৫ ও আমাজোনাসে ৮১ শতাংশ আগুন লাগার হার বেড়েছে। এ ছাড়া দক্ষিণের প্রদেশ মাতো গ্রোসো দো সালে আগুন লাগার হার বেড়েছে প্রায় ১১৪ শতাংশ। অগ্নিকাণ্ডের কারণে ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় প্রদেশ আমাজোনাসে এরই মধ্যে জরুরি অবস্থাও জারি করা হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের প্রভাব কী
‘কার্বন ছাঁকনি’ হিসেবে পরিচিত চিরসবুজের এই বনাঞ্চল দাবানলের পর কার্যক্ষমতা হারাবে সে বিষয়ে নিশ্চিত প্রায় সমস্ত গবেষক। বারবার এমন অগ্নিকাণ্ডের কারণে বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপরও। আগুনের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বনাঞ্চলে। শুধু আমাজনেই নয়, বনাঞ্চল ছাড়িয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে পড়েছে অন্য প্রদেশগুলোতেও।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ সংস্থা কোপারনিকাস অ্যাটমোসফিয়ার মনিটরিং সার্ভিসের (ক্যামস) তথ্যমতে, আমাজনের আগুনের কারণে তৈরি হওয়া ধোঁয়া সুদূর আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। এই বন থেকে প্রায় তিন হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরে সাও পাওলোর আকাশ ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা এ-ও বলছেন, এই আগুনের কারণে বায়ুমণ্ডলে যোগ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও কার্বন-মনোক্সাইড।
তবে আগুনের রুদ্রমূর্তি কেবল ব্রাজিল অংশের আমাজনে নয়, বরং লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোও দেখছে। ভেনেজুয়েলার আমাজনে এ বছর ২৬ হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। বলিভিয়া অংশে ১৭ হাজারেরও বেশিবার আগুন লেগেছে। কলম্বিয়াতেও আগুন লেগেছে ১৪ হাজারের বেশিবার। আগুনে গাছ ধ্বংসের কারণে বায়ুমণ্ডলে বাড়ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা। ধোঁয়ার কারণে বায়ুমণ্ডলে বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, শুধু আমাজনে লাগা আগুনের কারণে এ বছর এখন পর্যন্ত প্রায় ২২৮ মেগা টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়েছে। ২০১০ সালের পর কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের এ হার সর্বোচ্চ। শুধু কার্বন-ডাই-অক্সাইড নয়, বিপুলসংখ্যক গাছ পোড়ার কারণে বাতাসে বিষাক্ত কার্বন-মনোক্সাইড গ্যাসও নির্গত হচ্ছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে আমাজন। প্রতিবছর মিলিয়ন মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নেয় আমাজনের বিস্তৃত বনাঞ্চল। যখন এই গাছগুলো আগুনে পুড়ে যায়, তখন শোষণ করে রাখা কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে।
আমাজনের আগুনের ভয়াবহতার কারণেই এই বন রক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আবেদন জানানো হচ্ছে।
ব্রাজিলের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের চাপ
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আমাজনের অগ্নিকাণ্ডকে ‘আন্তর্জাতিক সংকট’ বলে অভিহিত করেছেন। বিশ্বনেতারা একে ‘তীব্র জরুরি অবস্থা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত বৃহস্পতিবার এক টুইটবার্তায় বলেছেন, “বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকটের সময় অক্সিজেন ও জীববৈচিত্র্যের একটি বৃহৎ উৎসের এর চেয়ে বেশি ক্ষতি আমরা করতে পারি না। আমাজনকে অবশ্যই সুরক্ষিত রাখতে হবে।”
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর সঙ্গে কথা বলে টুইট করেছেন, “আমি তাঁকে জানিয়েছি, বিশ্বের বৃহত্তম গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল আমাজনের আগুন নিয়ন্ত্রণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারে, আমরা সেই সহায়তার জন্য প্রস্তুত। ”
ফ্রান্স ও আয়ারল্যান্ড জানিয়েছে, আমাজনের অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্রাজিল যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে তারা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে বড় পরিসরে বাণিজ্য চুক্তি অনুমোদন করবে না। এর জবাবে বোলসোনারো সমালোচনা করে বলেন, নিষেধাজ্ঞার জন্য দাবানলকে ‘অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না’।
ফিনল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী ইইউকে ব্রাজিল থেকে গরুর মাংস আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেছেন। ফিনল্যান্ড বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কাউন্সিলের সভাপতি।
তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এসব সমালোচনার কড়া জবাব দিতেও ছাড়েননি বোলসোনারো। টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ভাষণে জোর দিয়ে বলেছেন, দেশটির বেশিরভাগ বনরক্ষার জন্য ‘আধুনিক আইন’ রয়েছে। মাখোঁর মতো নেতারা ‘রাজনৈতিক স্বার্থে’ আমাজনের আগুন নিয়ে নাক গলাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন বোলসোনারো।
এ অগ্নিকাণ্ডকে ভয়াবহের বদলে ‘মাঝারি ধরনের’ বলে অভিহিত করে তিনি বলেন, “উষ্ণ বছরগুলোতে দাবানল একটি সাধারণ ঘটনা।”
তবে আমাজনে বেসরকারি সংস্থাগুলো আগুন দিয়েছ, এমন অভিযোগের পর আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট। তাই শেষমেশ আন্তর্জাতিক মহলের প্রবল চাপ আর উপেক্ষা করতে পারেননি। আমাজনের আগুন নেভাতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করছে দেশটি। গত ২৩ আগস্ট এই সিদ্ধান্তের কথা জানান দেশটির প্রেসিডেন্ট । তিনি এক ফরমান জারি করে এ অঞ্চলে প্রকৃতি সংরক্ষণ, আদিবাসী জমি এবং সীমান্ত অঞ্চলে সেনা মোতায়েনের অনুমোদন দেন।
বোলসোনারো এক টেলিভিশন চ্যানেলে ভাষণে বলেন, “একজন সামরিক সদস্য হিসেবে আমি আমাজন বনভূমিকে ভালোবাসতে শিখেছি। আমাজনের সুরক্ষায় সহায়তা করতে চাই আমি। সেনা মোতায়েনের বিষয়টি আঞ্চলিক গভর্নরদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেনা মোতায়েনের বিষয়টি তদারকি করবেন। প্রয়োজনীয় সম্পদ বরাদ্দের দায়িত্বে থাকবেন।”
শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আমাজন রক্ষার ডাক আদিবাসীদের
আমাজনের মুরা সম্প্রদায়ের নেতারা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টকে এ অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী করছে। এই আমাজন জঙ্গলে প্রায় ১৮ হাজার মুরা জনগোষ্ঠীর লোকের বসবাস। মুরা ছাড়াও এখানে আরও ৪০০ প্রকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন আছে।
তাদের অভিযোগ, “প্রতিদিন অতিবাহিত হচ্ছে আর আমাদের আবাসভূমি পুড়ে ছাই হচ্ছে। ভূমি দখল, গাছ উজাড় করায় কাঠ ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেড়েই চলেছে। আমরা খুবই মর্মাহত। কারণ আমাদের বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমরা অনুভব করছি। এ সময় বিশ্বের জন্য বন খুবই প্রয়োজন।’
তাই তারা এবার নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এবার নিজেদের আবাসভূমি আমাজন রক্ষায় লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন তারা। মুরা জনগোষ্ঠীর নেতা রাইমুন্ডু প্রাইরা বেলাম বলেন, ‘তারা আমাদের বনাঞ্চল উজার করছে। ধ্বংস করছে আমাদের বাড়িঘর। তারা আমাদের শত্রু। আমরা আমাদের ভূমি ও আমাদের গাছ নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও রক্ষা করব।”
পৃথিবীর এই ফুসফুসের ধোঁয়ায় ভরে ওঠার দায়ভার কেউ এড়াতে পারে না। সেখানে বসবাসরত প্রাণি আর উদ্ভিদের অকালমৃত্যুর জন্য প্রকৃতির ওপর দ্বায় চাপিয়েও মানুষ এবার আর পার পাবে না। কারণ আমাজন না বাঁচলে পৃথিবীও বাঁচবে না।
বলা হচ্ছে, অগ্নিকাণ্ডের জন্য আমাজনের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে সময় লেগে যেতে পারে ২০০ বছর। দেখা যাক।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, দ্য ইকোনোমিস্ট, ফরেন পলিসি, স্ট্যাটিসটা, দ্য সিডনি মর্নিং হ্যারল্ড