পাকিস্তানের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প নিয়ে উত্তাপ বাড়ছে ভারত-চীন সম্পর্কে
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় চীনা কোম্পানিগুলো চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অংশীদার তারা, যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের লক্ষ্য অর্থনৈতিক উত্তরণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
প্রায় ৮ হাজার ৭শ' কোটি ডলারের এ প্রকল্পের আওতায় বানানো হচ্ছে; বন্দর, মহাসড়ক, সেতু, রেলপথ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। উদ্দেশ্য সিপিইসি'কে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা, প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মুখে থাকা ভূখণ্ডের উপর তাদের কর্তৃত্ব বাড়ানো।
চীনের বৃহৎ লক্ষ্য:
মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর হতে সুদূর জিনজিয়াং পর্যন্ত গেছে সিপিইসি'র সংযোগ সড়ক। তাছাড়া, পাকিস্তান জুড়ে প্রকল্প সংযোগ পথগুলোর চারপাশে গড়ে তোলা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও বাণিজ্যিক স্থাপনা।
মহামারির মধ্যে যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতা চরম পর্যায়ে; ঠিক তখনই পাকিস্তানে সিপিইসি বাস্তবায়নে আরও উদ্যমী হয়েছে চীন। বেইজিং- এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সমুদ্রপথে মার্কিন নৌবাহিনীর আধিপত্য ও তার মিত্রদের উপস্থিতির চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে, পাকিস্তান দিয়ে ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি আমদানি নিশ্চিত করা। এবং আফ্রিকা ও ইউরোপের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সিপিইসি হবে আগামীদিনের চালিকাশক্তি- এমন লক্ষ্য নিয়েই এগোচ্ছে চীন।
মহামারি সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনীতির দূরাবস্থার মধ্যেও, গত দুই মাসে সিপিইসি'তে বাড়তি ১১শ' কোটি ডলার খরচের ঘোষণা দেয় বেইজিং। অথচ অর্থনৈতিক করিডরটির অনেক প্রকল্প আছে ভারতের সাথে বিতর্কিত ভূখণ্ডের মধ্যে। ফলে হিমালয়ের উচ্চতায় চীন-ভারত সেনা সংঘাতের নেপথ্যে যে বাণিজ্যিক বিনিয়োগের বড় স্বার্থ রয়েছে-তা বলাই বাহুল্য। আর একারণেই উত্তেজনা আরও মারাত্মক পরিণতি জন্ম দেওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
আগেই বলা হয়েছে, সিপিইসি ঘিরে চীনের বড় কিছু অভিলাষ রয়েছে। বালুচিস্তান প্রদেশে আরব উপসাগরের কোল ঘেঁষে এজন্যই চীনা অর্থায়নে তৈরি হয়েছে গোয়াদার বন্দর। চীনকে ভারত মহাসাগরের এক কৌশলগত স্থানে আসার সুযোগ করে দিয়েছে গোয়াদার। এ উপস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের জ্বালানি আমদানি এবং পণ্য রপ্তানি বাণিজ্যকে শক্তিশালী ও সুরক্ষিত করবে।
বড় সহযোগী পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী:
দক্ষিণ চীন সাগরে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র এশীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে নৌ-অবরোধের ঝুঁকি বাড়ছে, তখন সিপিইসি হয়ে উঠতে পারে-চীনা বাণিজ্য ব্যবস্থার বিকল্প অর্থনৈতিক ধমনী। যার কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে গোয়াদার।
বন্দর সুরক্ষায় গোয়াদার এবং গিলগিট-বালটিস্তান প্রদেশে চীনা সামরিক বাহিনী মোতায়েনের গোপন অনুমতি দেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ রয়েছে। তবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ বরাবরই এগুলোকে নেহাত গুজব, বলে নাকচ করে দিয়েছে।
তবে যা প্রকাশ্য তা হচ্ছে; অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের কৌশলগত এ বিনিয়োগগুলো সুরক্ষায় পাকিস্তানের প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাজ করছে চীন। প্রকল্পের কাছে ঠিকাদারি বণ্টনে প্রাধান্য দিচ্ছে, সামরিক বাহিনীর আওতাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে। ইতোমধ্যেই, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবকাঠামো নির্মাণ সংস্থা- ফ্রন্টিয়ার ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন (এফডব্লিউও) সিপিইসি প্রকল্পের অনেকগুলো কাজ পেয়েছে।
এসব কাজের মধ্যে রয়েছে, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের কাশগড় নগরীর সঙ্গে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশকে যুক্তকারী কারাকোরাম হাইওয়ে পুনঃনির্মাণ এবং উন্নয়নের কাজ। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২শ' কোটি ডলার। বিকল্প বাণিজ্য পথ তৈরির মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে- এ সড়কের কৌশলগত তাৎপর্য চীনের জন্য অপরিসীম।
পাকিস্তানের বেসামরিক ঠিকাদারদের না দিয়ে সামরিক বাহিনীকে কাজ দেওয়ার কারণ দুইটি। প্রধানত; সামরিক ইঞ্জিনিয়ারদের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয়ত বেসামিক খাতের দুর্নীতির ইতিহাস। তাছাড়া, সিপিইসি ঘিরে পাকিস্তান ও চীনের সামরিক লক্ষ্যও সুদূরপ্রসারী।
এ অবস্থায় চীনের নতুন করে দুইশ' কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা- মহামারিকালে পাকিস্তানের জন্য একটি দারুণ অর্থনৈতিক সম্ভাবনার খবর। বিশেষ করে, যখন ২০১৮ সালে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ দল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কিছুটা স্তিমিত হয় সিপিইসি বাস্তবায়নের গতি।
চীনের বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড) ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে নানা দেশকে দেনার জালে জড়ানো হচ্ছে, পশ্চিমা দেশগুলোর এমন সমালোচনা ও চাপের মুখে ইমরান খান- বেশকিছু প্রকল্পের আর্থিক কলেবর এবং অন্যান্য চুক্তির ধারা নিয়ে পুনঃআলোচনা শুরু করেন।
এরপর চলতি বছরের জুন থেকে আবারো শুরু হয় সিপিইসি'র দ্বিতীয় ধাপের কাজ। এই পর্যায়ে নির্মাণ করা হচ্ছে দুইটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প; আজাদ পাত্তান পাওয়ার প্রজেক্ট এবং কোহালা হাইডেল পাওয়ার প্রজেক্ট। দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছ- পাকিস্তান শাসিত আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট বালটিস্তান প্রদেশে। প্রকল্পদ্বয়ের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯০ কোটি ডলার।
চীনভিত্তিক শক্তি উৎপাদক কোম্পানি; চায়না থ্রি গর্জেস কর্পোরেশন এবং পাওয়ার ইউনিভার্সাল কো. লিমিটেড দুটি প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ করবে। বাকি ২০ শতাংশ কাজের সত্ত্ব পেয়েছে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এফডব্লিউও এবং লারাইব গ্রুপ। অবশ্য লারাইব একটি বেসরকারি নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদক সংস্থা।
ভারতের সঙ্গে বিতর্কিত সীমানায় একই সময় ডিয়ামার-ভাসা বাঁধ উদ্বোধন করেছেন পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। বাঁধটি সিপিইসি প্রকল্প না হলেও- এর সিংহভাগ অর্থায়ন এসেছে বেইজিং থেকেই।
বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে সিপিইসির বিস্তার:
ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে সঙ্গে সীমান্তের এপাড়ে গিলগিট বালটিস্তান প্রদেশে সিন্ধু নদীর উপর নির্মীয়মান এ বাঁধ তৈরিতে খরচ হবে ৮৫০ কোটি ডলার। একে পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাঁধ বলা হচ্ছে। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে যৌথ নদীর উপর আরেকটি বাঁধ নির্মাণ করছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। তারই পাল্টা জবাব দিচ্ছে পাকিস্তান।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি চায়না পাওয়ার এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এফডব্লিউ যৌথভাবে এ প্রকল্পের কাজ করছে। পাকিস্তানের জাতীয় গ্রিডে এ বাঁধ থেকে উৎপাদিত সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হবে। তবে বিতর্কিত অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায়, এর আগে ওয়াশিংটন ভিত্তিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে অর্থায়ন করতে অস্বীকৃতি জানায়।
ভারতীয় এবং পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের অভিযোগ, ডিয়ামার-ভাসা বাঁধ সম্পূর্ণ হওয়ার পর চীন তার সামরিক বাহিনী তথা গণমুক্তি ফৌজকে গিলগিট বালটিস্তানে বা এর নিকটবর্তী স্থানে মোতায়েনের অবকাশ পাবে। ফলে অত্র-অঞ্চলে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মোকাবিলায় আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে পাকিস্তান।
কেউ কেউ আবার আশঙ্কা করছেন, পাকিস্তানে আনুষ্ঠানিক সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা থেকে চীন সামান্য দূরেই অবস্থান করছে। অর্থাৎ, কিনা তারা অচিরেই এমনটি ঘটার আঁচ করছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক উইলসন সেন্টারের এশিয়া অধ্যয়ন কেন্দ্রের ডেপুটি ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান –এর বরাত দিয়ে ইতোপূর্বে প্রকাশিত নানা গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে চীনা বিনিয়োগ নিঃসন্দেহে ভারতকে বড় ধরনের আঘাত হানার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে।
''এ পদক্ষেপ ভারত-চীন সম্পর্কে নতুন উত্তেজনার সংবেদনশীল ক্ষেত্র তৈরি করবে। ইতোমধ্যেই, বিগত কয়েক দশকের তুলনায় অনেক বেশি চাপের মুখে রয়েছে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক'' কুগেলম্যান বলেছিলেন।
তার ওই অনুমান ভুল হয়নি। গত ১৫ জুন লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভারতীয় সেনা এবং চীনা গণমুক্তি ফৌজের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়।
তবে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা হ্রাসে পাকিস্তানের সিপিইসি প্রকল্প বন্ধ করার কোনো অভিপ্রায় চীনের নেই। সেটা তাদের বৃহত্তর লক্ষ্য পূরণের সম্পূরকও নয়।
অভিন্ন ভবিষ্যতের পরিকল্পনা:
পাকিস্তানে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম সেনাবাহিনীর নির্মাণ সংস্থা- এফডব্লিউও ইতোমধ্যেই ১,১৫০ কিলোমিটার লম্বা মহাসড়ক নির্মাণের কাজে জড়িত, যা গোয়াদার বন্দরকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করবে। এটা পাকিস্তান সরকারের ১১শ' কোটি ডলারের বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ পরিকল্পনার অংশ।
প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, চীনের এক্সিম ব্যাংক এবং চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। যদিও, অর্থায়ন চুক্তির অনেক শর্ত জনসাধারণের কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছে, এমন দাবি করেছে সিপিইসি বিরোধীরা।
এফডব্লিও পেশোয়ার মডেল সিটি টাউনশিপ এবং খাইবার-পাখতুনখোয়া চায়না ইনভেস্টম্যান প্ল্যানের আওতায় আরও ১০.৯ বিলিয়ন ডলারের কাজ পেয়েছে। এর অধীনে খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে শিল্প পার্ক নেটওয়ার্ক নির্মাণ করা হবে। এছাড়া, চিত্রালে তিনটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, হরিপুরে একটি সিমেন্ট কারখানা এবং কারাকে স্থাপন করা হবে একটি অত্যাধুনিক জ্বালানি পরিশোধনাগার।
এক কথায় পাকিস্তানে চীন জড়িত বিপুল কর্মযজ্ঞে। আর এতে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখছে দেশটির সামরিক বাহিনী। কম্পিটিশন কমিশন অব পাকিস্তানের (সিসিপি) এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, এফডব্লিউও সাড়া দেশ জুড়ে ১৩ হাজার কিলোমিটার সড়ক এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে জড়িত। এতে তাদের নিজস্ব কর্মীসহ প্রায় ৫০ হাজার মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
এজন্যেই আজাদ কাশ্মীরে সিপিইসি প্রকল্পের অস্তিত্ব নিয়ে ভারতের যত বিরোধিতাই থাকুক, তা আমলে নিতে রাজি নয় চীন ও পাকিস্তান। পশ্চিমা চাপ থাকা সত্ত্বেও চলতি মাসেই এমন আভাস দেন পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলে, চীন এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন একে-অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই স্বার্থকে আলাদাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তবে একইসঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ধরে রাখার প্রতিও গুরুত্ব দেন।
- সূত্র: এশিয়া টাইমস অবলম্বনে
- অনুবাদ: নূর মাজিদ