অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪: আয়ের সঠিক তথ্য পেতে চ্যালেঞ্জের মুখে মাঠকর্মীরা
চলমান অর্থনৈতিক শুমারির জন্য তথ্য সংগ্রহে প্রতিষ্ঠানের সঠিক আয়ের তথ্য পেতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন মাঠ কর্মীরা। আর মাঠ পর্যায়ে আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব উঠে না আসলে শুমারিতে এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর সাভারের আশুলিয়ায় প্রায় ১০ জন মাঠকর্মী এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যয়ের তথ্য দিলেও অনেক প্রতিষ্ঠান আয়ের তথ্য দিতে চাচ্ছে না। তখন তাদের ব্যয় ধরে আয় হিসেব করতে হচ্ছে। এর ফলে আয়ের সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিন আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, তথ্য সংগ্রহকারীর ট্যাব হাতে তথ্য সংগ্রহ করছেন। কথা হয় তথ্য সংগ্রকারী মোহম্মদ সেলিম হোসেন সঙ্গে। তথ্য সংগ্রহে কী সমস্যায় পড়তে হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এখানে যে তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে, তারা বেশিরভাগই আয় বলতে চায় না। মূলধন কেমন সেই তথ্যও অনেকে দেয় না।"
"কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বলছে, 'আপনার প্রশ্ন রেখে যান আমরা তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করবো। তবে আয় এবং মূলধনের তথ্য আমরা দিতে পারবো না'," বলেন তিনি।
আরেক গণনাকারী মোহম্মদ আল আমিন বলেন, "এখানে মুদি দোকান, মার্কেটের আয়ের তথ্য সংগ্রহ বেশিরভাগ অনুমানের ভিত্তিতে করতে হচ্ছে। আসল তথ্য তারা বলে না। এই এলাকায় আমার বাসা, তাই তারা আয়ের তথ্য না দিলেও বুঝি যে কোন দোকানে কেমন বিক্রি হয়, কোন মার্কেটের কী বিক্রি হয়— তার উপর নির্ভর করে একটি ধারণা নিয়ে আয় দিয়েছি," বলেন আলো আমিন।
এখন পর্যন্ত প্রায় যে ৯০টি ইউনিটের তথ্য আল আমিন সংগ্রহ করেছেন, তার প্রায় ৮০ ভাগ আয়ের তথ্য ধারণার-ভিত্তিতে নিয়েছেন বলে জানান।
মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহকারীদের কাজের দেখভাল করছিলেন জোন-১৪ এর সুপারভাইজার মো. আনোয়ার হোসেন। টিবিএসকে তিনি বলেন, "বড় কারখানায় মাঝেমধ্যে তথ্য সংগ্রহকারীদের ঢুকতে সমস্যা হয়। আমার আওতায় প্রায় ১০০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। ওনারা সাধারণত বলেন, 'এখন আমাদের প্রতিষ্ঠানের এমডি নেই। কখন এমডি আসবেন বলতে পারছিনা। কালকে আসেন।' কালকে আসলে তারা আবারও কোনো বহন দেয়।"
অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রকল্প পরিচালক এস এম শাকিল আখতার টিবিএসকে জানান, "আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলছি, আপনাদের তথ্য গোপন থাকবে। এ তথ্য ব্যাংক, এনবিআর পাবে না। এটা গোপনীয়।"
তিনি বলেন, "আসলে সবাইতো সঠিক তথ্য দেবে না। আমরা কাছাকাছি হিসেবে যাচ্ছি। দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে কী পরিমাণ লেনদেন করে, এর একটি ধারণা পাব। কাছাকাছি পরিমাণটা জানতে পারলেও সরকার উপকৃত হবে।"
শাকিল আরও বলেন, "আয়ের তথ্যসহ অন্যান্য তথ্য পেতে আমাদের তথ্য সংগ্রহকারী প্রয়োজনে ৩ বার যাচ্ছেন। প্রথম না দিলে দ্বিতীয় বার, এরপর তৃতীয় বার যাচ্ছেন। বার বার যাওয়ার পরও এ তথ্য না দিলে আমারা বলবো আয়ের তথ্য দিতে তারা ইচ্ছুক না।"
তিনি জানান, অর্থনৈতিক শুমারির মাধ্যমে প্রায় ৭০টি প্রশ্ন উঠে আসবে। এবারই প্রথম ট্যাবের মাধ্যমে 'ক্যাপি' পদ্ধতিতে এই শুমারির তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই লিস্টিংয়ের মাধ্যমে ১ কোটি ২২ লাখ ইউনিট চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখান থেকে এবং এর বাইরে থেকেও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
শাকিল আরও জানান, "ইতোমধ্যে শনিবার দুপুর ২টা পর্যন্ত ৭২ শতাংশ তথ্য সংগ্র হয়েছে। শুমারিতে প্রথমবারের মতো দেশে কতজন বিদেশি কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন, তারা কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানে কোন ধরনের পদে কর্মরত এবং নারী-পুরুষ কতজন সেসব তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে।"
অর্থনৈতিক শুমারি-২০২৪ এর আওতা হলো— দেশের সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান, কৃষি বহির্ভূত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্বলিত সকল খানা এবং সকল প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি খামার।
গত ১০ ডিসেম্বর তারিখ থেকে এই শুমারির তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে, চলবে আগামী ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) চতুর্থবারের মতো এই অর্থনৈতিক শুমারি পরিচালনা করছে। প্রতি ১০ বছর পরপর এটি অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, যদি সঠিক তথ্য সংগ্রহ না করা যায়— তাহলে এই তথ্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করলে সেটাও সঠিক হবে না। বিগত সময়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর অনেক তথ্য নিয়ে সন্দেহ ছিল। সুতরাং, তারা তাদের পূর্ববর্তী কাজ থেকে শিক্ষা নিতে পারছেন না।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, "তথ্য ঘাটতি থাকলে এ তথ্য সংগ্রহ করে লাভ হবে না। এই তথ্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করলে সেটাও সঠিক হবে না।"
"যাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, তাদের সবাইকে ভালোভাবে বোঝাতে হবে যে, এটা গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হবে। এরসঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো বিষয় জড়িত নয়।"
বড় সার্ভে করার আগে বিবিএসএর একটি নিজস্ব মূল্যায়ন করা উচিত বলেও উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ।