নিকেতনের সেই ‘ভূতুড়ে বাড়ি’তে সত্যিই ভূত আছে?
১
প্রায়ই আমি এই বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করি। তবে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেমন যেন অস্বস্তি শুরু হয়। হয়তো এটি অনেক পুরোনো, দীর্ঘদিন খালি পড়ে থাকা বাড়ি বলে। এসব কথা মনে করতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। দিনের বেলাতেও বাড়িটির দিকে তাকালে মনে হয়, যেন কেউ আমার পিছু পিছু হেঁটে আসছে। আর রাত হলে সেই অনুভূতি আরও তীব্র হয়ে ওঠে। তখন ভয়ে জমে যাই।
একবার রাতের বেলা এই পথ দিয়েই বাজার করে ঘরে ফিরছিলাম। রাত ১১টা কিংবা ১২টা হবে। চারদিকে নিস্তব্ধতা। হঠাৎ কেন যেন মনে হলো, কেউ পেছন পেছন ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। ভয়ে পেছন ফেরার সাহসও করতে পারছিলাম না। তবুও সাহস করে তাকালাম, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। তখন দম বন্ধ হয়ে আসার মতো উপক্রম হয়। সেদিন দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম।
২
এলাকার মানুষজন বলে, এই বাড়ির ছাদে নাকি প্রায়ই সাদা কাপড়ে মোড়ানো এক অশরীরীকে হাঁটতে দেখা যায়। কত লোকজনই এমন দৃশ্য দেখার কথা বলেছে তার হিসেব নেই। যদিও আমি নিজের চোখে কখনো কিছু দেখিনি, তবে এই বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এসব কথাগুলো আমাকে আরও বেশি ভীত করে তুলত।
সবাই বললেও প্রথমে বিশ্বাস হতো না। একদিন বাড়ির ভেতরটা দেখার ইচ্ছা হলো। অবশ্য ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি কখনো। তবে নিচতলার একটি জানালা একটু ফাঁক করে উঁকি দিয়েছিলাম। রুমের ভেতরের দৃশ্য দেখে যেন হাত-পা অবশ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়। পুরো ঘর পানিতে ভরে ছিল—নোংরা আর বিদঘুটে গন্ধযুক্ত পানি। অথচ রাস্তাঘাট পুরো শুকনো ছিল, তবু ঘরের মধ্যে পানি!
এসব দেখে সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম। সাধারণত মানুষের ঘর তো এমন হয় না। তবু আমার জানতে ইচ্ছে করে, সাদা কাপড়ে মোড়ানো অশরীরী কি সত্যিই সেই ছাদে ঘোরে? না-কি এসব শুধুই মানুষের মনের ভুল?
৩
এই বাড়ির দ্বিতীয় তলার বাসায় আমরা এক বছর ধরে আছি। আমি কখনো ভয় পাইনি। তবে আসার পর থেকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছেন আমার মা আর আমার ছেলের বউ। তারা কখনোই বাসায় একা থাকতে চান না। আমার মা প্রায়ই বলেন, তিনি উদ্ভট কিছু অনুভব করেন। মাঝরাতে অজানা শব্দ তার ঘুম ভেঙে দেয়। কখনো দেয়ালে আচমকা শব্দ হয়, কখনো পায়ের চাপা আওয়াজ। মা এসব বলার পর থেকেই ছেলের বউও একা থাকাকে এড়িয়ে চলে।
আমাদের বাসার দক্ষিণপাশে একটি বাথরুম আছে, যেটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক। কেউ সেটি ব্যবহার করতে চায় না। কারণ, ফ্ল্যাশ করার পরপরই সেখানে উদ্ভট এক ধরনের শব্দ হয়। শব্দটা যেন একসঙ্গে পাথর ঘষার মতো ভয়ঙ্কর। প্রথম দিকে আমরা বিষয়টা এড়িয়ে গেছি। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই শব্দ আমাদের সবার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখন আমরা সবাই বাথরুমটি ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছি।
নীচতলা অন্ধকার। সিড়িগুলো চাপা। সেই সিড়ি দিয়েই কে যেন মাঝরাতে হেঁটে বেড়ায়! কখনো কখনো সাদা কাপড় পরা কাউকে দেখা যায় বলে অভিযোগ করেছিলেন আগের ভাড়াটিয়ারা।
বাড়িটি বাইরে থেকে দেখলেই যে কারো থমকে যাওয়ার কথা। মেরামতের অভাবে পুরোনো ইট-সুরকি আরও বেশি মলিন। রঙ নেই, যত্নের বালাই নেই। পুরো বিল্ডিংজুড়ে সিমেন্টের আস্তরণ নেই। কোনোরকম ইট দিয়ে যেন তড়িঘড়ি করে তৈরি করা। সেসবও পুরোনো হয়ে মৃত দেয়ালের রূপ ধারণ করেছে।
দরজা-জানালার অবস্থাও বেহাল। জং ধরা জানালার দিকে তাকালেই কেমন যেন গা ছমছম করে। ভেতরে ঢুকতেই অন্ধকার। ভর দুপুরের আলোও বাড়ির ভেতরে তেমন প্রবেশ করতে পারে না। সিড়ির মাঝখানে কুঠুরির মতো যেটুকু খোলা রাখা হয়েছে, সেখান দিয়ে সামান্য আলো প্রবেশ করে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত বলা যাবে না।
তাই দিনের বেলাতেও বাড়ির ভেতরটা কেমন যেন অন্ধকার লাগে। তার ওপর এলাকার সবাই বাড়িটিকে ভূতের বাড়ি বলে চিনে!
ঢাকা শহরে যেখানে মানুষ থাকারই জায়গা পাওয়া যায় না, সেখানে থাকবে ভূত? ফেসবুকে এই ভূতের বাড়ির খবর পেয়ে তাই কৌতুহল জাগল বেশ।
বাড়িটি নিকেতনে!
নিকেতন বাজার গেট থেকে মিনিট পাঁচেক পায়ে হেঁটে সামনে এগোলেই চোখে পড়ে এটি। দক্ষিণপাড়ার সরু গলিটি দিয়ে হাটতে গেলেই অনায়াসে চোখ পড়ে যায় দোতলা এই জীর্ণ ভবনের দিকে।
স্থানীয়দের মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে বহু কল্পকাহিনি। দোকানদার, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে আশপাশের সব বাসিন্দাই বাড়িটিকে ঘিরে নানা কথা বলেন। কেউ বলেন, বাড়ির ভেতরে কোনো এক মহিলার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। কেউ আবার রাতের আঁধারে ভৌতিক আওয়াজ শোনার দাবি করেন।
কেউ আবার বলেন, বাড়িটির সামনে গেলেই মনে হয় কেউ বুঝি তাকিয়ে আছে, কিছু একটা দেখা যাবে, কেউ বুঝি পিছু নিলো আমার।
আগ্রহ নিবারণে আমরা কথা বলেছিলাম বাড়িটির দেয়াল ঘেঁষে থাকা মুদির দোকানদার মতিউর রহমানের সাথে (ছদ্মনাম)। ভূত প্রসঙ্গে জানতে চাইতেই তিনি মুচকি হাসেন। ভদ্রলোকের হাসিতে অবশ্য রহস্যের জটলা খোলা মুশকিল।
গালভর্তি হাসি নিয়ে তিনি জানালেন, "দুতলায় লোক আছে, গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তারাই বলে দিবে কিছু আছে কি-না!"
নিচতলার জং ধরা লোহার গেইট ঠেলে প্রবেশ করলাম। কেমন যেন মেঠে গন্ধ। অনেকদিন মানুষের চলাচল না থাকলে বাড়িঘর যেমন হয়, অনেকটা তেমনই।
এ তলাতে মানুষের বসবাস নেই সেই শুরু থেকে। অবশ্য নতুন কেউ গেলেই সেটা আঁচ করতে পারবেন আরও সহজে।
ভেতরে ঢুকলে সত্যিই গা শিউরে উঠে। হয়তো ভাবনার ভুল। আগে থেকে শোনা গল্প গুজবের প্রভাবও হতে পারে। সাহস করে কোনোরকম নিচতলা পার করে উঠে পড়লাম দোতলায়।
বাড়ির ভেতরে সিড়িটা এমনভাবে বানানো, যেখানে কোনোরকম একজন ওঠা যায়। অর্থাৎ কেউ নামলে, অন্য কারোর উঠতে অপেক্ষা করতে হবে তার নেমে যাওয়া পর্যন্ত।
দোতলার দুপাশে দুটো ফ্ল্যাট চোখে পড়লো। একটিতে লোহার সবুজ দরজা, অন্যটায় লোহার গ্রিল। সাহস করে কড়া নাড়লাম সবুজ রঙের দরজায়।
পঞ্চাশোর্ধ এক ভদ্রমহিলা এসে দরজাটি খুললেন। আমাদের দেখে কিছুটা অবাক হলেন বটে। তবে একেবারে ঘাবড়ে গেছেন সেটা বলা যাবেনা। পরিচয় বিনিময় করতে করতে আলোচনা গড়ালো কিছু সময়।
কথা প্রসঙ্গে সবার কাছে এটি ভূতের বাড়ি হয়ে ওঠার গল্প জানতে চাইলাম। ভদ্রমহিলা এবার একটু থেমে গেলেন। মিনিট এক চুপ থাকলেন। তারপর আবার আগের গতিতে কথা চালিয়ে গেলেন।
জানালেন, তিনি এই বাড়িতে উঠেছেন বছর এক গড়িয়ে গেল। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে উঠেছিলেন তিনি। অবশ্য এই মাসের শেষেই নাকি আবার বাড়ি ছাড়বেন। থাকবেন অন্য কোথাও। কৌতুহল নিবৃত্ত করতে জানতে চাইলাম, ছাড়বেন কেন? ভূতের বাড়ি বলে? না-কি কখনো ভয় পেয়ে বসেছেন!
এবার তিনি মুচকি হাসলেন। জানালেন, "আমি গল্প শুনসি, নিজের চোখে কিছু দেখিনাই এখনো।"
গত এক বছরে কোনোরকম তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়নি তার। অথচ এখানে না আসার আগে এই বাড়িটি নিয়ে তারও ভয়ের শেষ ছিল না।
এলাকার তিনি আছেন সেই ১৯৮০ সাল থেকে। এখানেই বিয়ে, এখানেই সংসার এবং ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকা। ১৯৮৮ সাল থেকে এই বাড়িটি তিনি খালি পড়ে থাকতে দেখেছেন। কেউ কেন থাকে না তা নিয়ে তারও মনে প্রশ্নের পাহাড় তৈরি হতো।
এমনকি এখানে থাকার আগে তিনি এদিকে ফিরেও তাকাতেন না ভয়ে। মনে করতেন মানুষ যা বলে তা কিছুটা হলেও সত্য। সবাই কীভাবে একই কথা বলবে! তার উপর কোনো মানুষের বসবাসই ছিল না সেখানে!
কিন্তু ভাগ্য কি সবার সহায় হয়? যেমনটা তারও হয়নি। বিপদে পড়ে বাধ্য হয়ে নিজের অপছন্দের এই বাড়িটিই একদিন মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে, তা হয়তো তিনিও কল্পনা করেননি।
এতসব জেনেও কম টাকায় বাসাটি ভাড়া নেন তিনি। সবমিলিয়ে ভাড়া মাত্র ১৩ হাজার। তিন রুমের বাসা। নিকেতন এলাকায় এই দাম কম বলেই গণ্য।
যেদিন তিনি ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ফ্ল্যাটে উঠলেন সেদিন তার মনেও ছিল প্রচণ্ড ভয়। তাই মোবাইলে, টিভিতে সুরা পাঠ ছেড়ে রাখতেন নিয়ম করে। প্রতিটি রুমে রুমেই ছিল এমন ব্যবস্থা। শুরুর দিকে অকারণেই ভয় পেতেন তিনি। তবে মানুষের ছড়ানো গালগল্পের কিছুই আঁচ করেননি। এখন তো সামান্যতম ভয়ও কাজ করে না আর।
তার ভাষ্যে, "এক বছরে কোনো সমস্যা হয়নি। পরে বুঝতে পারলাম লোকে যা বলতো, সবটাই বানানো গল্প গুজব ছিল।"
ভূত না থাকলেও আছে ভীতি
স্থানীয় মানুষজন, দোকানদার সকলেই জানালেন, এই বাড়ি ঘিরে মানুষের ভীতি আছে বেশ! বাড়িটির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেও অনেকে ভয় পান। তবে ভূতের ব্যাপারটি উড়িয়ে দিচ্ছেন সবাই।
দোকানদার করিম মিয়া জানালেন, ভূতের ব্যাপারটি শুধুই গালগল্প। বললেন, 'এগুলা আজাইরা গল্প। বাড়িটা দেখা যায় পুরানো বাড়ি, মানুষই নাম দিছে। নাম ধইরা ডাকতে ডাকতে ভূতের বাড়ি নাম পড়ছে।'
অন্য এক দোকানদারও জানালেন সেরকম। ছোটবেলায় কোন জায়গায় আছেন তা বোঝাতে এই বাড়িটির নাম ব্যবহার করতেন। "আমরা যখন খেলতে যেতাম, কেউ জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলতাম এই ভূতের বাড়ির সামনে আছি, এখানে আয়। এভাবেই নাম পড়ে গেছে!"
'ভূতের বাড়ি' হয়ে ওঠার গল্প
অবশ্য তাদেরই বা কী দোষ! তৈরি করার পর থেকেই বাড়িটি দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে ছিল। বছরের পর বছর যায়, কিন্তু কেউ সেখানে থাকার নামগন্ধ নেই।
স্থানীয়রা বলেন, মালিকানার জটিলতার কারণে এভাবে পড়ে ছিল এটি। কেউ বলেন তিন থেকে চারজন এই বিল্ডিংয়ের মালিকানার দাবিদার। আবার কেউ বলেন, আপন দুই ভাইয়ের তৈরি করা দালান এটি। এখন অবশ্য মালিকপক্ষের একজনের পরিবার থাকেন দুতলায়। তারা মালিকের ছেলের বউ এবং ছোট দুটি নাতি-নাতনী।
১৫ বছর ধরে এখানেই থাকছেন ছেলের বউ। তিনিও জানালেন, ছোট দুই ছেলে- মেয়ে নিয়ে থাকেন, তবুও কখনো ভয় পাননি।
"মানুষ চায় আমাদের এখানে কেউ না থাকুক। এসব মিথ্যা, কেউ যাতে থাকতে না পারে এই কারণে ছড়ানো হইসে", বলেন তিনি।
তবে এই ১৫-২০ বিশ বছর আগে যে কেউ থাকতেন না সেটিও জানা গেলো তার কথায়। স্থানীয়দের মতে আশির দশক থেকে খালি পড়ে আছে এটি। এমনকি বাড়িটিও পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি সেভাবে।
এভাবে খালি পড়ে থাকার দরুণ আশপাশের বাসিন্দারা সুযোগ বুঝে বাড়িটির সঙ্গে ভূতের নাম জুড়ে দিয়েছেন বেশ শক্তভাবে।
সবটাই গুজব?
দোকানদার মতিউর রহমান জানান, "এই বাড়ি নিয়ে যত কথা শোনা যায়, সবই গুজব। আমি এখানে অনেক বছর ধরে দোকানদারি করি। কোনোদিন কিছু দেখি নাই। সবার আগে আমারই দেখার কথা, যেহেতু আমার দোকানের সাথেই এই বিল্ডিং।
"আসলেই লোকজনকে ভয় দেখানোর জন্য এসব গল্প বানানো হয়েছে, এইটা সত্য।"
রহস্য কি তবে মানুষই তৈরি করেছে? উত্তর হ্যাঁ বলতে আপত্তি নেই। এমনকি এই বাড়ি নিয়ে স্থানীয়দের কৌতূহল এখনও শেষ হয়নি। এখনো বন্ধুরা মিলে একে অপরকে ঠিকানা দেন ঠিক এভাবে: "ভূতের বাড়ির সামনে আয়, দেখা হবে।"
মতিউরের মতো বাড়ির ভাড়াটিয়া এবং আশেপাশের আরও অনেকের মতে, বাড়িটি নিয়ে মানুষ যা বলে, তার বেশিরভাগই গুজব।
বাড়ির আশেপাশের অনেকের মত, বাড়িটির বেহাল দশাই এই নামের জন্য দায়ী। পরে সেটিই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। আর এই কাল্পনিক ভীতিটুকু টিকে রয়েছে এখনও।
অনেকটা যেন 'বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়।'
ছবি: জুনায়েত রাসেল/টিবিএস