যেভাবে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে কে-পপের জগতে পা রাখলেন এক উত্তর কোরীয়
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/12/yu_hyuk.jpg)
চীন এবং রাশিয়ার সীমান্তে অবস্থিত উত্তর হামগিয়ং উত্তর কোরিয়ার অন্যতম দরিদ্র প্রদেশ। সেখানেই নয় বছর বয়সী ইউ হিউক রাস্তায় ভিক্ষা করা শুরু করেন।
ভিক্ষা করার পাশাপাশি তিনি সৈন্যদের জন্য ছোটখাটো কাজ করতেন এবং মাশরুম সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন। কখনো কখনো ক্ষুধার তাড়নায় খাবার চুরি করতেন। একবার তিনি একটি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনেপরে থাকা লাঞ্চবক্স চুরি করেছিলেন, যার ভেতরে ছিল এক মুঠো পচা ভাত।
ইউ বলেন, এটি ছিল বহু উত্তর কোরিয়ানদের জন্য 'প্রতিদিনের জীবনযাত্রার অংশ'। তিনি আরও বলেন, তার নিজের জীবনও বেঁচে থাকার জন্য এত যুদ্ধ করতে হয়েছে যে, সেখানে স্বপ্ন দেখার কোনো জায়গা ছিল না।
কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই বছরেই ২৫ বছর বয়সী ইউ হিউক যুক্তরাষ্ট্রে একটি কে-পপ বয় ব্যান্ড সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন।
ওয়ানভার্স [যা 'ইউনিভার্স' বলে উচ্চারণ করা হয়] ব্যান্ডে পাঁচজন সদস্য রয়েছেন: ইউ হিউক, সিওক (তিনি উত্তর কোরিয়া থেকে এসেছেন), আইতো (জাপান থেকে), এবং কেনি ও নাথান (এশিয়ান-আমেরিকান)। তারা সবাই তাদের প্রথম নামেই পরিচিত হতে পছন্দ করেন। তারা ইতিহাস তৈরি করতে যাচ্ছেন, কারণ তাদের ব্যান্ডটি প্রথম কে-পপ বয় ব্যান্ড, যেটি উত্তর কোরিয়ার শরণার্থী সদস্যদের নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে।
স্ক্র্যাপ থেকে র্যাপ: ইউ হিউকের সংগ্রামী যাত্রা
ইউ হিউক কিয়ংসং জেলার একটি উপকূলীয় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং মাত্র চার বছর বয়সে তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর তার বাবা এবং দাদির সাথে বড় হন।
পরবর্তীতে, তার মা উত্তর কোরিয়া ছাড়েন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাস শুরু করেন। এরপর তিনি ইউকে তার কাছে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তবে ইউ হিউক তা প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি তার বাবার কাছে ছিলেন এবং তাকে ছাড়তে চাননি।
ইউ হিউক বলেন, তার পরিবার প্রথমদিকে "অনেক গরিব" ছিল না, কিন্তু তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হয়ে যায়। তার বাবা কাজ করতে চাইতেন না এবং তার দাদি খুব বৃদ্ধ ছিলেন। ফলে ইউ হিউককে নিজের উপার্জন এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য একা থাকতে হয়েছিল।
অবশেষে, তার বাবা তাকে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য রাজি করান এবং ২০১৩ সালে ইউ হিউক উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছান।
দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছাতে তার কয়েক মাস সময় লেগেছিল। তিনি তার যাত্রার বিস্তারিত প্রকাশ করতে চাননি, কারণ ভবিষ্যতের শরণার্থীদের ঝুঁকির মুখে ফেলার আশঙ্কা ছিল।
দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছানোর পর তিনি এক বছর তার মায়ের সাথে কাটান। এরপর মায়ের আর্থিক সহায়তায় একটি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হন। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার কঠোর শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে তার অনেক সমস্যা হয়েছিল, কারণ উত্তর কোরিয়া থেকে পালানোর আগে তিনি প্রাথমিক স্কুলও শেষ করেননি।
লেখার মাঝেই তিনি শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন বলে জানান।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/12/1verse.jpg)
প্রথমে, তিনি ছোট কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন, যা তার উত্তর কোরিয়ার জীবনের স্মৃতি ধারণ করতো। তিনি বলেন, "আমি যা কিছু যাপন করেছি, তা খোলামেলা ভাগ করে বলতে পারতাম না, তবে তবুও আমি তা রেকর্ড করতে চেয়েছিলাম।"
প্রথমে ইউ হিউক বিশ্বাস করতেন, তার গল্প অন্যরা বুঝতে পারবে না। তবে তার স্কুলের বন্ধু ও শিক্ষকদের উৎসাহে তিনি মিউজিক ক্লাবে যোগ দেন এবং শেষপর্যন্ত র্যাপের প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়।
শৈশবে তার কাছে সঙ্গীত ছিল একটি বিলাসিতা, কে-পপ তো তিনি খুব কমই শুনেছিলেন। তবে এখন তিনি একাকিত্ব এবং তার বাবাকে মিস করার অনুভূতিকে সঙ্গীতে রূপ দেন। নিজেকে "একাদের মধ্যে সবচেয়ে একাকী" হিসেবে উল্লেখ করেন। এটি তার র্যাপ গান 'অর্ডিনারি পারসন'-এর একটি লাইন।
ইউ হিউক ২০ বছর বয়সে হাইস্কুল শেষ করেন। এরপর, তিনি নিজের খরচ জোগাতে রেস্টুরেন্ট ও ফ্যাক্টরিতে পার্টটাইম কাজ করেন।
তবে ২০১৮ সালে একটি শিক্ষা বিষয়ক টিভি প্রোগ্রামে তার উপস্থিতি তার ভাগ্য পাল্টে দেয়। তার অনন্য ব্যাকগ্রাউন্ড এবং র্যাপ প্রতিভা সংগীত প্রযোজক মিশেল চোর নজরে আসে। তিনি পূর্বে এসএম এন্টারটেইনমেন্টের সদস্য ছিলেন, যা কে-পপের বড় বড় শিল্পীদের ব্যাংকিং এজেন্সি। তিনি ইউ হিউককে তার এজেন্সি, 'সিংগিং বিটল' -এ যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
ইউ হিউক বলেন, "প্রথম এক বছর আমি মিশেলকে বিশ্বাস করিনি, কারণ আমি ভাবছিলাম তিনি আমাকে ঠকাচ্ছেন।" তিনি জানান, দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে আসা (উত্তর কোরিয়ায়র) শরণার্থীরা প্রায়ই প্রতারণার শিকার হন।
কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারলেন, চো "অনেক সময় এবং অর্থ বিনিয়োগ করছেন।" তাই তিনি বুঝতে পারলেন, এটি একেবারে আসল ছিল।
'ভেবেছিলাম উত্তর কোরীয়রা হয়ত ভয়ানক হবে'
কিম সোক (২৪) ২০১৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে আসেন। তবে, তার অভিজ্ঞতা ছিল ইউ হিউকের থেকে একদম আলাদা।
তুলনামূলক ভালো পরিবারের সদস্য সোক চীন সীমান্তের কাছে বসবাস করতেন এবং চোরাই ইউএসবি ও এসডি কার্ডের মাধ্যমে কে-পপ শুনতেন ও কে-ড্রামা দেখতেন।
নিরাপত্তাজনিত কারণে তার উত্তর কোরিয়ার জীবন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় আসার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
চো উভয়কে "ফাঁকা ক্যানভাস" হিসেবে অভিহিত করে বলেন, কখনোই এমন প্রশিক্ষণার্থী তিনি দেখেননি। আইতো ও কেনির মতো, যারা শৈশব থেকেই সঙ্গীত এবং নৃত্যে দক্ষ ছিলেন, ইউ হিউক ও সোক ছিলেন সম্পূর্ণ নতুন।
তিনি চো বলেন, "তাদের পপ সংস্কৃতির ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিল না।"
তবে, তাদের "শারীরিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার" ক্ষমতা চোকে মুগ্ধ করেছে। তারা কঠোর নৃত্য প্রশিক্ষণ এত দৃঢ়তার সাথে সহ্য করেছিলেন যে, চো চিন্তিত ছিলেন তারা "অতিরিক্ত পরিশ্রম করছে"।
সঙ্গীত ও নৃত্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি, তাদের শিষ্টাচার এবং আলোচনায় অংশগ্রহণের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল, যাতে তারা মিডিয়া সাক্ষাৎকারের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
চো বলেন, "প্রথম দিকে, তারা কখনো কিছু প্রশ্ন করা বা নিজেদের মতামত প্রকাশ করার ব্যাপারে অভ্যস্ত ছিল না। একবার একজন প্রশিক্ষক তাদের চিন্তার পেছনের কারণ জানতে চাইলে, তাদের একমাত্র উত্তর ছিল, 'কারণ আপনি গতবার এমন বলেছিলেন।'"
তবে তিন বছরের বেশি সময় পর, ইউ হিউক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছেন।
চো বলেন, "এখন ইউ হিউক অনেক প্রশ্ন করে। যেমন, যদি আমি তাকে কিছু করতে বলি, সে বলে, 'কেন? এটা কেন প্রয়োজন?' মাঝে মাঝে, আমি যা করেছি তার জন্য আফসোস করি ।"
কিন্তু দলের অন্য দুই সদস্য তাদের বন্ধুদের সম্পর্কে কী ভাবছেন?
২০ বছর বয়সী আইতো দলের সবচেয়ে কমবয়সী সদস্য। তিনি বলেন, "প্রথমে আমি কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম, কারণ উত্তর কোরিয়ার সাথে জাপানের সম্পর্ক খুবই বৈরী। আমি ভেবেছিলাম উত্তর কোরীয়রা হয়ত ভয়ানক হবে। কিন্তু তা ঠিক নয়।"
কেনি তার জীবনের অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, সেখানে কিছু সাংস্কৃতিক পার্থক্য ছিল, যেগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে তার সময় লেগেছে।
তিনি বলেন, "কোরিয়ান সংস্কৃতি অনেকটা সম্প্রদায়ভিত্তিক। এখানে সবাই একসাথে খায়... এটা আমার জন্য সাংস্কৃতিক ধাক্কা ছিল। আমি সাধারণত অন্যদের সাথে খেতে পছন্দ করি না, আমি নেটফ্লিক্স দেখেই সময় কাটাই। তবে তাদের আনন্দ একসাথে থাকার মধ্যে নিহিত।"
গত বছর শেষে, ব্যান্ডে পঞ্চম সদস্য হিসেবে যুক্ত হন নাথান। তিনি লাওসের এবং থাই বংশোদ্ভূত আমেরিকান।
তারা আশা করছেন, এই বছর শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ব্যান্ড আত্মপ্রকাশ করবে এবং তারা অনেক বেশি আমেরিকান ভক্তদের আকর্ষণ করবেন।
একদিন উত্তর কোরিয়ায় গান গাওয়ার স্বপ্ন
প্রতিবছর অনেক কে-পপ গ্রুপ বা ব্যান্ড আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র কিছু গ্রুপ বড় পরিচিতি লাভ করে, বিশেষত যেগুলো বড় লেবেলের তত্ত্বাবধানে থাকে।
তাই ইউ হিউকের গ্রুপ ওয়ানভার্স জনপ্রিয় হবে কি না, তা বলা কঠিন। তবে ইউ হিউকের বড় স্বপ্ন, একদিন উত্তর কোরিয়ার তার সহকর্মীরা তার গান শুনতে পারবেন।
এখনকার পরিস্থিতিতে, যেখানে মানবাধিকারকর্মীরা বেলুন ও বোতলের মাধ্যমে কে-সংস্কৃতি সংবলিত ইউএসবি উত্তর কোরিয়ায় পাঠান, তার স্বপ্ন সত্যি হতে খুব একটা অসম্ভব মনে হচ্ছে না। তবে ইউ হিউক কিছুটা চিন্তিতও আছেন।
উত্তর কোরিয়ার সমালোচক হিসেবে পরিচিতি এড়ানোর জন্য, তিনি নিজের দেশের নাম "উপরের দিকে" বলে উল্লেখ করেন এবং কিম জং উনের নাম উচ্চারণ করতে চান না।
এটি একটি কঠিন বাস্তবতা, কারণ কিম জং উন গত কয়েক বছরে কে-সংস্কৃতির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। ২০২০ সাল থেকে কে-ড্রামা বা কে-পপ কনটেন্ট দেখা ও ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় দেশটিতে।
গত বছর, এক বিরল ভিডিওতে দেখা যায়, দুই কিশোরকে কে-ড্রামা দেখার জন্য ১২ বছরের কঠোর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে, ভিডিওটি ২০২২ সালে ধারণ করা হয়েছিল।
ডংগুক ইউনিভার্সিটির উত্তর কোরীয় অধ্যয়ন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হা সিউং-হি বলেন, ওয়ানভার্সের গান যদি উত্তর কোরিয়ায় জনপ্রিয় হয়, তাহলে সেখানে একটা বড় ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করবে।"
ইউ হিউকের মূল লক্ষ্য– উত্তর কোরীয় শরণার্থীরাও সফল হতে পারেন, সেটি প্রমাণ করা। তিনি বলেন, "অনেক শরণার্থী মনে করেন, কে-পপ আইডলদের সঙ্গে তাদের কোনো তুলনা নেই। আমাদের জন্য এটি প্রায় অসম্ভব।"
তিনি বলেন, "তাহলে যদি আমি সফল হই, অন্য শরণার্থীরা আরও বড় স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত হবে। এজন্যই আমি যতটুকু সম্ভব কঠোর পরিশ্রম করছি।"