সিনোভ্যাক: চীনের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সম্পর্কে কী জানি আমরা?
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরির চলমান বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মধ্যে চীন ইতোমধ্যেই অন্যান্য দেশে সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন পাঠানো শুরু করেছে।
বেইজিং ভিত্তিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি সিনোভ্যাকের তৈরি করোনাভ্যাক ভ্যাকসিনের ১২ লাখ ডোজ ইতোমধ্যেই ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছে গেছে। গণহারে টিকাদান কর্মসূচীর প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। জানুয়ারির মধ্যে আরও ১৮ লাখ ডোজ পাঠানোর কথাও হয়েছে।
তবে এখনো ভ্যাকসিনটির চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়াল শেষ হয়নি, ব্রাজিল ও তুরস্কে এখনো চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়াল চলমান।
সিনোভ্যাক ও অন্যান্য ভ্যাকসিনের পার্থক্য কী?
করোনাভ্যাক হলো ইনএক্টিভেটেড ভ্যাকসিন, মৃত ভাইরাস পার্টিকেল ব্যবহার করে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উজ্জীবিত করার মাধ্যমেই ভ্যাকসিনটি কাজ করে।
অন্যদিকে মডার্না ও ফাইজারের ভ্যাকসিন হলো এমআরএনএ ভ্যাকসিন। এর মাধ্যমে করোনাভাইরাসের জেনেটিক কোড দেহে প্রবেশ করানো হয়। ফলে মানব দেহে ভাইরাল প্রোটিন তৈরি হয় যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জাগিয়ে তোলে।
নানইয়াং টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক লুও দাহাই বিবিসি-কে জানান, "করোনাভ্যাক ভ্যাকসিনে প্রথাগত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, ইতোপূর্বে র্যাবিস সহ অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে এ উপায়েই সফল ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে এমআরএনএ ভ্যাকসিন তৈরির নতুন পদ্ধতি। এখন পর্যন্ত এ পদ্ধতিতে তৈরি ভ্যাকসিনের সফল ব্যবহারের কোনো উদাহরণ নেই।"
সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের একটি বড় সুবিধা হলো এটি ২-৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়-ই সংরক্ষণ করা যায়। মডার্নার ভ্যাকসিন মাইনাস ২০ ডিগ্রী এবং ফাইজারের ভ্যাকসিন মাইনাস ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। অর্থাৎ, সংরক্ষণের সুবিধা বিবেচনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সিনোভ্যাক ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনাকার ভ্যাকসিনই বেশি উপযোগী।
সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন কতোটা উপযোগী?
এখনো এবিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কঠিন। বিজ্ঞান সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে করোনাভ্যাক ভ্যাকসিনের শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের ফলাফল আছে।
ভ্যাকসিনটির গবেষণার সাথে যুক্ত ঝু ফেংচাই জানান, প্রথম পর্যায়ের ট্রায়ালের ১৪৪ জন ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের ৬০০ জন অংশগ্রহণকারীর ওপর চালানো গবেষণার ফলাফল থেকে বলা যায়, ভ্যাকসিনটি জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পাওয়ার জন্য উপযুক্ত।
সিনোভ্যাকের চেয়ারম্যান ও সিইও ওয়েদং ইং গত সেপ্টেম্বরে জানান, ১ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবীর ওপর চালানো পরীক্ষায় দেখা গেছে শুধু ৫ শতাংশের ক্লান্তির মতো সামান্য প্বার্শপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
অক্টোবরের শুরুতে ব্রাজিলে সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু হয়। একজন স্বেচ্ছাসেবীর মৃত্যুর পর সাময়িক ভাবে ট্রায়াল স্থগিত করা হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবীর মৃত্যুর সাথে ভ্যাকসিনের সম্পর্ক নেই জানার পরই আবারও ট্রায়াল শুরু হয়।
ব্রাজিলে সিনোভ্যাকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান দ্য বুটানান ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, তারা আশা করছে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই ব্রাজিলে চালানো চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশিত হবে।
অধ্যাপক লুও জানিয়েছেন, বর্তমান তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এখনো নিশ্চিতভাবে সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার ব্যাপারে কিছু বলা কঠিন। "তবে প্রাথমিক ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে করোনাভ্যাক-কে কার্যকর ভ্যাকসিনই বলা যায়। তবে নিশ্চিত তথ্যের জন্য আমাদের চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়ালের ফলাফল পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।" বলেন তিনি।
গণহারে টিকাদান শুরু জন্য ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়ালের ফলাফলই একমাত্র উপায় বলেও জানান তিনি।
প্রতিবছর কতো ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদনে সক্ষম সিনোভ্যাক?
সিনোভ্যাক প্রতি বছর ৩০ কোটি ডোজ উৎপাদনে সক্ষম বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। অন্যান্য ভ্যাকসিনের মতো সম্পূর্ণ সুরক্ষার জন্য করোনাভ্যাক ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ নিতে হবে। অর্থাৎ প্রতিবছর ১৫কোটি মানুষের জন্য ভ্যাকসিন উৎপাদনে সক্ষম সিনোভ্যাক। এ সংখ্যা চীনের মোট জনসংখ্যার এক দশমাংশ মাত্র।
তবে সিনোভ্যাক ইতোমধ্যেই ইন্দোনেশিয়ায় ভ্যাকসিন পৌঁছে দিয়েছে; তুরস্ক, ব্রাজিল ও চিলির সাথেও চুক্তি করেছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং আফ্রিকা মহাদেশে ভ্যাকসিন সহায়তার জন্য ২ বিলিয়ন ডলার এবং লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশগুলোর জন্য ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে চুক্তির শর্তের ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি।
মিরেকটর ইনস্টিটিউট ফর চায়না স্টাডিজের (মেরিকস) এর বিশ্লেষক জ্যাকব মারডেল এবিসি নিউজকে জানান, "জীবন রক্ষাকারী এ প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সুবিধাও পাবে বেইজিং।"
সিনোভ্যাকের করোনাভ্যাক ভ্যাকসিনের দাম কতো হতে পারে তা এখনো নিশ্চিত নয়, তবে চীনের জিয়াঝিং শহরে ২০০ ইউয়ান (২৯.৭৫ ডলার/২৫২১টাকা) মূল্যে ভ্যাকসিনটির জরুরি ব্যবহারের ঘোষণা দেয়া হয়। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বায়ো ফার্মা ২ লাখ রুপিয়াহ (১৩.৬০ ডলার/১১৫২টাকা) মূল্যে ভ্যাকসিনটি বিক্রির ঘোষণা দেয়।
এ মূল্যও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের চেয়ে অনেক বেশি, অক্সফোর্ডের প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের দাম পড়বে ৪ ডলার। তবে মডার্নার ভ্যাকসিনের চেয়ে দাম কম সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের। মডার্নার প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের দাম পড়বে ৩৩ ডলার।
২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকের মধ্যেই ৭০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির কথা জানিয়েছে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা।
চীনের অন্যান্য ভ্যাকসিন
জরুরি ব্যবহার অনুমোদনের আওতায় ইতোমধ্যেই চীনের প্রায় ১০ লাখ মানুষকে সিনোফার্মের তৈরি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। সিনোফার্মও এখনো চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করেনি।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের অধ্যাপক ডেল ফিশার সিএনবিসি-কে জানান, "জরুরি ব্যবহার অনুমোদনের আওতায় ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম শুরু আগে তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের ফলাফলে বিশ্লেষণ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই সাধারণ বিষয়।" এধরণের সিদ্ধান্ত নিয়ম বিরোধী এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে এধরণের সিদ্ধান্ত অগ্রহণযোগ্য বলেও জানান তিনি।
- সূত্র: বিবিসি