রহস্যের নতুন দ্বার উন্মোচন করবে পিরামিড!
স্থাপত্যকলার মধ্য দিয়ে মিলবে পৃথিবীর সমূহ বিপর্যয়ের প্রমাণ? উদ্ঘাটন হতে যাচ্ছে মিশরের গ্রেট পিরামিডের ভেতরে পাওয়া বাইবেলের রহস্য? খুব অর্থহীন প্রলাপ মনে হচ্ছে কি? কিন্তু না, ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের কাছে এগুলোই ছিল তিন পৃষ্ঠার এক ঘোরলাগা স্বপ্ন, যা ৮ ডিসেম্বর সকালে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ইউরোতে (প্রায় ৪ কোটি ২৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা) নিলামে বিক্রি করে সোথবি'স।
নিউটন তার মহাকর্ষ তত্ত্বের প্রমাণ খুঁজতে খুঁজতে এমন কিছু পেয়ে গিয়েছিলেন, যাতে মনে করা হতো, প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে রসায়নশাস্ত্রের গোপন প্রণালী রয়েছে। এখনকার দিনে এটি একটি আলাদা জ্ঞানচর্চার ধারা হলেও ১৭ শতকে নিউটনের কাছে তা আলাদা মনে হয়নি। গণমাধ্যম 'অবজারভার'কে এ কথা জানান সোথবি'সের পান্ডুলিপি বিশেষজ্ঞ গ্যাব্রিয়েল হিটন।
১৭২৭ সালে নিউটনের মৃত্যুর পর থেকেই তার রসায়নশাস্ত্র সম্পর্কিত নানা অপ্রকাশিত নোট উদ্ধার করা হয়, যদিও ওই বিজ্ঞানীর সময়ে গির্জার কর্তাব্যক্তিদের কাছে সেসব চিন্তাভাবনা প্রথাবিরোধী হিসেবে গণ্য হতো বলে ধারণা করা হয়।
'দ্য নিউটন পেপারস: দ্য স্ট্রেঞ্জ অ্যান্ড ট্রু ওডিসি অব আইজ্যাক নিউটন' বইয়ের লেখক সারাহ ড্রাই ২০১৪ সালে বলেছিলেন, 'নিউটনের উত্তরসুরিরা এইসব কাগজপত্র খুব কম মানুষকেই দেখিয়েছেন; কারণ এগুলো ছিল তার জীবনের এক অমূল্য গুপ্তধনের মতো। তার এই লেখাগুলো প্রমাণ করে, তিনি কতটা প্রথাবিরোধী বিজ্ঞানী ছিলেন।'
নিউটন ষোল এবং সতের শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী ছিলেন বলে মনে করা হয়। গতিবিদ্যার তিনটি সূত্র আবিষ্কার করা ছাড়াও আধুনিক পদার্থবিদ্যা ,ক্যালকুলাস ও আলো নিয়ে অসংখ্য গবেষণা তিনি করে গেছেন।
অবজারভারের তথ্যানুযায়ী, ধারণা করা হচ্ছে নিউটন পিরামিড নিয়ে তার এই গবেষণা শুরু করেন ১৬৮০ সালের দিকে; সে সময় তিনি লিংকনশায়ারের উলসথর্প মানোরে তার নিজ বাড়িতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন। রবার্ট হুক নামে দ্য রয়্যাল সায়েন্টিফিক ইনস্টিটিউশনের আরেক বিজ্ঞানীর সঙ্গে এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নিয়ে বাকবিতণ্ডার পর তিনি এ নির্বাসন নেন বলে জানা যায়।
তার নোটগুলোর অংশবিশেষ পুড়ে যাওয়া তার প্রিয় কুকুর ডায়মন্ডের কীর্তি বলে বহুল প্রচলিত। ডায়মন্ড তার টেবিলের ধারে খেলতে খেলতে টেবিল উলটে ফেলায় জ্বলন্ত মোমবাতি পড়ে নোটগুলো কিছুটা পুড়ে যায় ।
নিউটন গণিত ও পদার্থবিদ্যায় তার কাজকে রসায়নশাস্ত্র ও ধর্মতত্ত্বের পরে রেখেছেন। আরও কিছু ইউরোপীয় পণ্ডিতের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন, প্রাচীন মিশরীদের মধ্যে থাকা বিশেষ ধরনের জ্ঞান সভ্যতার বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রাচীন অতিপ্রাকৃত বিষয়ের রহস্য সন্ধান ছিল রসায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা নিয়ে নিউটন গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন বলে সোথবি'সের নিলাম তালিকা থেকে জানা যায়।
নিউটন 'কিউবিট' নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। কিউবিট হচ্ছে একটি পরিমাপ পদ্ধতি, যা মিশরীয়রা পিরামিড তৈরিতে ব্যবহার করেছিল। নিউটনের বিশ্বাস ছিল, এটি তাকে অন্য অনেক প্রাচীন স্থাপত্যের সঠিক মাত্রা বুঝতে সাহায্য করবে। বিশেষত তিনি রাজা সলোমনের মন্দিরের মাত্রা বুঝতে চেয়েছিলেন। কারণ তার বিশ্বাস ছিল, সেখানেই বাইবেলের অতিপ্রাকৃত রহস্যের সন্ধান পাওয়া যাবে।
নিউটন তার মাধ্যাকর্ষণ সূত্র বোঝার জন্যও পিরামিড বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, গ্রীকরা পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করতে পেরেছে 'স্টেড' নামক যে পরিমাপ এককের মাধ্যমে, সেটি মিশরীয়দের কাছ থেকেই ধার করা। প্রাচীন পরিমাপ পদ্ধতি আবিষ্কারের মাধ্যমে নিউটন তার নিজের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।
যদিও নিউটনের নানা আবিষ্কার বিজ্ঞানের যাত্রাকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে, কিন্তু নিউটনের নিজের কাছে সেগুলো ছিল তার রসায়নশাস্ত্র ও ধর্মতত্ত্বের চেয়ে খানিকটা কম গুরুত্বপূর্ণ। যদিও পরে নিউটনের বিখ্যাত পরিমাপনবিদ্যা নিয়ে গবেষণার পেছনে এটিই অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল বলে মনে করা হয়।
নিউটনের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস ছিল সে সময়ের প্রথাগত খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং তিনি যিশুখ্রিস্টকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না ভেবে, ঈশ্বর ও মানবতার মধ্যবর্তী একজন হিসেবে ভাবতেন। তিনি বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস করতেন এবং ভবিষ্যতে কী হবে তা বুঝতে চাইতেন।
অবজারভারকে হিটন বলেন, 'নিউটনের এই গবেষণা নোটগুলো সত্যিই এক অসাধারণ ও বিস্ময়কর। কেননা, এর মধ্যে দিয়ে আমরা পিরামিডের রহস্য সন্ধানে তার যে প্রয়াস, সেটি দেখতে পাই। এই কাগজগুলোর মাধ্যমে আমরা নিউটন এবং ক্লাসিক্যাল প্রাচীনত্ব, যা হাজার বছর ধরে মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ,তার একটি মিলন দেখতে পাই। এসব নোট দেখলে তৎক্ষণাৎ আপনার মনে সেসব প্রশ্ন উদয় হবে, যেগুলো নিউটনের মনেও জেগেছিল।'
- সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন