বিষাক্ত রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়াই খালাস হচ্ছে আমদানি হওয়া সামুদ্রিক মাছের চালান
সমুদ্রপথে আমদানি হওয়া হিমায়িত মাছের চালান খালাসের আগে বিষাক্ত রাসায়নিক হেভি মেটাল পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব রাসায়নিক পরীক্ষার উদ্যোগ আমদানিকারকদের চাপে ২ বছর আগে ভেস্তে যায়।
ফলে আমদানি করা হিমায়িত সামুদ্রিক মাছের চালান বর্তমানে বিষাক্ত রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়াই বন্দর থেকে খালাস হচ্ছে। এতে হেভি মেটাল ক্যাডমিয়াম, পারদ, লেড, আর্সেনিক সহ ক্ষতিকর রাসায়নিক মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, এর ফলে ক্যান্সার সহ নানাবিধ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এদিকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে সামুদ্রিক মাছ আমদানির ক্ষেত্রে হেভিমেটাল পরীক্ষার দাবী জানিয়ে বানিজ্য মন্ত্রনালয়ে চিঠি দেয় বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ এসোসিয়েশন। আর্সেনিক ও মার্কারি (এইচজি), লেড, ক্যাডমিয়াম পরীক্ষার শর্ত আরোপ চেয়ে গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি দিলেও রাসায়নিক পরীক্ষায় এখনো কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের সহকারী কমিশনার জাকির হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বর্তমানে আমদানি হওয়া মাছের চালানের নমুনা রেডিয়েশন পরীক্ষার জন্য পরমানু শক্তি কমিশনের পরমানু শক্তি কেন্দ্রে এবং ফরমালিন পরীক্ষার জন্য মৎস পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রন কার্যলয়ে পাঠানো হয়। এই দুই পরীক্ষায় শুধুমাত্র ফরমালিন এবং তেজষ্ক্রিয়তা সহনীয় মাত্রায় আছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়।
চট্টগ্রাম হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, বিষাক্ত রাসায়নিক পরীক্ষা এড়িয়ে আমদানি হওয়া মাছ বাজারজাতকরনের সুযোগ নেই। এতে জনস্বাস্থ্য অরক্ষিত হয়ে যায়। মার্কারি, ক্যাডমিয়াম, লেড সহ হেভিমেটালের কারণে মানবদেহের কিড়নি, ফুসফুস সহ প্রয়োজনীয় অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শরীরে ক্যান্সার সহ নানাবিধ মরনব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে যেখানে জনস্বাস্থ্য এখন মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে এই সময়ে হেভিমেটাল পরীক্ষা ছাড়া হিমায়িত সামুদ্রিক মাছের চালান খালাস করার কারণে জনস্বাস্থ্য গভীর সংকটের মুখে রয়েছে।
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ এসোসিয়েশনের সভাপতি নূরুল কাইয়ুম খান বলেন, সামুদ্রিক মাছ আমদানির ক্ষেত্রে ফরমালিন পরীক্ষায় হেভি মেটাল সহ আর্সেনিক মার্কারি (এইচজি) লিড, ক্যাডমিয়াম ধরা পড়েনা। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সাগর থেকে তেল উত্তোলনের জন্য অনেক রিগ স্থাপন করা হয়েছে। ফলে ওই অঞ্চলে তেল মিশ্রিত পানির জন্য বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে ভেসে উঠে। মধ্যপ্রাচ্যের ওই সকল দেশ থেকেই অধিকাংশ সামুদ্রিক মাছ আমাদের দেশে আমদানি করা হচ্ছে। ফলে ওই সকল দেশ থেকে মাছ আমদানির ক্ষেত্রে মাইক্রোবায়োলোজি পরীক্ষা ছাড়াও মার্কারি (এইচজি) পরীক্ষা করার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে ওমান ও তার পাশ^বর্তী দেশ থেকে মাছ আমদানির ক্ষেত্রে।
২০১৪ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা মাছ পরীক্ষা করে বিষাক্ত উপাদান ধরা পড়ে। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান পাওয়ার পরও এ ধরনের ২২ কনটেইনার মাছ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমদানি করা মাছ বন্দর থেকে খালাসের আগে তার মান পরীক্ষার নির্দেশ দেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা সব মাছের বাধ্যতামুলক পরীক্ষার নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এই দপ্তরের তৎকালীন সদস্য মাহবুব কবির এই নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
এরপর ঢাকা সাইন্স ল্যাব, বিসিএসআইআর, মৎস পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রন ল্যাবে হেভিমেটাল পর পরীক্ষা শুরু হয়। মাছের চালানের তুলনায় ল্যাবের অপ্রতুলনার কারণে বন্দরে হিমায়িত কন্টেইনারের জট তৈরী হয়। এরপর ব্যবসায়ীদের দাবীর মুখে ২০১৯ সালের শুরুতে হেভিমেটাল পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা তুলে নেয় নিরাদপ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক ডঃ সহদেব চন্দ্র সাহা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০১৯ সালের আগে আমদানিকৃত মাছের নমুনায় হেভিমেটাল পরীক্ষা হতো। পণ্য চালান খালাস নিতে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় পরবর্তীতে ফরমালিন এবং তেজষ্ক্রিয়তা পরীক্ষা করে খালাস দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম ফিশ ইন্সপেকশন এন্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিস নিহাও ফুড কোম্পানি লি: এর দুটি চালান এবং নিয়ামত শাহ এন্টারপ্রাইজের একটি চালানে অধিক পরিমানে লিড ও ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ২০২০ সালের শুরুর দিকে ২০ থেকে ২৫ টি কন্টেইনারে ক্ষতিকর রাসায়নিকযুক্ত ধরা পড়েছিল।
এর আগে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা ২২ কনটেইনার হিমায়িত মাছের হেভি মেটাল ও অণুজীব পরীক্ষা করে মাছের ২২টি নমুনার মধ্যে ১২টিতে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাডমিয়াম ও লেডের (হেভি মেটাল) উপস্থিতি পায়। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
চট্টগ্রাম মৎস পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রন কার্যালয় সুত্র জানায়, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর এবং টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে ইয়েমেন, প্যারাগুয়ে, ওমান, কুয়েত, কাতার, চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ভারত থেকে সামুদ্রিক মাছ আমদানি হয়। দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া সমুদ্রিক মাছের তুলনায় আমদানি হওয়ার মাছের মুল্য প্রায় অর্ধেক। এসব মাছ উত্তরবঙ্গের দারিদ্রপীড়িত এলাকায় বেশি বিক্রি হয়।
সামুদ্রিক মাছ আমদানিকারক জে এস ট্রেডিং কোম্পানীর স্বত্বাধিকারী জয়নাল আবেদীন বলেন, হেভিমেটাল পরীক্ষা করতে গিয়ে মাছের চালান দীর্ঘদিন ধরে বন্দরে আটকে থাকতো। ল্যাব সংকটের কারণে সময়মতো পরীক্ষার প্রতিবেদন দিতে পারতোনা কর্তৃপক্ষ। ফলে ২ বছর আগে মাছের চালানে হেভি মেটাল পরীক্ষা বন্ধ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, রাপ্তানিকারক দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে করা হেভিমেটাল টেস্ট প্রতিবেদন দখিল করে চালান খালাস করা হয়।
মৎস পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার মিজানুর রহমান বলেন, কাস্টম কর্তৃপক্ষের চাহিদার ভিত্তিতে আমরা মাছের নমুনায় শুধুমাত্র ফরমালিন পরীক্ষা করি।
চট্টগ্রাম মৎস পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কার্যলয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর এবং টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ২৬,৮৬৭.৬৩ মেট্রিক টন সামুদ্রিক মাছ আমদানি হয়েছে। এর আমদানি মুল্য ১,১৪,৮২,৭৪৬ ইউএস ডলার।
এছাড়া ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৩,৯৯,৯৯,৫৭৬ ইউএস ডলার মূল্যের ৬৮,৭১৩ মেট্রিক টন, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৪,৪৯,২৬,৫১২ ইউএস ডলার মূল্যের ৭৯,৪৮২.৫৯ মেট্রিক টন, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ২,৩৮,৯৭,২৩২ ডলার মূল্যের ৩৯৩৫৫ মেট্রিক টন এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩,১০,৮৫,৮৫৪ ইউএস ডলার মূল্যের ৫৯,৯৩৭ মেট্রিক টন সামুদ্রিক মাছ আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর এবং ১০ ভাগ টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম মৎস পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়।