শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার প্রভাব পড়েছে অন্যান্য খাতেও
লকডাউনের সময় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ছোট-বড় প্রায় সব অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানই পুনরায় খুলতে শুরু করেছে। সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার হারও সন্তোষজনক। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায়, শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিল্প এখনো ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
গত বছরের মার্চ থেকেই স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। অন্যান্য খাতও বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন ধরেই।
জুন থেকে অর্থনীতির নানা খাত পুনরায় চালু হয়ে যায়। তবে এখন পর্যন্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। শেষ ঘোষণা অনুযায়ী, অন্তত আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কথা রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়া ছাড়াও, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার প্রভাব পড়েছে ব্যবসা খাতেও। স্টেশনারি, মুদ্রন, কাগজ, আইস্ক্রিম ও পরিবহন খাতেও এর প্রভাব পড়েছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম ব্যবসা হচ্ছে এখনও এসব খাতে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রীর চাহিদাও নেই। অনলাইনে ক্লাস করতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এরই দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়েছে এসব খাতে।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, মহামারির সময় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আগামী শতাব্দীতে এর প্রভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশ কমে আসতে পারে।
এধরনের বিরূপ প্রভাবের কারণে দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ওপর জোর দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ।
তবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ব্যাপারটিও সহজ নয়। শিশুরা তুলনামূলক কম আক্রান্ত হলেও, তারা ভাইরাসের নিরব সংবাহক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকায় তাদের মাধ্যমে দ্রুতগতিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সতকর্তামূলক ব্যবস্থাসহ উন্নত বিশ্বের বেশ কিছু দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বই, কাগজ ও কলমের বিক্রি অনেক কমে গেছে।
"সরকারি হিসাব অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত দেশে বর্তমানে ৪ দশমিক ৫ কোটি শিক্ষার্থী আছে। তারা বছরে ২০০ দিনও ক্লাস করলে এবং প্রতিদিন অন্তত ৪০ টাকা খরচ করলেও; শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক ব্যবসায়ের বিক্রি হয় প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা।" বলেন তিনি।
ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, "শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ব্যবসায়িক ক্ষতির প্রভাব সহজেই চোখে পড়ছে। তবে জনগোষ্ঠীর যে দক্ষতার অভাব তৈরি হচ্ছে এরফলে, তা আমরা এখনো বুঝতে পারছি না।"
দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে অচিরেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগে স্বাস্থ্যকর্মী, মাতা-পিতা ও শিক্ষকদের সমন্বয়ে জাতীয় কৌশল নির্ধারণ প্রয়োজন বলেও জানান তিনি। শিক্ষকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যাপারে জোর দেন তিনি।
রাজধানীর বেইলি রোডে ভিকারুন্নেসা স্কুল অ্যান্ড কলেজকে কেন্দ্র করে পাশেই স্টেশনারি, লাইব্রেরি, ফটোকপি ও খাবারের দোকানসহ বিভিন্ন ধরনের অন্তত ২০টি দোকান গড়ে উঠেছে। ১০ হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকের কাছে প্রতিদিন অন্তত ১৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হতো এসব দোকানে।
শুধু স্কুলের পাশ্ববর্তী স্থানই নয়, পুরো বেইলি রোড জুড়ে গড়ে ওঠা শপিং মল ও কফিশপও গুলোও ভুগছে গ্রাহক সংকটে।
ভিকারুন্নেসা স্কুলের সামনেই বই, কাগজ, কলমের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের স্টেশনারির দোকান বিদ্যা ভবন। বিদ্যা ভবনের পরিচালক আবিদ হোসেন দ্যা বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "এখনো বেচাবিক্রি ৩০ শতাংশের বেশি স্বাভাবিক হয়নি।" সিদ্ধেশ্বরী ও ভিকারুন্নেসার শিক্ষার্থীদের কাছে প্রতিদিন ৩০-৩৫ হাজার টাকা সামগ্রী বিক্রি করা বিদ্যা ভবনের এখন গড় বিক্রি ৪-৫ হাজার টাকা।
বিদ্যাভবনের মতোই অনিশ্চিত অবস্থায় পড়েছে সারাদেশের প্রায় দুই লাখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কয়েক লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি দোকান ব্যবসায়ী। এসব দোকানে কাগজ, বই, কলম, ল্যাব সামগ্রী, স্টেশনারিসহ শিক্ষা সামগ্রী সরবরাহকারী কয়েক'শ সরবরাহকারীও ভয়াবহ সংকটের মধ্যে দিন পার করছেন। বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণে ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় বই প্রকাশকরাও।
পলিসি রিসার্চ ইনন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, "রিকশা চালক, রাস্তার খাবার বিক্রেতা, হকার, স্টেশনারি বিক্রেতাসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের একটা বড় অংশ স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের ওপর নির্ভরশীল। হিসাবে না আসলেও এসব খাতের অর্থনৈতিক মূল্য অনেক বেশি।"
শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ব্যবসায়িক খাতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে হয়েছে বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
১৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি প্রকাশনা শিল্পে
১৯৯৪ সাল থেকে রাজধানীর মাতুইলে ব্যবসা করছে খন্দকার প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। করোনার আগেই ব্যাংক লোন ও নিজের আগের মূলধন ভেঙ্গে নতুন যন্ত্রপাতি কিনে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সব কাজ বন্ধ থাকায় মার্চ থেকে খন্দাকার প্রিন্টিংয়ের মাসপ্রতি ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৬ লাখ টাকা।
খন্দকার প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক রায়হান খন্দকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এটা আমার পারিবারিক ব্যবসা। আমার স্বপ্ন ছিল, একদিন আমার প্রতিষ্ঠান দেশের সবচেয়ে বড় প্রিন্টিং প্রেস হবে। প্রতি মাসে আট লাখ টাকা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ ও ছয় লাখ টাকা ক্ষতি পুষিয়ে ব্যবসা করা এখন আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"
এ খাতের উদ্যোক্তাদের ভাষ্যমতে, ইতোমধ্যেই মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।
প্রিন্টিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (পিআইএবি) ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির ক্ষতি হয়েছে ৭ হাজার ৫০০- ৮ হাজার কোটি টাকা; বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির ক্ষতি হয়েছে ২০০ কোটিরও বেশি।
ধস নেমেছে কাগজ শিল্পে
স্বাভাবিক সময়ে তিনটি কারখানায় বছরে গড়ে ৩৫-৩৬ হাজার টন কাগজ উৎপাদন করে বসুন্ধরা গ্রুপ। মহামারীর কারণে গত বছরের একটা বড় সময় কারখানা বন্ধ থাকার পর এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশের বেশি উৎপাদনে ফিরতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
বসুন্ধরা পেপার মিলসের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "পাঠ্য বই ছাপাতে অক্টোবর থেকে আমাদের স্বল্প পরিমাণে কাগজ বিক্রি হয়েছে। অফিসে ব্যবহৃত কাগজ বিক্রির পরিমাণও কিছুটা বেড়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি কাগজের চাহিদা না থাকার বড় পরিসরে উৎপাদন শুরু করতে পারিনি এখনো।"
বসুন্ধরা মতোই প্রতিকূল অবস্থায় আছে দেশের ১০০টির বেশি কাগজ কারখানা। ছোট কারখানাগুলো অবস্থা আরও খারাপ।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ) এর তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক ১৫ লাখ টন পেপার উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও ২০২০ সালে ৫-৬ লাখ টনের বেশি ব্যবহার করা যায়নি। উৎপাদনের পরও ১ লাখ টনের বেশি উদ্বৃত্ত রয়েছে বিভিন্ন কারখানার।
বিপিএমএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ৫০ হাজার টন কাগজের চাহিদা থাকলেও করোনার সময়ে তা ১৫ হাজারে নেমে গেছে। আবার কাগজের দাম টন প্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা কমেছে। ফলে গেল বছর এ খাতে অন্তত ৫ হাজার কোটি ক্ষতি হয়েছে।
কলম ও স্টেশনারি উৎপাদকরা গভীর সঙ্কটে
দেশে সবচেয়ে পুরানো ও প্রসিদ্ধ কলম ইকোনো ব্র্যান্ডের উৎপাদনকারী জিকিউ বলপেন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটিডের চলতি অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিক্রি কমেছে ৬৬ শতাংশ।
ম্যাটাডর, প্রাণ- আরএফএল, আইকন, গ্রেট রাইটিংসহ মোট ২০টি প্রতিষ্ঠান ক্যালকুলেটর, স্টেপলার, কলম, পেন্সিল, হাইলাইতার ও ডায়েরিসহ ২০০'র বেশি স্টেশনারি পণ্য উৎপাদন করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার এ বাজারে ৪০ শতাংশও আগের অবস্থায় ফিরে আসেনি।
প্রাণ-আরএফএলের বিপণন পরিচালক মোহাম্মদ কামাল জানান, মহামারীর শুরুতে স্টেশনারি পণ্যের বিক্রি একদমই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
"বিগত মাসগুলোতে অফিস স্টেশনারি পণ্যের বিক্রি কিছুটা বেড়েছে। তবে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি স্টেশনারি পণ্যের বিক্রি এখনও আগের মতোই আছে।" বলেন তিনি।
আইসক্রিম, পানীয় ও হিমায়িত খাদ্যের খাতে প্রভাব
বাংলাদেশের ৩ হাজার কোটি টাকার আইসক্রিমের বাজারের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশ। আইসক্রিমের সবচেয়ে বড় গ্রাহক স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরাই।
মহামারীর শুরুর দিকেই আইসক্রিমের উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, এখন পর্যন্তও এর উৎপাদন ১৫-২০ শতাংশের বেশি বাড়েনি।
সম্প্রতিই ইগলু আইসক্রিমের প্রধান কার্য নির্বাহীর পদ থেকে অব্যাহতি নেয়া কামরুল ইসলাম জানান, মহামারীর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে আইসক্রিম খাতে।
"যদিও মানুষ ক্রমান্বয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় এখনো লোকসানেই আছে আইসক্রিম ও পানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
২০২১ সালের শেষেরদিকে এ খাত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে বলে ধারণা করছেন তিনি।
আইসক্রিম খাতের মতোই, ১০ হাজার কোটি টাকা বাজারের পানীয় খাত ৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে। ক্ষতির মুখে পড়েছে হিমায়িত খাদ্যদ্রব্যের প্রতিষ্ঠানগুলোও। মূলত শিক্ষার্থীরাই এসব পণ্যের সবচেয়ে বড় গ্রাহক।
অন্যান্য খাতে ক্ষতি
পরিবহন খাতেও এর প্রভাব পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রিক্সাচালক ও গাড়িচালকরাও।
শিক্ষার্থীদের যাতায়াত কমে আসায় তাদের আয়ও কমে গেছে।
ক্ষতির মুখে পড়েছেন রাস্তার খাবার বিক্রেতা, ফুল-ফল বিক্রেতা ও হকাররাও।