শত্রু ইরানের কাছে কেনো ধর্না দিচ্ছে সৌদি আরব?
গত মাসের শেষ দিকে সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয় দেশটির শাসন ক্ষমতার নেপথ্য নিয়ন্তা, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ভাষণ। সেখানে নিজ রাষ্ট্র ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি শান্তির বার্তা দেন তিনি। ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির ইচ্ছাও তার আছে, এমন কথাই জানান।
তর্জন-গর্জনের ধারা থেকে এ যেন অনেকটাই পিছিয়ে আসা। অথচ ইরান সমর্থিত হুথিদের সঙ্গেই ইয়েমেনে এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত সৌদি। একারণে দেশটি তেহরানের ওপর ট্রাম্পের আরোপিত অর্থনৈতিক যুদ্ধকে ঘোর সমর্থন দেয়।
মাত্র তিন বছর আগেই পশ্চিমা গণমাধ্যমে এমবিএস খ্যাত যুবরাজ বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি নাকি হিটলারের চেয়েও নিকৃষ্ট। এই বক্তব্যের পর হঠাৎ করেই তার মতি পরিবর্তনের কারণ কী? নাকি এটি কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগেরই অংশ?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরবকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে 'ব্লাঙ্ক চেক' দেওয়া হবে না বলে সতর্ক করেছেন। আবার তিনি ইরানের সাথে ২০১৫ সালে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তিতেও যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরাতে চান। চুক্তিতে ফিরলে মার্কিন সরকারকে ইরানের জব্দ করা জাতীয় সম্পদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ফিরিয়ে দিতে হবে, নগদ অর্থ সংকটে থাকা তেহরানকে যা সাহায্যই করবে।
মার্কিন রাষ্ট্রপতির নয়া বিদেশ নীতির সঙ্গে তাল মেলাতে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক মিত্ররাও এগিয়ে আসছে, সৌদির সমঝোতার চেষ্টাকে সেভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের দূরপ্রাচ্য নীতি বিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো এবং ট্রাম্প আমলে পররাষ্ট্র দপ্তরের সহকারী মন্ত্রী ডেভিড শেনক্যার মনে করেন সৌদিরা বাইডেন প্রশাসনের হাবভাব বুঝে নিতে চাইছে। "সৌদি শাসকেরা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চায় না," বলেন তিনি।
কিন্তু, এটাই একমাত্র ও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা নয়। মার্কিন কূটনীতিকদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি তেল স্থাপনায় মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর, ওই বছরের শেষ দিকেই গোপনে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে সৌদি। তার আগে ট্রাম্পের কাছে ইরানের হামলার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেওয়ার অনুরোধ করেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স। তবে ট্রাম্প তাতে সাড়া দেননি। মূলত, তারপরেই ইরান ও সৌদি আরবের একেবারে নিচের সাড়ির কূটনীতিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়।
২০১৯ ও ২০২১ সালের মধ্যে পার্থক্য দুটি- যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রশাসন এবং সৌদি যুবরাজের প্রকাশ্যে এই কূটনীতি স্বীকার করা।
আমার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০১৯ সালে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর রিয়াদকে নিজ অবস্থানে অনড় থাকার পরামর্শ দেয়। তারপর, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইরাকে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন শীর্ষস্থানীয় ইরানি জেনারেল কাশেম সোলাইমানি। তার কিছুদিন পর মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে নিজ ক্ষমতা প্রদর্শনী করে যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্পের তুলনায় সৌদি রাজতন্ত্রকে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারে বরং উৎসাহই দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। ডেভিড শেনক্যার আমাকে বলেছেন, ২০০০ এর দশকের শেষদিকে আরব রাজতন্ত্রগুলোর তরফ থেকে সিরিয়ার একনায়ক বাশার আল আসাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর যে কূটনীতি দেখা গিয়েছিল, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
২০০৫ সালে লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরিকে হত্যার জন্য সিরিয়াকে দায়ী করা হয়। তারপর ওয়াশিংটনের উৎসাহে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলো দেশটির ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল নেয়। ২০০৭ সালে একটি আঞ্চলিক আরব-ইসরায়েলি শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র। তারপর সৌদি আরবসহ বেশ কিছু আরব রাষ্ট্র সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার নীতি বাদ দিয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে। শুধুমাত্র ২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হলেই কেবল আবার বিচ্ছিন্নতার নীতিতে ফিরে যায় আরব রাষ্ট্রগুলো।
তখনকার মতো এখনও মার্কিন রাষ্ট্রপতির পররাষ্ট্র নীতিই মধ্যপ্রাচ্যের আরব মিত্রদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। কিন্তু, ওই সময়ের সঙ্গে পার্থক্য হলো, যুক্তরাষ্ট্র এখন মধ্যপ্রাচ্যে আগের মতো প্রভাব রাখে না, এই অবস্থায় আরব মিত্ররা তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী 'বন্ধু'কে ছাড়াই নতুন সম্পর্কের নীতি প্রণয়নে ব্যস্ত।
একারণেই, ইসরায়েলের সঙ্গে প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত গোপনে ইরানের সঙ্গেও কূটনৈতিক সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন যদি প্রতিশ্রুতি অনুসারে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সম্পৃক্ততা এবং দায়ভার কমানো শুরু করেন, তাহলে আরব মিত্ররা অসহায় হয়ে পড়বে। তাদের দরকার হবে নতুন অনেক বন্ধু, আর কম সংখ্যক শত্রুর।
ভারসাম্য রক্ষাও হবে চ্যালেঞ্জপূর্ণ। ক্ষুরধার কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমেই কেবল ইসরায়ালের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের ধ্বংসের চেষ্টায় লিপ্ত ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক একইসাথে রক্ষা করতে পারবে আরব আমিরাত।
গত সপ্তাহেই দেওয়া এক বক্তৃতায় ইরানের খামেনি বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্রকে ধবংসের হুমকি দিয়ে এক ভাষণ দেন। ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া আরব দেশগুলোর প্রতি তিনি নিজের টুইটারে করা পোস্টে বলেন, "ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকারী কিছু দুর্বল, দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী কী রক্ষা পাবে?"
আমিরাতের সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তিতে ইসরায়েল পরিষ্কার লাভবান হয়েছে। কিন্তু, এই চুক্তির প্রভাব নির্ভর করবে তেল আবিবের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো আরব দেশগুলোর ওপর। ইরান তোষণ যে দিনশেষে আরব রাজতন্ত্র বিনাশের কারণ হবে, এই সত্য তারা যতো তাড়াতাড়ি উপলদ্ধি করবে ততোই ভালো।
- লেখক: মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ে ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট এলি লেক। তিনি মার্কিন দৈনিক 'ডেইলি বিস্ট' এর জ্যেষ্ঠ জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন টাইমসেও জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা তথ্য বিষয়ক প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত ছিলেন।