ভারতীয় স্বাস্থ্যসেবা নায়কের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ডাক্তারের চিঠি
প্রিয় ভারতীয় স্বাস্থ্যসেবা নায়ক,
আমরা সুশৃঙ্খল, আশাবাদী এবং ইতিবাচক চিন্তাধারার মানুষ। আমরা কোনোকিছুতে সহজেই হার মানি না কিংবা চাপের মুখে পড়ে কোনো কাজ ছেড়ে আসি না।
কিন্তু কোভিড-১৯ এমন একটি পরিস্থিতি যার জন্য আমরা কখনো প্রস্তুত ছিলাম না। এক মিনিট আগেই রোগী নিঃশ্বাস নিচ্ছে, আবার এক মুহূর্ত পরেই সে নিঃশ্বাস নিতে না পেরে হাঁপাচ্ছে। এর চাইতে বাজে খবর একজন ডাক্তারের জন্য আর কিছুই হতে পারে না। আপনি আপনার রোগীকে দেখতে আকুল এবং তারাও আপনার হাসিমুখ দেখতে ইচ্ছুক। কিন্তু ফেসশিল্ড এবং মাস্ক আপনাদের দুজনের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ওষুধপত্রের মধ্যে দিয়ে সামাজিক সব টান বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। আমরা সাদা কোট পরা থেকে ধরে এখন সারা শরীর ঢাকা 'হ্যাজম্যাট স্যুট'-এ চলে গিয়েছি যাতে নিজের দেহকে ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারি.
পুরো পৃথিবী এখন ভয়ে কম্পমান। আপনিও তেমনি, কিন্তু আপনাকে পথ চলতেই হবে। পিপিই এর ভেতরে থেকে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলেও, প্রায়ই আপনার নিজেকে জড়, নিঃসার মনে হবে। শোকাহত মা, সন্তান, ভাইবোন, পিতার কান্নার শব্দে আপনার কান কষ্ট পাবে। আপনি চাইবেন রাতে একটু ঘুমোতে, কিন্তু সেই সব শোকাহত মুখ আপনার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠবে।
করোনার শুরুর দিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যেই দেশটি, সেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেও মহামারীর উপকেন্দ্র কোভিড ওয়ার্ডে আমি আমার রোগীদের মুখ দেখি। এখন ভারতে যা হচ্ছে তা আমাদের খুবই পরিচিত। মৃত্যুর বিভীষিকা আর রোগের ফলে আবেগাক্রান্তের মাত্রা, এই সবই যেন দ্যেজা ভ্যু-এর মত।
আপনি এখন সেই স্থানে দাঁড়িয়ে, যেখানে আমি ছিলাম। সরবরাহ কম, হাসপাতালে বিশৃঙ্খলা, শবদেহ জ্বলছে। সব মিলিয়ে গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেন আপনাকে স্তম্ভিত ও প্রতারিত অনুভব করাবে।
যখন এই উচ্চম্রিত্যুর হার পার হয়ে যাবে, তখন আপনি সামান্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন ঠিকই। কিন্তু এই মুহূর্তে কোভিড-১৯ এর নৃশংসতায় আপনার অন্তরাত্মা কাঁপছে। আপনি করোনাভাইরাস থেকে পালিয়ে বাঁচার যত চেষ্টাই করুন না কেন, পারবেন না। কারণ এর সাথে আপনার একটা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ জড়িয়ে আছে।
যখন মনে হবে যে এই ভয়াবহ বিপদ পার হয়ে গেছে, কিন্তু তা আসলে হয়নি। বিশ্বের নানা প্রান্তে এখনো আরো শক্তিশালী নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যাচ্ছে, যা থেকে সুস্থ হবার উপায় এখনো বের করে সম্ভব হয়নি এবং টিকাদান কার্যক্রমও ঢিলেঢালা। এর ফলে মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রাও বেড়েই চলেছে। সংক্রমনের এই দুষ্টচক্র আমাদের বন্ধ করতেই হবে। এই মুহূর্তে ভ্যাকসিন নেয়াই আমাদের একমাত্র আশার আলো। কিন্তু সেখানেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে পৃথিবী এবং ষড়যন্ত্রের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। ফলে আপনার ভেতরে প্রতিশোধ নেয়ার তীব্রতা আরো বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই লড়াই আপনাকে জিততেই হবেই হবে।
করোনা পরিস্থিতি শেষ হবার পর পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) আপনাকে ভোগাবে, কিন্তু সেই সাথে পোস্ট ট্রমাটিক গ্রোথও আসবে। আপনার মনে হতো, হৃদয় প্রসারিত হতে পারেনা, কিন্তু আসলে তা পারে। যখন কোভিড-১৯ নিয়ে আপনার কিছুই করার নেই, তখন আর বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইই আপনার একমাত্র পথ। আপনি চাইলেও তখন এই রাস্তা ছেড়ে আসতে পারবেন না। আপনার শক্তি একদম ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও আপনি কাজ করতে এগিয়ে আসবেন। বিজ্ঞানকে মানুষের কানে পৌঁছে দিতে আপনি গলার স্বর আরো উঁচু করবেন, যা আগে কখনো মানুষ করেনি। আপনি ভ্যাকসিন চাইবেন এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে এমনভাবে কথা বলবেন যা য়াগে কখনো করেননি। কারণ এখন আপনি সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠেছেন। এখন আপনি ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন মৃত্যুর পরিবর্তে বাকি সবাইকে বাঁচাতে বদ্ধপরিকর। কাজ সবসময়ই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এখন যেন তা বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। এখন শুধুমাত্র আপনিই পারেন আশার আলো ছড়াতে কারণ স্বাস্থ্যসেবা নায়কেরাই এই মুহূর্তে সত্যিকার নায়ক।
এটা এখন একটা নেশার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আপনি চাইবেন ছাড়তে, কিন্তু আপনার ভেতর থেকে কে যেন বলবে আরো কাজ করে যেতে। যেদিন আপনি প্রথম সাদা কোটটা গায়ে চড়িয়েছিলেন, সেই দিনটি ছিল গর্বের দিন। আর এখন সাদা কোট গায়ে থাকুক বা না থাকুক, আপনার কাজ থেমে থাকবে না।
প্রিয় ভারতীয় স্বাস্থ্যসেবা নায়ক, আপনি কাজ চালিয়ে যান। আপনি পারবেন জয়ী হতে, আপনি নিশ্চিত থাকুন যে বিশ্বের সব প্রান্তের সাদা কোট পরিহিত সেনাদল আপনার পাশে আছে। যদি কান্না আসে, সেই অশ্রুজল বয়ে যেতে দিন, হতাশা এলে চিৎকার করুন, কারণ এগুলোই এখন আপনাকে মুক্তি দিবে। কারণ আপনি এমন এক পবিত্র গোষ্ঠীর সদস্য, যারা আগে কখনো একে অন্যের উপর নির্ভর করেনি। কিন্তু এই মহামারী আমাদের এক ছাদের তলায় নিয়ে এসেছে এবং এই ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে আমাদের এক বন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে টিকাদানের ফলেই মহামারী নিয়ন্ত্রণে এসেছে এওং ভারতেও তাই হবে। আমরা জনস্বাস্থ্য রক্ষায় আমাদের আওয়াজ তুলবোই এবং আমাদের কথা না শোনা পর্যন্ত আমরা থামবো না। আমরা থামতে পারবো না, কারণ কোভিড আক্রান্ত মানুষদের জীবন আমাদের উপর নির্ভরশীল। একমাত্র ভ্যাকসিনই পারবে সারা বিশ্বে এই সর্বনাশা জোয়ার থামাতে। জনগণকে অবশ্যই আমাদের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে কারণ আমরাই তাদের বাঁচাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছি। আর এই কারণেই যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এই অঘোষিত যুদ্ধ শেষ না হচ্ছে, আমরা যোদ্ধাদের মত মার্চ করতে করতে এগিয়ে যাবো।
(ডা. আশা শাজাহান যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ডেট্রয়েটের একজন প্রাথমিক চিকিৎসক। সেই সাথে তিনি একজন লেখক, পডকাস্ট হোস্ট, সহকারী অধ্যাপক এবং স্বাস্থ্যসেবামূলক আইনজীবি। তিনি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং সার্জন জেনারেল বিবেক মুর্তির তত্ত্বাবধানস্থ 'কোভিড-কমিউনিটি কর্পস হোয়াইট হাউজ' এবং 'হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস কমিটি'তে কাজ করছেন।)
সূত্র- এনডিটিভি