সবটাই সাজানো? পেশাদার কুস্তিগীরের বয়ান
আমাদের অনেকেই রেসলিংয়ের ভক্ত। দ্য রক, জন সিনা, দ্য আন্ডারটেকার, হাল্ক হোগান, বাতিস্তা, বিগ শো, বাতিস্তা—এই নামগুলো রেসলিংপ্রেমীদের কাছে অতি প্রিয়। টিভির পর্দায় তাদের মারামারি দেখে রোমাঞ্চিত হই আমরা। কিন্তু এই পেশাদার রেসলিংয়ের আসল গল্পটা কি আমরা জানি?
রেসলিং মানে স্রেফ ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে রেসলারদের মারামারি নয়। রেসলিং মানে মনোমুগ্ধকর গল্প, দুঃসাহসী কর্মকাণ্ড, রক্ত হিম করা মুহূর্ত এবং সাংস্কৃতিক জটিলতা।
এ লেখায় রেসলিং সম্পর্কে বহুল উচ্চারিত কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজব আমরা।
এই রেসলিং কি অলিম্পিকের ইভেন্ট?
না, অলিম্পিকে আমরা যে গ্রেকো-রোমান কুস্তি বা মল্লযুদ্ধ দেখি, এই রেসলিং তা নয়। অলিম্পিকের কুস্তিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী একজন আরেকজনকে ম্যাটে ফেলে দিয়ে কাবু করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমাদের আলোচ্য রেসলিং সে রকম নয়।
তাহলে ইউএফসি?
তাহলে কি ইউএফসি, অর্থাৎ আলটিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপকেই রেসলিং বলে? ইউএফসি হলো মিশ্র মার্শাল আর্টস প্রতিযোগিতা। এখানে প্রতিযোগীরা যে যেভাবে পারেন, প্রতিদ্বন্দ্বীকে কুপোকাত করার চেষ্টা করেন। ইউএফসির খেলা অনুষ্ঠিত হয় মিশ্র মার্শাল আর্টসের নিয়মানুসারে।
আমাদের আলোচ্য রেসলিং অনেকটা ইউএফসির মতো হলেও এটি ইউএফসি নয়।
বর্তমান প্রো-রেসলিংয়ের জন্ম 'ক্যাচ রেসলিং' থেকে। গ্রেকো-রোমান কুস্তি ও ইউরোপিয়ান গ্র্যাপলিংয়ের সংমিশ্রণে জন্ম হয়েছিল ক্যাচ রেসলিংয়ের।
এ খেলার উদ্ভাবকেরা বুঝতে পেরেছিলেন বড় তারকা তৈরি করলে এবং ম্যাচের ফল সম্পর্কে ইঙ্গিত দিলে এ খেলা থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানো সম্ভব। আর সে জন্য দরকার সাজানো খেলা আয়োজনের।
তাহলে প্রো-রেসলিং ভুয়া?
না, ঠিক ভুয়া নয়; প্রো-রেসলিং আসলে স্ক্রিপ্ট করা।
কিন্তু স্ক্রিপ্টেড হলেও রেসলিং ১০০ বছর ধরে প্রকৃত প্রতিযোগিতার আবহ ধরে রেখেছে। প্রতিযোগিতার বাইরেও প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে টানটান উত্তেজনার আবহ। সেই উত্তেজনা এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে শো চলাকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী রেসলারদের একসঙ্গে চলাফেরা করা নিষিদ্ধ ছিল।
এ কারণেই ১৯৮৭ সালে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রেসলার হ্যাক-স জিম ডাগান ও আয়রন শাইক এক গাড়িতে ভ্রমণের সময় গ্রেপ্তার হওয়ার পর দারুণ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ড্রাগ রাখার জন্য, 'কেফেব' ভঙ্গের দায়ে নয়।
'কেফেব' কী?
রেসলিংয়ের সময় করা সাজানো কাজকর্মগুলোকে বাস্তব বা সত্য হিসেবে উপস্থাপনের জন্য যেসব কর্মকাণ্ড করা হয়, তা-ই কেফেব।
নিজ চরিত্রের বাইরে সাধারণ বেশভূষায় জনসমক্ষে ঘুরলে কিংবা রেসলিংয়ের ভেতরের কথা নিয়ে কোনো নিবন্ধ লিখলে রেসলিং সম্পর্কে বাইরের মানুষের মোহ বা ভ্রান্ত ধারণা নষ্ট হয়ে যায়। এই মোহ ভেঙে দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ডই কেফেব লঙ্ঘন।
কেনো এই মায়ার জাল?
আয়োজকদের ধারণা ছিল, রেসলিংকে আসল লড়াই ভাবলে জুয়াড়িরা বেশি বেশি টিকেট কিনবেন, আবেগে বেশি করে বাজি ধরবেন। তাঁদের এই পরিকল্পনা অনেকাংশেই সফল হয়।
কিন্তু যত দিন যেতে লাগল, ততই উদ্ভট হতে লাগল রেসলিং-নাটকের চরিত্র ও ঘটনাগুলো। ধীরে ধীরে রেসলিংয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠতে লাগলেন অনেকে। ফলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেসলিং প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড রেসলিং এন্টারটেইনমেন্ট (ডব্লিউডব্লিউই) প্রকাশ্যেই স্বীকার করে নিয়েছে যে রেসলাররা আসলে মঞ্চে গিয়ে চিত্রনাট্য অনুসারে অভিনয় করেন।
তবে এখনো রেসলিংয়ের মারামারিকে আসল বলে বিশ্বাস করেন লাখ লাখ মানুষ।
রেসলিং তাহলে ভুয়া?
'ভুয়া' শব্দটা আসলে ভুল। স্টার ওয়ারস-এর মতো চলচ্চিত্র বা উদারিং হাইটস-এর মতো উপন্যাসকে আমরা ভুয়া বলি না—বলি এগুলো 'কাল্পনিক'।
ঠিক তেমনি রেসলিংয়ের ঘটনাগুলো সাজানো হলেও এতে যেসব কাজকর্ম করা হয়, তা তো বাস্তব। স্টান্ট পারফর্মারদের মতো রেসলাররাও নানা ধরনের ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখান। পরস্পরের সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হন। নিজেদের চরিত্রে ডুবে গিয়ে অভিনয় করেন।
স্টান্ট পারফর্মারদের সঙ্গে পার্থক্য হলো, রেসলাররা এই সাজানো প্রতিযোগিতা সম্পন্ন করেন এক টেকে, সরাসরি দর্শকদের সামনে। রেসলিং আসলে খানিকটা জটিল চিত্রনাট্য এবং খানিকটা রেসলারদের উপস্থিত বুদ্ধির ফসল। এই সবকিছুর সঙ্গে উপস্থিত দর্শকেরা যোগ হয়ে রেসলিং পরিণত হয়েছে এক অনন্য শিল্পে।
সবই তো সাজানো, তাহলে মার খেলেও নিশ্চয় ব্যথা লাগে না?
অভিনয় হলেও ব্যথা লাগে। রেসলাররা যতটা সম্ভব কম ব্যথা দেওয়ার চেষ্টা করেন পরস্পরকে, কিন্তু ব্যথা সম্পূর্ণ এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
ডেন্টিস্ট জানেন কীভাবে দাঁতে গর্ত করতে হয়। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে দাঁতে গর্ত করলে রোগী কোনো ব্যথা পাবে না বা এতে কোনো ঝুঁকি নেই। ঠিক একইভাবে রেসলাররাও জানেন, কীভাবে যতটা সম্ভব নিরাপদে পরস্পরকে মেরে ম্যাটে ফেলতে হবে—কিন্তু মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, সবকিছু ঠিকমতো সম্পন্ন হলে একটা ম্যাচে রেসলারদের ওপর যে শারীরিক ধকল যায়, তা ছোটখাটো একটা গাড়ি দুর্ঘটনার সমান।
তাহলে দর্শকরা রেসলিং দেখে কেন?
কারণ, প্রো-রেসলিং একটি শতাব্দীপ্রাচীন শিল্প। এ শিল্পে প্রাচীন কৌশলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক পপ কালচারের উপাদান। নাটকীয়তা, টানটান উত্তেজনা, ষড়যন্ত্র, কমেডি, সহিংসতার সঙ্গে খেলার আমেজ যুক্ত হয়ে রেসলিং দর্শকদের কাছে হয়ে উঠেছে এক আকর্ষণীয় বিনোদন।
দর্শকদের কাছে রেসলিং এক সুস্বাদু ফ্যান্টাসির নামান্তর। সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা না জেনে উপভোগ্য অস্থিরতায় ভোগেন তাঁরা। প্রিয় তারকার জন্য হাসেন, কাঁদেন। এ কারণেই এর আকর্ষণ এড়াতে পারেন না দর্শকেরা।
- সূত্র: এবিসি নিউজ