আফগানিস্তান যেভাবে চীনকে ২৮ হাজার কোটি ডলারের পাওনাদারের ফাঁদে ফেলেছে
তড়িঘড়ি করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার, শেষ মুহূর্তে নাগরিক ও দূতাবাস কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার তোড়জোড়- এসব যেন ১৯৭৫ সালে সায়গন নগরীর পুনঃদৃশ্যায়ন। সায়গনের জায়গায় এবার শুধু কাবুল। যুক্তরাষ্ট্রের এ পরিণতি যেন চীনের বিশাল জয়, আর আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে বেইজিংয়ের সামনে উপস্থিত সুবর্ণ সুযোগ। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ইংরেজি ভাষার ট্যাবলয়েড গ্লোবাল টাইমসের বিশ্লেষণ, মার্কিন সমর শক্তির ওপর নির্ভর করে যে রক্ষা পাওয়া যাবে না- তাইওয়ানও যেন আফগানিস্তানের ঘটনায় সে শিক্ষা নেয়।
তবে বিস্ময়কর হলেও সত্য, নিজ সীমান্তের কাছে মার্কিন সেনা থাকার চাইতেও খারাপ দশায় পড়বে চীন তারা দেশটি ছেড়ে একেবারে চলে যাওয়ার কারণে। সবমিলিয়ে আফগানিস্তানই আজ বেইজিংয়ের মাথাব্যথার বড় কারণ। আফগান ভূমি থেকে শুধু চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে নয় বরং পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়তে পারে অস্থিতিশীলতা। অথচ দেশটিতে চীনের বিনিয়োগ সুবিশাল।
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং – এর সবচেয়ে সুপরিচিত বৈশ্বিক উদ্যোগ- বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অন্যতম অংশীদার ইসলামাবাদ, যার আওতায় পাকিস্তানে অবকাঠামো তৈরিতে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে চীন, দিয়েছে বড় অঙ্কের ঋণ।
২০১৩ সালে বিআরআই যাত্রা শুরুর পর থেকে মহাসড়ক, বাঁধ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে শত শত কোটি ডলার পেয়েছে পাকিস্তান। চীনা নীতির বাস্তবায়নকারী প্রধান দুটি ব্যাংক- চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না আনুমানিক ২৮২ বিলিয়ন ডলার এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপ জুড়ে বিভিন্ন ঋণ দিয়েছে। প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ এত বেশি যে ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো চীনা ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতি প্রত্যক্ষ করে।
আর চীন ও আফগানিস্তানের প্রতিবেশী পাকিস্তান এসব অবকাঠামো ঋণের বৃহত্তম সুবিধাভোগী হয়েছে। সিপেক বা চায়না- পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে ৬২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। বেইজিংয়ের লক্ষ্য পাকিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ার সাথে ভারত মহাসাগরের নৌবাণিজ্য পথের সংযোগ স্থাপন। যেকারণে পাকিস্তান বিআরই প্রকল্পের মূল সংযোগ স্থলে রূপ নিয়েছে।
কিন্তু, সাম্প্রতিক কালে পাকিস্তানে নিজের সম্পদ (ঋণ ও অবকাঠামো) নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে চীনের। গত ১৪ জুলাই উত্তর পাকিস্তানে বাসে বোমা বিস্ফোরণে ৯ জন চীনা প্রকৌশলী প্রাণ হারান। তারা দাসু জলবিদ্যুৎ বাঁধ প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। প্রকল্পটির মূল বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত- চায়না গেজুবা গ্রুপ কোং। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চালিতে প্রকল্পটি সিপেকের আওতাভুক্ত নয়। তবে এর আগে গত এপ্রিলে পাকিস্তানী তালেবান একটি হোটেলের বাইরে আত্মঘাতী বোমা হামলা করে, ওই সময় সেখানে চীনা রাষ্ট্রদূত অবস্থান করছিলেন।
দাসু হামলার এক মাস পর গত সপ্তাহে আফগান সীমান্তের ওপাড়ে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানী তালেবানকে দায়ী করেছে ইসলামাবাদ। অর্থাৎ, এবার আফগান ভূমিকে সন্ত্রাসবাদী হামলায় ব্যবহারের অভিযোগ আনা হলো।
চীন এপর্যন্ত ঘটনাবলী নিয়ে কূটনৈতিক কৌশলে মন্তব্য করছে। গত মাসে তালেবানের সঙ্গে দাসু হামলার সংযোগ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে; চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাল্টা প্রশ্ন রাখে- কোন তালেবান? এমন তির্যক অবস্থানের প্রধান কারণ, আফগান তালেবানকে 'একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি' বলে স্বীকৃতি দিয়েছে বেইজিং, অন্যদিকে পাকিস্তানী তালেবানকে 'সন্ত্রাসী গোষ্ঠী' হিসেবে দেখে।
তাছাড়া, জুলাইয়ের শেষদিকে চীন সফরে যান আফগান তালেবানের একটি প্রতিনিধি দল। আফগান ভূমিকে চীনা স্বার্থে আঘাত হানার কাজে ব্যবহার করা হবে না- তাদের থেকে এমন প্রতিশ্রুতি আদায়ে সক্ষম হয় বেইজিং।
আফগানিস্তানের নতুন শাসকদের নিয়ে চীন কতোটা বিচলিত প্রতিশ্রুতি আদায়ের ঘটনা তা প্রমাণ করে। আফগানিস্তানে ব্যাপক বিনিয়োগ না করলেও, চীন পাকিস্তানে অস্থিতিশীলিতার ভার বহন করতে পারবে না। তাছাড়া, ছয় বছর আগে ভেনিজুয়েলায় পাওনাদারের ফাঁদে পা দিয়ে যে ক্ষতি হয়েছিল, গণচীনের নীতিনির্ধারকদের মন থেকে সে স্মৃতি আজো মুছে যায়নি। তারা জানেন, আরেকটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের ওপর বাজি ধরলে এবার চীনের বিআরআই স্বপ্নের হৃৎপিণ্ডই ছিন্ন হবে।
পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, এককালে ভেনিজুয়েলা ছিল চীনের বিদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে পছন্দনীয় গন্তব্য। জ্বালানি তেল উত্তোলনের অধিকার চীনা কোম্পানি পাবে আর তার বদলে ঋণ পাবে কারাকাস; এমন ব্যবস্থার অধীনে দেশটির খনিজ তেলের মজুদ ঋণ জামানতের জন্য যথেষ্ট হবে বলে ভেবেছিল বেইজিং। তাই প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর প্রথম মেয়াদ অর্থাৎ ২০১৩ সাল নাগাদ মোট চার হাজার কোটি ডলার ঋণ দেয়, যার ৩ হাজার কোটি ডলার আজো অনাদায়ী রয়ে গেছে।
হিসাবের বড় গড়মিল ছিল এ ঘটনা। কারণ, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক কাঁচামাল পণ্য বা কমোডিটির দরপতন শুরু হয়। জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক ব্রেন্ট ক্রুড সূচক ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার থেকে দর হারিয়ে অর্ধেক দামে নেমে আসে। এই সঙ্কট মোকাবিলায় ও তেল উৎপাদন বাড়াতে ভেনিজুয়েলাকে নতুন করে আরও ৯০০ কোটি ডলার ঋণ দিতে বাধ্য হয় বেইজিং। এই ঋণেরও বড় অংশ আজো চীন পায়নি। গেল বছর ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধে ভেনিজুয়েলা সরকারকে গ্রেস পিরিয়ড দেওয়ার কথাও শোনা যায়।
পাওনাদারের ওই ফাঁদই ধস নামিয়েছে আত্মবিশ্বাসে। ২০১৩ সালের পর চীনের সরকারি নীতি বাস্তবায়নকারী ব্যাংকগুলোও আর ভেনিজুয়েলাকে নতুন ঋণ দেয়নি। তাছাড়া, ভেনিজুয়েলাকে ঋণ শোধের বর্ধিত সময়সীমা দেওয়ার কিছু সময় পর ২০১৬ সালে ভিনদেশে তাদের দেওয়া উন্নয়ন ঋণও সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। অর্থাৎ, এরপর তারা বুঝেশুনে ঋণছাড় ও ব্যবস্থাপনা শুরু করেছে। এরপর, পাকিস্তানেও ব্যর্থ হলে প্রশ্নের মুখে পড়বে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের জাতি-গঠনের মডেল।
বেইজিং যেভাবে ঋণ দেয় মূলত সেই পথ ধরেই তার সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। বিশ্বব্যাংক রিস্ক প্রিমিয়াম এবং পরিশোধের নির্ধারিত হারের মতো প্রতিষ্ঠিত সূচকের ভিত্তিতে ঋণ দিলেও, চীন দেয় অনেকটা সহজাত প্রবৃত্তি বা অনুমানের ভিত্তিতে। কোন দেশের দেনা-পাওনার ইতিহাসের দিকে না তাকিয়ে অবকাঠামো ও অন্যান্য খাতে যথেষ্ট বিনিয়োগ পেলে দেশটি কতখানি সমৃদ্ধশালী হতে পারে- সেই অনুমান করে ঋণ দেয় বেইজিং। যাকে স্পষ্টত- 'গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেলের নীতি' বলা যায়।
বিআরআই নিয়ে ব্যর্থ হলে নিজ দেশের মধ্যেই জন-অসন্তোষের মুখে পড়বে চীনের শাসকগোষ্ঠী। বিদেশে বেইজিংয়ের অপরিমিত খরচ থেকে যথেষ্ট প্রাপ্তি না আসলে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ সামাল দেওয়াও সহজ হবে না। কারণ, সরকারি নীতি বাস্তবায়নকারী ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাৎসরিক প্রণোদনা দিয়ে স্থানীয় ব্যবসাগুলোকে সাহায্য করা, বিদেশী ব্যর্থ রাষ্ট্রকে সহায়তা করা নয়।
এমন ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইতোমধ্যেই তার বৈশ্বিক সমতুল্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কম-মূলধনে চালিত হচ্ছে। তাই প্রশ্ন উঠবেই, কেন চীনের ব্যাংকগুলো দুর্দশাগ্রস্ত জাতির উত্তরণে ব্যতিব্যস্ত? আর বেইজিং যতই সহযোগিতা করুক, পাকিস্তান আজো তলাবিহীন ঝুড়ির কাতার থেকে মুক্তি পায়নি। শুধুমাত্র গত ৩০ বছরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ১৩টি দেওলিয়াত্ব প্যাকেজের অধীনে ঋণ নিয়েছে ইসলামাবাদ।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চটজলদি বিদায় নিঃসন্দেহে বিশ্বজুড়ে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের গ্লানি চীনের বিজয় নয়। এক পরাশক্তি চাইছে তার সেনারা ফিরে আসুক। কিন্তু আরেকজন কী চাইছে? চীন শুধু চায় বিনিয়োগ থেকে ইতিবাচক মুনাফা হার, যা দিয়ে নয়া সিল্ক রোড প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে যৌক্তিক ভাবে উপস্থাপন করা যাবে।
- লেখক: শুলি রেন এশীয় বাজার বিষয়ক ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট। ইতঃপূর্বে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি অর্থনৈতিক গণমাধ্যমে ব্যারনস- এ বাজার বিষয়ক নিবন্ধ লিখতেন। তার আগে বিনিয়োগ ব্যাংকার হিসেবেও কাজ করেছেন।