'পুলিশ-র্যাব চলে যাবে, তারপর কী হবে?'
আগুনে পুড়ে ঘরবাড়ি ও টাকাপয়সা হারানো রংপুরের পীরগঞ্জের করিমপুর কসবা জেলেপাড়ার মানুষগুলো এখনও শোকে মুহ্যমান। এই মানুষগুলোর চোখের সামনে, এক নিমেষে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে তাদের বসতবাড়ি, আসবাবপত্র ও গবাদিপশু।
ক্ষতিগ্রস্তদের একজন গৃহবধূ সুমিতি রানি রায় আহাজারি করে জানান, এখনও আতঙ্ক আর ভয়ে দিন কাটছে তাদের। ভাঙচুর হওয়া ও আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরের টিনসহ আসবাবপত্র লন্ডভন্ড হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। কিভাবে কী করবেন জানা নেই। তিনদিন হয়ে গেলেও আতঙ্ক তাদের ছেড়ে যাচ্ছে না- কয়েকদিন পর পুলিশ চলে গেলে আবারো যদি হামলা হয়, আবারও যদি একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হয়!
সুমিতি তাই গ্রামের হিন্দু বাড়িগুলোর জন্য স্থায়ী পুলিশি পাহারা চান।
সুমিতি আরো জানান, কয়েকদিন আগেই নিজের জন্য নতুন জামা ও শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য কাপড় কিনে এনেছিলেন মার্কেট থেকে। রোববার রাতের আগুনে পুড়ে গেছে ওই কাপড়, সাথে টাকা-গহনা, আসবাবপত্র সবকিছুই। ঘরের টিন পুড়ে প্রায় ছাই। ত্রাণে পেট চলছে, আকাশের নিচে।
স্থানীয় রনজিত রায় বলেন, সেদিনের ঘটনার ভয়ে আতঙ্কে এখনো অনেকে বাড়িতে ফেরেনি। পালিয়ে গেছে অন্য এলাকায়।
প্রতিবেশি শুভ রায় বলেন, ঘটনার দিন সারাদিন কাজ করে ৫০০ টাকা নিয়ে বাসায় ফিরেছিলেন। ঘরে জমানো ছিল আরো ২৫ হাজার টাকা। স্ত্রীর দুই ভরি গহনা ও আসবাবপত্র, ১৫ কেজি চাল- দুর্বৃত্তদের হামলায় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব। ভয়াল রাতের কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
সুমিতি রানি, শুভ রায়ের মতো আরেকজন ক্ষতিগ্রস্ত গৃহবধূ মায়া রানি জানান, পুলিশ এই স্থান থেকে চলে গেলে আবারও হামলার আশংকা করছেন তারা। মানুষের বাড়িবাড়ি কাজ করে দুই সন্তান ও বয়োঃবৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে খাওয়ান। গত তিনদিন আগে সন্ত্রাসীদের হামলা ও লুটপাট, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই ঘরে। কিছুটা অনুদান পেয়ে পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে আছেন লন্ডভন্ড হওয়া বাড়িতে।
মধ্যবয়সী ভুট্টো চন্দ্র রায় বলেন, ঐদিনের আতঙ্ক কাটেনি তার এখনোও। হঠাৎ করে হাজারো মানুষ, লাঠিসোটা হাতে তার বাড়িতে ঢুকে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তার বসতবাড়ি, ঘরে রাখা জমানো টাকা, বউয়ের গহনা, আসবাবপত্র। পালিয়ে গিয়ে ধানক্ষেতে আশ্রয় নিয়ে জীবন রক্ষা করেছেন। কিন্তু তারও আতঙ্কিত মনে প্রশ্ন, এলাকা থেকে পুলিশ ও র্যাব চলে গেলে আবারও হামলা হলে কে বাঁচাবে!
সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় ১৩৫টি ঘরে হামলা-ভাঙচুর এবং ১৮টি ঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। খোলা আকাশের নিচে, খেয়ে না খেয়ে এখনও আতঙ্কের মধ্যেই আছে এই হিন্দু পরিবারগুলো। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, কোটি টাকার উপরে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাদের। এই ক্ষতি অনেক বছরেও তারা কাটিয়ে উঠতে পারবেন না।
অন্যদিকে সেদিনের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৪৯ জনকে আদালতে নেওয়া হলে তাদের জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।
ঘটনার দিন থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় সংসদের স্পিকার ও তথ্যমন্ত্রী-পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসকসহ সাবেক তথ্যমন্ত্রী, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের সাহায্য-সহযোগিতা করছেন।
রংপুর জেলা প্রশাসক আসিফ আহসান জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ঘর করার জন্য নগদ অর্থ, টিন ও চাল-ডাল, কাপড়সহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে।
রংপুর পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, যাদের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তাদের আইনগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। যারা এ ঘটনার সাথে জড়িত তাদেরকে খুঁজে খুঁজে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ভয়ের কারণ নেই। ওই এলাকায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির টহল চলছে।