একটি মোবাইলের প্রচারণা থেকে যেভাবে জন্ম নিল উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের স্টুডিও
২০০৭ সাল। গান শোনার জন্য নতুন একটি মোবাইল সেট বাজারে আনতে যাচ্ছে নকিয়া। এই সেটের বিশেষত্ব হচ্ছে, এখানে স্ক্রিনের পাশেই থাকবে গান থামানোর, পরের ও আগের গানে যাওয়ার বাটন।
এই সেটের প্রচারণা চালানোর জন্য কোমল পানীয় কোম্পানি কোকা-কোলার সঙ্গে চুক্তি করে নোকিয়া। এদিকে কোকা-কোলাও তখন সবে ডায়েট কোককে বাজারে এনেছে। তারা সুযোগ দেখে নতুন 'কোকা-কোলা জিরো'র প্রচারণা চালানোর।
প্রচারণার জন্য একটি উদ্ভাবনী পরিকল্পনা নিয়ে আসে কোকা-কোলা ব্রাজিল। তারা সিদ্ধান্ত নেয় বিভিন্ন গানের মিশ্রণে নিজস্ব স্টুডিওতে একটি লাইভ কনসার্ট করার। এই প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয়, 'কোকা কোলা জিরো স্টুডিও'।
ব্রাজিলে এককালীন প্রচারণার নাম করে শুরু হয়েছিল যে প্রকল্প, তা আলো ছড়ায় হাজার মাইল দূরে ভারতীয় উপমহাদেশে। সূচনার ১৫ বছর পর, এবছর বাংলাদেশেও অভিষেক ঘটতে যাচ্ছে কোক স্টুডিওর।
এই ১৫ বছরে পাকিস্তান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সংগীতাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে কোক স্টুডিও, সংগীতবোদ্ধাদের উপহার দিয়েছে অসংখ্য অভিনব ধারার গান।
কোক, পেপসি বা এরকম কোনো ব্র্যান্ডের প্রচারণামূলক কনসার্টের দৃষ্টান্ত কিন্তু নতুন না। প্রতিবছরই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শত শত প্রচারণামূলক কনসার্ট বা গানের আসর করে থাকে বিভিন্ন ব্র্যান্ড। কিন্তু এদের কোনোটিই কোক স্টুডিওর মতো খ্যাতি অর্জন করতে পারেনি, এবং পারবেও না।
চলুন জেনে নেওয়া যাক কোক স্টুডিওর জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছার গল্প-
ব্রাজিল থেকে পাকিস্তান: মূল কোক স্টুডিওর সূত্রপাত
কোকা-কোলা ব্রাজিলের তৎকালীন মার্কেটিং নির্বাহী লুসিয়ানা ফেরেস বলেছিলেন, "নকিয়া এবং কোকা-কোলা জিরো, এই দুই ব্র্যান্ডের সম্মিলিত শক্তি আমাদের সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এবং এই দুই ব্র্যান্ডের মিশ্রণ আমাদের এমন কিছু উপহার দিয়েছে যা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া কঠিন।"
এই ব্র্যান্ডের মিশ্রণ থেকেই গান মিশ্রণের চিন্তা এসেছিল কি না, তা জানা যায়নি। তবে কোক-স্টুডিওর সাফল্যের পিছনে মূল শব্দ এটিই- 'মিশ্রণ' (বা ফিউশন)।
২০০৭ সালে দুই ব্রাজিলিয়ান শিল্পীকে কোক জিরো স্টুডিওর পুরো সেশন পরিচালনার দায়িত্ব দেয় কোকা-কোলা কোম্পানি। নিজেদের গান ও গানের ধারাকে মিশিয়ে অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করেন তারা। ব্রাজিলে নকিয়া ৫৩১০ ফোনে আগে থেকেই লোড করে দেওয়া হয় এ গানগুলো।
ব্রাজিলে সাফল্য পাওয়ার পরের বছর, ২০০৮ সালে পাকিস্তানে একইরকম পরিকল্পনা নিয়ে ঘাটি বাধে কোকা-কোলা কোম্পানি। এখানে অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হয় নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় পাকিস্তানি ব্যান্ড 'ভাইটাল সাইনস'-এর সদস্য রোহেল হায়াতকে।
রোহেল এই ফিউশনের ধারনাকে নতুন রূপ দেন। ভাষা, সংস্কৃতি ও আরও নানা কারণে পাকিস্তানের সংগীতাঙ্গন এমনিতেই অনেক বিস্তৃত। গানের এই বিস্তৃত ভাণ্ডারকে ব্যবহার করতে শুরু করেন তিনি।
বিভিন্ন ঘরানার গানের মিশ্রণ ঘটান; পুরনো ঘরানার গানকে মেশান আধুনিক গানের সঙ্গে, দুটি ভিন্ন ভাষার গানকে একসাথে মেশান, প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকসঙ্গীত শিল্পীদের বসান সুপারস্টার গায়কদের পাশে।
রোহেলের কম্পোজিশন একেকটি ফিউশনকে নতুন গানের মর্যাদা দিতে শুরু করে। নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করে প্রান্তিক ও হারিয়ে যাওয়া গানগুলোর সঙ্গে। নতুন ক্লাসিকের জন্ম দেওয়ার পাশাপাশি পুরনো ক্লাসিকগুলোকেও দেওয়া শুরু করে নতুন রূপ।
পুরো জাতির কণ্ঠস্বর
ধীরে ধীরে ক্লাসিক্যাল, ফোক, সুফি, কাওয়ালি, ভাংড়া, হিপ হপ, রক, পপ; সব ধরনের গানের আস্তানা হয়ে উঠে কোক স্টুডিও। তাদের ট্যাগলাইনই হয়ে যায়, 'সাউন্ড অব দ্য ন্যাশন (জাতির কণ্ঠস্বর)।
২০১০ সালে পাকিস্তানের বিখ্যাত লোকসঙ্গীত গায়ক আরিফ লোহারের ডাক পড়ে কোক স্টুডিওতে। তরুণ গায়িকা মেশা শাফির সঙ্গে মিলে তিনি তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর একটি রেকর্ড করেন স্টুডিওতে।
'আলিফ আল্লাহ, জুঙ্গি' নামের এই গানকে বলা হয় কোক স্টুডিওর প্রথম সুপারহিট গান। মুক্তি পাওয়ার পর দ্রুত কোকা-কোলার ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইউটিউব ভিডিও হয়ে উঠে এটি। এই গানের বর্তমান ভিউসংখ্যা ৭৬ লাখেরও বেশি।
কোক স্টুডিওর প্রায় সব বিখ্যাত গানই কোনো না কোনো কিছুর মিশ্রণ। বলিউড মাতানো গায়ক আতিফ আসলাম ১৯৮২ সালের এক কাওয়ালিকে নতুন রূপ দেন। তার দরাজ গলা ও জনপ্রিয় স্থানীয় ব্যান্ড স্ট্রিংসের কম্পোজিশনকে এক করে ২০১৫ সালে কোক স্টুডিও তৈরি এক নয়া ক্লাসিক, 'তাজদার-ই-হারাম'। বর্তমানে এই গানের ইউটিউব ভিউসংখ্যা ৩০ কোটিরও বেশি।
কোক স্টুডিওর ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান 'আফ্রি আফ্রি'-ও একটি পুরনো ক্লাসিকের নবরূপ। নুসরাত ফাতেহ আলী খানের ১৯৯৬ সালের গানটিকে আবার জনসম্মুখে আনেন তার ভাই, রাহাত ফাতেহ আলী খান। প্রাথমিক কম্পোজিশনকে বদলে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেলে এই গানে নতুন উষ্ণতা ছড়িয়ে দেন রাহাত ও তরুণ গায়িকা মমিনা মুহতাসিন।
পাঞ্জাবি, পশতুন, আফগান গানের সঙ্গে কোক স্টুডিওতে জায়গা পেয়েছে কাশ্মীরী গানও। এমনকি, পাকিস্তানি কোক স্টুডিওতে রেকর্ড করা হয়েছে একটি বাংলা গানও। ২০১৬ সালে ভাটিয়ালি গান 'আমায় ভাসাইলি রে'-তে সুর দেন পাকিস্তানের পপ-সম্রাট হিসেবে খ্যাত, বর্ষীয়ান গায়ক আলমগীর হক। বর্তমানে এই গানের ভিউসংখ্যা প্রায় দুই কোটি।
ভারতে এমটিভির সঙ্গে যুগ্ম-প্রয়াস
পাকিস্তানের পর ২০১১ সালে ভারতেও আস্তানা গাড়ে কোক স্টুডিও। ভারতের জনপ্রিয় গানের স্টুডিও এমটিভির সঙ্গে জুটি বাঁধে তারা।
২০১১ সালের প্রথম এমটিভি-কোক স্টুডিও সিজন পরিচালনা করেন লেসলি লুইস। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রধান দুই ধারা, হিন্দুস্তানি এবং কর্ণাটক সঙ্গীতকে আবার জনসম্মুখে আনার পাশাপাশি কোক স্টুডিও ভারতের লোকসংগীতের বৈচিত্র্যকেও কাজে লাগাতে শুরু করে।
ভারতে এখন পর্যন্ত মোট চারটি টিভি সিজন রেকর্ড করা হয়েছে কোক স্টুডিওতে। এই চার মৌসুমে কোক স্টুডিওতে গান পরিচালনা করেছেন ও গেয়েছেন এ আর রহমান, সনু কাক্কার, ভিশাল দাদলানি, শান ও অনুপম রায়ের মতো বিখ্যাত সংগীতজ্ঞরা।
ভারতে মূলধারার সব গানের সূত্রপাত হয় বলিউড থেকেই। কোক স্টুডিও বলিউডকে দূরে সরিয়ে একটি বিকল্প ধারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।
তবে, বলিউডের জনপ্রিয়তার কাছেই শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয় কোক স্টুডিওর। ২০১১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত চারটি টিভি মৌসুম উপহার দিয়ে বন্ধ হয়ে যায় কোক স্টুডিও ইন্ডিয়া।
তবে সুসংবাদ হচ্ছে, এবার বাংলাদেশেও পা রাখছে কোক স্টুডিও। ডেইলি স্টারসহ একাধিক সংবাদপত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে প্রথম মৌসুমের দৃশ্যধারণ শুরু করে দিয়েছে স্টুডিওটি। ঢাকায় কোকা-কোলা কোম্পানির সঙ্গে এই প্রকল্প সমন্বয় করছে গ্রে বাংলাদেশ।
ইতোমধ্যে বাপ্পা মজুমদার, সায়ান চৌধুরী অর্ণব, মমতাজ, পান্থ কানাই, কনাসহ জনপ্রিয় অনেক সংগীতশিল্পী অংশ নিয়েছেন রেকর্ডিংয়ে।