সাধারণ থেকে বিলাসবহুল বাসস্থান: ধনীরা সব রকমের সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন বাড়ির পেছনে ছুটছে
দেশে অত্যাধুনিক উপকরণ ও প্রযুক্তিতে নির্মিত সব রকমের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ব্যয়বহুল অ্যাপার্টমেন্টে বিনিয়োগ বাড়ছে। গত এক দশকে এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ধনী ব্যবসায়ী, প্রবাসী, রাজনীতিবিদ এবং আমলারা রাজধানীতে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের প্রধান ক্রেতা; তারা পরিবেশগত ভারসাম্য ও প্রচুর খোলা জায়গা রয়েছে এমন অনন্য (এক্সক্লুসিভ) আরামদায়ক আবাসিক জায়গা খোঁজেন।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) তথ্যমতে, এ খাতে ২০১৫ সালে ৮ হাজার কোটি, ২০১৬ সালে ১০ হাজার কোটি, ২০১৭ সালে সাড়ে ১০ হাজার কোটি, ২০১৮ সালে ১১ হাজার কোটি, ২০১৯ সালে ১২ হাজার কোটি এবং ২০২০ সালেও ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আসে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) পরিচালক নাইমুল হাসান বলেন, "গত ১০ বছরে আবাসন খাতে বছরে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে বিলাসবহুল আবাসন খাতে বছরে প্রায় ১০ শতাংশ বা ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।"
"তবে গত বছর আবাসন খাতে বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। সেই অনুপাতে, বিলাসবহুল আবাসনেও বিনিয়োগ বেড়েছে"- যোগ করেন তিনি।
বিআইপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলছেন, "২০০০ সালের আগে, দু-একটি কোম্পানি ছাড়া দেশে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবসা এতটা বাড়েনি। ২০০৫ সাল থেকে বেশ কয়েকটি হাউজিং কোম্পানি মানুষের চাহিদাটা অনুধাবন করে। এখন অনেক কোম্পানি এই ধরনের ব্যবসা করছে।"
ধনীদের এক্সক্লুসিভ অ্যাপার্টমেন্ট:
দেশের অন্যতম বিলাসবহুল হাউজিং কোম্পানি- সাউথ ব্রিজ হাউজিং লিমিটেডের রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-২ এর ৩৬ নম্বর রোডে কিছু এক্সক্লুসিভ অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। তাদের প্রজেক্ট সাউথ লিফের অ্যাপার্টমেন্টগুলি অত্যাধুনিক উপকরণ, প্রযুক্তি আর ডিজাইনে নির্মিত।
এসব অ্যাপার্টমেন্টে দিনের বেলা বৈদ্যুতিক আলোর প্রয়োজন হয় না। প্রাকৃতিক আলো-বাতাস আসার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টের প্রশস্ত বারান্দায় বিভিন্ন গাছ লাগিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে সবুজের সমারোহ। ছাদে আছে বিশাল সুইমিং পুল। রয়েছে শিশুদের খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার এবং হাঁটার জায়গার সুবিধা। কোম্পানিটি নির্মাণসামগ্রী হিসেবে বিভিন্ন দামি পাথর, কংক্রিট, ইট ও কাঠ ব্যবহার করেছে।
৩,৭২০ বর্গফুট এবং ৪,৩৬০ বর্গফুট আয়তনের অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে এখানে। এই প্রকল্পের ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্টের আয়তন ৭,৪৪০ বর্গফুট।
সম্প্রতি এই প্রকল্পে ১২ কোটি টাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন এক ব্যবসায়ী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমি বেশিরভাগ সময় ব্যবসার জন্য বিদেশে থাকি। ঢাকায় ভালো পরিবেশ পাইনি। কিন্তু সাউথ লিফ প্রজেক্ট সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।"
"এই অ্যাপার্টমেন্টে পরিবেশগত ভারসাম্য একেবারে নিখুঁত। আপনি অন্য কোন আবাসন প্রকল্পে যা খুঁজে পাবেন না"- মন্তব্য করেন তিনি। অ্যাপার্টমেন্টের উচ্চমূল্যের বিষয়ে বলেন, "টাকা কোনো সমস্যা নয়। আসল ব্যাপারটা হল- থাকার জন্য উপযুক্ত জায়গা। সেটাই আমি এখানে পেয়েছি।"
রাজধানীতে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট এবং বাণিজ্যিক স্থান নির্মাণের অগ্রপথিক- সাউথ ব্রিজ হাউজিং লিমিটেড ১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু করে। কোম্পানিটি এপর্যন্ত রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি এবং মিরপুর এলাকায় ৩০টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প সম্পন্ন করেছে। চলমান রয়েছে আরও ১১টি প্রকল্প।
নাম না প্রকাশের শর্তে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা বলেন, "সাউথ লিফ প্রকল্পের ৩ হাজার ৭২০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টের দাম ১২ কোটি টাকা এবং ৪ হাজার ৩৬০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টের দাম ১৬ কোটি টাকা। তবে এখানে ৭ হাজার ৪৪০ বর্গফুটের ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্টের দাম ২৪ কোটি টাকা।"
ওই কর্মকর্তা জানান, কোম্পানিটি অভিজাত আবাসন খাতে এপর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
সাউথ ব্রিজ ছাড়াও রাজধানীর আরও অন্তত ২০টি হাউজিং কোম্পানি এ ধরনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করছে। তাদের মধ্যে একটি হল শান্তা হোল্ডিংস- তারা রাজধানীতে সবচেয়ে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করেছে।
কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, শান্তা হোল্ডিংস ২০০৫ সালে অভিজাত হাউজিং ব্যবসা শুরু করে। এপর্যন্ত কোম্পানিটি গ্রাহকদের কাছে ৩৬টি প্রকল্প হস্তান্তর করেছে। চলমান রয়েছে আরও ২৪টি প্রকল্পের কাজ। কোম্পানিটি আরও ১৮টি নতুন প্রকল্পও শুরু করতে চলেছে। এ ব্যবসায় শান্তা হোল্ডিংসের বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।
রাজধানীতে ব্যয়বহুল অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণে জড়িত অন্যান্য সংস্থার মধ্যে: বিল্ডিং টেকনোলজিস অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেড, কনকর্ড রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, নাভানা রিয়েল এস্টেট, শেলটেক, নকশি হোমস লিমিটেড, সানমার প্রপার্টিজ, র্যাংগস প্রপার্টিজ, অ্যাসিউর গ্রুপ, এবিসি রিয়েল এস্টেট, আর্টিসান রিয়েল এস্টেট, ডোম-ইনো, অ্যালায়েন্স প্রপার্টিজ, এপিক প্রপার্টিজ, এডিসন রিয়েল এস্টেট, রিজেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অন্যতম।
বিলাসবহুল আবাসিক সম্পত্তির ক্রেতা:
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, গুলশান-১ এ র্যাংগস প্রপার্টিজ লিমিটেডের র্যাংগস ওয়াটারফ্রন্ট প্রকল্পে ১৬ কোটি টাকায় ৩,৫০০ বর্গফুটের একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, "পৈত্রিক উত্তরাধিকার সূত্রে যে দুটি বাড়ি পেয়েছি- সেখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নেই। অন্যদিকে, একটি মানসম্পন্ন বাড়ি তৈরি করা খুবই ব্যয়বহুল। এই কারণেই আমি এ প্রকল্প অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছি; যা আমার ইচ্ছা পূরণ করবে।"
র্যাংগস প্রপার্টিজ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার ও হেড অব সেলস অমলেন্দু বিশ্বাস বলেন, "আমরা গত কয়েক বছরে গুলশান ১ ও ২ এলাকায় ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। এসব বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের বেশির ভাগই কিনেছেন ব্যবসায়ী ও প্রবাসীরা। কিছু রাজনীতিবিদ এবং আমলারাও এই অ্যাপার্টমেন্টগুলি কিনছেন।"
কোম্পানির কর্মকর্তাদের মতে, র্যাংগস প্রপার্টিজ লিমিটেড এপর্যন্ত রাজধানীতে ৩২টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এ খাতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, "দেশের বেশির ভাগ অর্থ এক শ্রেণির মানুষের হাতে। তারা সবসময় সবকিছুতে একটু বেশি বিলাসবহুল। বিশেষ করে, তারা সবসময় চান তাদের আবাসিক জায়গাটিকে যতটা সম্ভব আরামদায়ক করতে।"
তিনি আরও বলেন, " যারা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন- তাদের বেশিরভাগেরই রাজধানীতে একাধিক বাড়ি রয়েছে। পরিবেশগত ভারসাম্য ও উন্মুক্ত পরিবেশ বজায় রেখে নির্মাণ করা হয় বলে ধনীরা এই অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টগুলিও কেনে।"
তবে পুঁজিবাজার ও রিয়েল এস্টেট খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, "এই দুই খাতে কালো টাকা বিনিয়োগ করা হলে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান এই টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না। এ কারণে অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং প্রবাসী বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে বিনিয়োগ করছেন।"
রিহ্যাবের পরিচালক এবং জ্যামস ডেভেলপমেন্টস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোঃ শাহাদাত হোসেন জানান, "মহামারির কারণে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, কারণ এগুলো সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প হয়। অধিকাংশক্ষেত্রেই গ্রাহকরা এ ধরনের অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর করার অনেক আগেই বুকিং দিয়ে রাখেন।"
"অবশ্য নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে কোম্পানিগুলো কিছুটা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে"- বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নতুন বিনিয়োগকারী:
টিএম অ্যাসেটস লিমিটেড, ইস্ট ভ্যালি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, ফরচুনা গ্রিন সিটি, জ্যামস ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড, ইক্যুইটি প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডসহ দশটি কোম্পানি গত দুই বছরে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসায় প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। এ খাতে তাদের বিনিয়োগ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
তাছাড়া সানমার প্রপার্টিজ লিমিটেড, সাফ হোল্ডিং লিমিটেড, ইক্যুইটি প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, শাহ আমানত প্রপার্টিজ লিমিটেড এবং গাউসিয়া প্রপার্টিজ অ্যান্ড বিল্ডার্সসহ প্রায় ১০টি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রামে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, "আমরা এই ধরনের আবাসন প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিই- কারণ তারা সমস্ত নিয়ম-কানুন মেনে চলে। গ্রাহকরাও এই প্রকল্পগুলিতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন, তারা সবকিছু সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে চান।"