পর্দায় আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার কতটা জরুরী?
ওটিটি প্লাটফর্ম চরকিতে গত জানুয়ারিতে মুক্তি পেয়েছে ওয়েব সিরিজ 'শাটিকাপ'। মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম পরিচালিত এই সিরিজটির গল্প রাজশাহী শহর ও আশপাশের এলাকাকে কেন্দ্র করে। ১৩৭ জন শিল্পী অভিনয় করেছেন এই সিরিজে। তবে তারচেয়েও বড় বিষয়, সিরিজটির গল্পের মতো পুরো সিরিজে ব্যবহার করা হয়েছে রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষা।
টিভি সিরিয়াল বা নাটকে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নতুন নয়। এমনকি এর আগে বিজ্ঞাপনেও আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার দেখা গেছে। তবে দেশীয় ওয়েব সিরিজে এটাই সম্ভবত প্রথম আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার।
ওয়েব সিরিজে আঞ্চলিকতার ব্যবহার নিয়ে পরিচালক মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম বলেন, 'শাটিকাপ গল্পটাই রাজশাহীকে কেন্দ্র করে। তাই এখানে অন্য কোনো ভাষা দিলে পরিপূর্ণ হতো না। আমি যদি বরিশাল অঞ্চলের সিরিজ বানাতাম তাহলে হয়ত সেখানকার ভাষা ব্যবহার করতাম।'
তবে রাজশাহীর ভাষা ব্যবহারে অন্য অঞ্চলের মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তাওকীর বলেন, 'সিনেমার কিন্তু নিজস্ব ভাষা আছে। তাই আলাদা করে কোন অঞ্চলের ভাষায় মানুষ কথা বলছে সেটা কিন্তু অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাছাড়া সিরিজে প্রমিত বাংলা ও ইংরেজির সাবটাইলে দেয়া ছিল।'
তবে এর আগে টিভি নাটক ও সিরিয়ালে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে দেখা গেছে অভিনয়শিল্পীদের। বিশেষ করে সালাউদ্দিন লাভলু, মীর সাব্বির, শামীম জামান, সাগর জাহানসহ অসংখ্য পরিচালক আঞ্চলিক ভাষায় নাটক নির্মাণ করেছেন। বেশিরভাগ নাটক সমাদৃত হয়েছে। কিছু নাটক হয়েছে সমালোচিতও।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ডিরেক্টর গিল্ডের সভাপতি, অভিনেতা ও পরিচালক সালাহউদ্দিন লাভলুর সঙ্গে। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমি একসময় যশোর-কুষ্টিয়ার ভাষায় নাটক নির্মাণ করতাম। পরে পাবনার ভাষায় নির্মাণ করি। আমার পরিচালনায় রঙের মানুষ, সাকিন সারিসুরি, হাড় কিপটে সিরিয়ালগুলো তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল ওইসময়। এখনো ইউটিউবে দেখে মানুষ প্রশংসা করেন। সমস্যা হলো, আঞ্চলিকতার সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারা। এটা অনেকেই পারে না। অনেক সময় হাসির জন্য নানা আঞ্চলিকতা মিশিয়ে একটা নাটক নির্মাণ করা হয়। তখন এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।'
লাভলু আরও বলেন, 'আমি যদি গ্রামের নাটক নির্মাণ করি, তাহলে নিশ্চয় গ্রামের মানুষ শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলবে না। তাদের ভাষাতেই কথা বলবে। আমি সেটাকে একটা অঞ্চলের মধ্যে নিয়ে এসে গল্পটা বলি।'
নাটকে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নিয়ে কথা বলেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নওয়াজীশ আলী খান। তিনি বলেন, 'আমরা যতদুর জানি প্রতি ১০ মাইল পরপর একটা অঞ্চলের ভাষা পরিবর্তন হয়। তাই রাজশাহীর সঙ্গে কুষ্টিয়া, বা কুষ্টিয়ার সঙ্গে চট্টগ্রাম বা সিলেটের সঙ্গে যশোরের ভাষা মেলে না। অঞ্চলের ভাষায় কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষ কথা বলেন। কিন্তু সত্যিটা হলো আমরা কিন্তু কোনো অঞ্চলের ভাষার জন্য জীবন দিইনি। আমরা বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। তাই যেকোনো কিছু নির্মাণের আগে এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। একটা নাটকে বা কনটেন্টে দু-একটা চরিত্র হয়তো নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষায় কথা বলতে পারে। পুরো নাটক বা সিরিয়াল যদি নির্মাণ করা হয় তাহলে সেটা ওই অঞ্চলের বাইরের মানুষের জন্য বোঝা কঠিন। তারচেয়ে বড় বিষয়, এখন আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র হাসির নাটক বানানোর জন্য। আমি মনে করি, এতে একটা অঞ্চলকেই ছোট করা হয়।'
বিষয়টি নিয়ে আরও কথা বলেছেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ও কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। তিনি বলেন, 'যদি কোন চরিত্রকে দিয়ে সমাজের নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের ভাষায় কথা বলা জরুরী হয়, তাহলে সেটা আমি মেনে নিবো। কিন্তু শহরের একটা চরিত্র যদি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে সেটা তো ভালো লাগবে না। মূল কথা, চরিত্র অনুযায়ী ভাষাটা নির্ধারণ করা উচিত। তবে কেউ যদি গ্রামের বা নির্দিষ্ট অঞ্চলের নাটক নির্মাণ করেন তাহলে সব চরিত্র একই অঞ্চলের ভাষায় কথা না বলে কিছু চরিত্র প্রমিত বাংলায় কথা বলার জন্য রাখা জরুরী। তাতে সব ধরনের দর্শকের বুঝতে সুবিধা হবে।'