নারী ক্ষমতায়ন যেভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করে
১৯৭৭ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। বিশ শতকের শুরুর দিকে উন্নত কর্মপরিবেশ এবং নারীদের কাজের অধিকার আদায়ে শুরু হওয়া শ্রম আন্দোলনের মাধ্যমেই এই স্বীকৃতি মিলেছিল।
বছরের পর বছর ধরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর গবেষণা বৃহত্তর উত্পাদনশীলতা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতার সুবিধাগুলোকে চিহ্নিত করে আসছে। এ বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে তাদের সাম্প্রতিক ব্লগ, পডকাস্ট এবং লিঙ্গ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রের সংক্ষিপ্ত এক বিবরণে তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো।
কাজ বেশি হলেও রয়েছে কাজের মানুষের অভাব: করোনাকালে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় এবং চাইল্ড কেয়ার সার্ভিস বা শিশুদের দেখাশোনায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অভাব অল্পবয়সী শিশুদের মায়েদের ওপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। ফলে অনেক মা সংসার ও সন্তানের দেখভাল করতে নিজের ক্যারিয়ার ও কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আইএমএফের নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে, অন্য নারীদের সঙ্গে ৫ বছরের কম বয়সী সন্তান রয়েছে এমন মায়েদের কর্মসংস্থানে যোগদানের ব্যবধান ব্যাপক। আর করোনা মহামারি এই ব্যবধানকে আরও বাড়িয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহামারি পূর্ব সময়ের তুলনায় বর্তমান সময়ে কর্মসংস্থানের ব্যবধানের প্রায় ১৬ শতাংশের জন্য দায়ী।
লিঙ্গভিত্তিক কর বৈষম্য: কর নীতি কীভাবে লিঙ্গ সমতাকে প্রভাবিত করে? আইএমএফের নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে সে তথ্য। আবাসন কর, মূলধন ও সম্পদের করের পাশপাশি ভোগ ওপরে ধার্য কর বিবেচনার মাধ্যমে অন্তর্নিহিত ও সুস্পষ্ট লিঙ্গভিত্তিক পক্ষপাতিত্ব নির্দিষ্ট করা হয়েছে গবেষণায়।
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে আইনি প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা: আইন প্রায়শই লিঙ্গভিত্তিক নিয়ম কানুনকে স্থায়ী করে ফেলে, যা পরবর্তীতে নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণকে সীমিত করে দেয়। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে গবেষকরা নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আইনি বাধা চিহ্নিত করেছেন এবং কীভাবে এই বিষয়গুলো সংশোধনে কাজ করা যেতে পারে তাও বর্ণনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, পিতৃত্বকালীন ছুটির কথাই বলা যেতে পারে। এ ধরনের বিষয়গুলোতে পরিবর্তন এনে কার্যকরভাবে লিঙ্গ সমতাকে উন্নীত করতে এবং নারী কর্মশক্তিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে কীভাবে উৎসাহিত করা যেতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে ওই গবেষণায়।
নারীদের কর্মশক্তিকে কাজে লাগানো: এক্ষেত্র আসতে পারে আফ্রিকার কথা। সাব-সাহারান আফ্রিকার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে নারীরা মানব পুঁজি এবং এ সম্পর্কিত ব্যবস্থাপনায় পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি পিছিয়ে। আফ্রিকার ওপর এফঅ্যান্ডডি'র বিশেষ এক ফিচারে বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদরা তুলে ধরেছেন, কীভাবে নারীদেরকে মানব পুঁজি হিসেবে কাজে লাগানোর পর এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বেড়েছে আরও কয়েকগুণ। তারা বিশ্বের সব জায়গায় এই বিষয়টিকে বিবেচনা করতে উৎসাহিত করেছেন।
অর্থনীতিকে আরও উন্নত করার বিষয়ে ডায়ান কোয়েলের মতামত: ব্রিটিশ এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, পেশার মধ্যে বৈচিত্র্যের অভাব নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে বাধা দেয়। অর্থনীতিবিদরা যদি পাবলিক পলিসিতে তাদের প্রভাব বজায় রাখতে চান, তবে অন্যান্য বিষয়গুলোর সঙ্গে তাদের এখানেও কাজ শুরু করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। বিশ্ব এখন যেসব জটিল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, সেগুলোর সমাধানে সহায়তা করতেও তিনি অর্থনীতিবিদদের আহ্বান জানিয়েছেন।
নারীর প্রতি সহিংসতা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে যেভাবে হুমকির মুখে ফেলছে: করোনাজনিত লকডাউনের মাঝে নারীদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতন বেড়েছে কয়েকগুণ। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো লকডাউনে নারীর প্রতি এ ধরনের সহিংসতা বৃদ্ধিকে 'শ্যাডো প্যান্ডেমিক' বা ছায়া মহামারি কিংবা নীরব মহামারি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আইএমএফের গবেষণা দেখিয়েছে, এই ধরনের সহিংসতা কীভাবে সাব-সাহারান আফ্রিকার অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণায়।
অবৈতনিক কাজের বিষয়ে জয়তি ঘোষের মতামত: ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক মনে করেন, আমাদের উত্পাদনশীলতার ধারণাটি অসম্পূর্ণ; কারণ নারীরা বিনা বেতনে সংসারে যেই কাজগুলো করে থাকেন তা আমাদের মোট দেশীয় উৎপাদন বা জিডিপিতে প্রাথমিকভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়না। নারীদের গৃহস্থলির কাজ যেমন- সন্তান লালন-পালন, বয়স্কদের যত্ন নেওয়া, রান্নাসহ সংসারের বিভিন্ন কাজ জিডিপি হিসাবের বাইরেই থেকে যায়। অথচ সংসারে একজন মায়ের বদলে যদি এই কাজগুলোর জন্য খাবার হোটেল, নার্স কিংবা একজন কাজের মানুষের ওপর নির্ভর করা লাগতো, তাহলে নিঃসন্দেহে একটি সংসারের খরচ বেড়ে যেতো আরও কয়েকগুণ।
বর্ণবাদ এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের ব্যাপারে করেলিসা ডি কুকের মতামত: মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই অধ্যাপক, সম্প্রতি ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ড অফ গভর্নরসে কাজ করার জন্য মনোনীত হয়েছেন। তিনি নিজের গবেষণা ও অধ্যয়নের আলোকে বর্ণনা করেছেন, সহিংসতা কীভাবে একটি দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব রাখে। তিনি পুরুষপ্রধান বিশ্বে একজন নারী অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছেন।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে একজন মায়ের আবশ্যকতা: আইএমএফের গবেষণা দেখিয়েছে, কর্মজীবী মায়েদের ওপর মহামারির বাহ্যিক প্রভাব ছিল অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং স্পেন, এই তিন দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে এটি স্পষ্ট যে, মহামারিকালীন অল্পবয়সী সন্তানের মায়েরা অন্য নারী ও পুরুষদের তুলনায় চাকরি হারিয়েছেন অনেক বেশি।
- সূত্র: আইএমএফ ব্লগ