যে জাদুঘরের কথা আমরা জানি না!
"দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের ফিল্ম সংগ্রহালয় থেকে বোধকরি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ সবদিক থেকে আধুনিক এবং একই ছাদের নিচে রয়েছে সিনেমা বিষয়ক সবকিছুর ভান্ডার"।
এমনটিই কথার ফাঁকে জানাচ্ছিলেন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ফিল্ম অফিসার, ফখরুল আলম। কিন্তু এখানকার এ সমৃদ্ধ সংগ্ৰহের কথা খুব কম মানুষই জানে। বারবার জায়গা বদল। প্রচারণ না থাকা-এ চলচ্চিত্র ভাণ্ডারের কথা অজানা থাকার মূল কারণ।
কী আছে এখানে? রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত সাততলা বিশিষ্ট ভবনটিতে রয়েছে ৩০০ আসনের সিনেমা হল, ফিল্ম বিষয়ক গ্রন্থাগার, জাদুঘর, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সিনেমা রিল সংরক্ষণের ৬টি ভল্ট ও ফিল্ম বিষয়ক অন্যান্য বিভাগ।
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে 'বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ' চলচ্চিত্র জগতের জন্য পরিপূর্ণ সংগ্রহাগার রূপে পরিণত হতে পেরেছে। কিন্তু এত সব হতে সময় লেগে গেছে ৪ দশকেরও বেশি।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের ফিল্ম আর্কাইভের যাত্রা শুরু থেকে এযাবতকালে ৪ বার প্রতিষ্ঠানটিকে জায়গা স্থানান্তর করতে হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন এই প্রতিষ্ঠানটিতে সংরক্ষিত আছে প্রায় ৪ হাজারের কাছাকাছি সিনেমার রিল। ৪ ও ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ভল্টে সংরক্ষণ করা হয় সাদা-কালো সিনেমা।
মাইনাস ৪ ও ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ভল্টে রাখা হয় রঙিন সিনেমা এবং ১২ ডিগ্রির ভল্টে আছে সিডি, ডিভিডিসহ পোস্টার ও ফটোসেট। কিন্তু ভল্টে যাওয়ার অনুমতি মিলবে না সাধারণ দর্শনার্থীদের।
পুরোনো যতো সিনেমা যন্ত্র
জাদুঘরটি ঘুরে দেখার সময় যে জিনিসে চোখ আটকে যাবে তা হলো সাজিয়ে রাখা বিশাল আকারের একেকটি যন্ত্র। এই যন্ত্রগুলো দিয়েই নির্মিত হয়েছিল ৫০-৭০ দশকের জনপ্রিয় সব ঢাকাই সিনেমা। ১৯৫৫/৫৭ সালের অনেক দুর্লভ ক্যামেরার দেখা মিলবে এই জাদুঘরটিতে।
এফডিসি, বিভিন্ন প্রডাকশন হাউজ ও সিনেমা হল থেকে মরিচা ধরে যাওয়া ভঙ্গুর এই যন্ত্রগুলো উদ্ধার করে আর্কাইভের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। জাদুঘর প্রবেশের মুখেই ডানপাশে রাখা বিশাল এক সিনেমা প্রজেক্টর চোখে পড়বে। পাকিস্তান ফিল্ম ট্রাস্টের স্বত্বাধিকারী মরহুম মোশাররফ চৌধুরী ও সাইফুল ইসলাম চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী উপহার সিনেমা হলে এতো দশক ধরে প্রজেক্টরটি ব্যবহার করে চলচ্চিত্র দেখানো হতো।
২০১৯ সালে সিনেমা হলটি ভেঙ্গে ফেলা হলে মরহুম মোশাররফ হোসেনের পুত্র ৩৫ মি.মি. ফিল্মের এই প্রজেক্টর মেশিনটি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষণের জন্য দিয়ে দিলে,সেখান থেকে এটি এই জাদুঘরের জন্য ঐতিহাসিক সম্পদে পরিণত হয়েছে। তৎকালীন সময়ে প্রজেক্টর এই মেশিনগুলোর দাম ছিল আকাশচুম্বী।
কিছু দূর হাঁটতে চোখে পড়লো আরেকটি ৩৫ মি.মি. ফিল্ম প্রজেক্টর যন্ত্র। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের Westrex Company Ltd. থেকে Orcon ৩৫ মি.মি. ফিল্ম প্রজেক্টর মেশিন কেনা হয়েছিলো। প্রজেক্টরটি দিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য ধানমন্ডিতে অবস্থিত সাবেক বিচারপতি আহসানউল্লাহ চৌধুরীর বাড়ির ৩য় তলা ভাড়া নিয়ে সেখানে ফিল্ম প্রজেকশন হল তৈরি করা হয়েছিল।
১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ স্থান পরিবর্তন করে কলেজগেটের একটি ভাড়া বাড়িতে উঠলে সেখানেও এই প্রজেক্টরের মাধ্যমে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হতো। আরেক পাশে রাখা হয়েছে দুটি ১৬ মি.মি. ফিল্ম প্রজেক্টর। ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার পর ৩৫ মি.মি. প্রজেক্টরের সাথে চারটি ১৬ মি.মি প্রজেক্টরও কেনা হয়েছিলো। ১৬ মি.মি. আকারের ফিল্ম প্রদর্শনের জন্য এই প্রজেক্টরগুলো ব্যবহার করা হতো। আকারে এই প্রজেক্টরগুলি ৩৫ মি.মি. থেকে অনেক ছোট ও ওজনে হালকা। তাই সহজে বহনযোগ্য ছিল এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো।
এ তো গেল চলচ্চিত্র প্রদর্শনের প্রজেক্টরের কথা, কিন্তু তৎকালীন চলচ্চিত্র ধারণ করার বিভিন্ন রকম ক্যামেরার দেখা মিলবে কাঁচ দিয়ে আবদ্ধ করা একটি টেবিলে। ৭টি স্টিল ক্যামেরার পাশেই সাজানো আছে ১০টি ক্যামেরা লেন্স, ১০টি ফ্ল্যাশ প্যান। ২০১৮ সালে তৎকালীন প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ও তথ্যসচিব কামরুন নাহার এর সহায়তায় ক্যামেরা সরঞ্জামগুলো বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষণে জন্য আনা হয়।
সংরক্ষিত চাইনিজ কিছু ক্যামেরার মধ্যে আছে হাই স্পিডের অ্যারি থ্রি-সি, অ্যারি বিএল ক্যামেরা, ৪৩৫ ক্যামেরা। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন থেকে ক্যামেরাগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়াও 'শর্ট ফিল্ম ফোরামের' নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ১৬ মি.মি. ক্যামেরা রয়েছে ফিল্ম আর্কাইভের জাদুঘর ভাণ্ডারে।
আরও দেখা গেল সড়ক দুর্ঘটনায় প্রয়াত সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রযোজক, সাংবাদিক আলমগীর কবিরের নির্মিত সিনেমায় ব্যবহৃত হওয়া একটি ৩৫ মি.মি. ক্যামেরা, ফিল্ম লোড করার ৩টি ম্যাগাজিন, ১টি ট্রাইপড (ক্যামেরা স্ট্যান্ড), ফিল্ম লোড করার একটি কালো ব্যাগ, ১টি ক্যামেরা রাখার জন্য বক্স ও পোর্টেবল চলচ্চিত্র প্রদর্শনী পর্দা। চলচ্চিত্র জগতের পথিকৃৎ এই নির্মাতার মৃত্যুর ৩ বছর পর ১৯৯২ সালে তার বোন বিশিষ্ট লেখিকা মরহুম মমতাজ হোসেনের নিকট থেকে দুলর্ভ যন্ত্রগুলো বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ সংরক্ষণের জন্য সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। এই ক্যামেরাগুলিতে ধারণ করা হয়েছিল বিখ্যাত ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্র সুফিয়া, আমরা দুজন ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ের মতো ঐতিহাসিক সব সিনেমা।
চলচ্চিত্র ধারণের সময় দিনের বেলা আলোর তারতম্য ঘটাতে এবং কৃত্রিম আলো তৈরি করতে ডে-লাইট যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। সেকালে ব্যবহার করা ডে লাইটগুলোর কয়েকটি পরবর্তীতে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষণের জন্য সংগ্রহ করা হয়। ৬ কিলোওয়াটের একটি ডে-লাইট, ২.৫ কিলোওয়াটের ব্যালাস্টসহ লাইট সংরক্ষিত আছে জাদুঘরে। ১৯৭৮ সালে চলচ্চিত্র সম্পাদনার জন্য ব্যবহার করা স্ট্যানব্যাক এডিটিং মেশিনটি মধ্যখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।
দু'পায়া বিশিষ্ট টেবিলটি দেখতে অনেকটা আধুনিক চুলার মতো। দুপাশে ৩টি করে মোট ৬টি রিল ঘূর্ণি চাকা রয়েছে। যন্ত্রটির মধ্যখানে ও সাইডের দুপাশে কয়েকটি বাটন রয়েছে, যেগুলো দিয়ে এডিটিংয়ের সময় মেশিনটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। এছাড়াও আছে ১২টি ফিল্ম সিংক্রোনাইজার-যেগুলো বিএফডিসি থেকে আনা হয়েছিল। চলচ্চিত্র ধারণের সময় ৫০-৬০ হাজার ফুট পর্যন্ত চিত্র নেওয়া হয়। যা পরবর্তীতে সিংক্রোনাইজার যন্ত্রের মাধ্যমে ১২ হাজারে নামিয়ে আনা হতো। জাদুঘরে আরও আছে পুরোনো অ্যামপ্লিফায়ার (শব্দবর্ধক) যন্ত্র, জেভিসি-ভিসিপি, প্যানাসোনিক ভিসিপি, ডিভিডি প্লেয়ার।
ফিল্ম অফিসার ফখরুল আলম জানান, "আমাদের সংগ্রহালয়ে মিসেল এনসি ও মিসেল বিএনসির মতো দূর্লভ যন্ত্র রয়েছে। এগুলো ১৯৫৬ সালে প্রথম বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন ক্রয় করেছিল এবং প্রতিটি যন্ত্রের ওজন প্রায় ১-১.৫ মণ পর্যন্ত হয়। মিসেল এনসি ও বিএনসি দিয়ে ৫০-৭০ দশকের সিনেমার সংলাপসহ রেকর্ড করা হতো।"
"২০১৯ সালে এফডিসি থেকে আমরা এগুলো সংগ্রহ করে জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য নিয়ে আসি। জাদুঘরে সংরক্ষণকৃত বেশিরভাগ যন্ত্র ভাঙ্গা ও টুকরো করা আলাদা অংশে আমাদের কাছে পৌঁছেছিল। তারপর যত্নসহিত সেগুলোকে পুনরায় একটি অংশের সাথে অন্য অংশকে জোড়া লাগানো হয়েছে। অনেক যন্ত্র কালের বিবর্তনে সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গিয়েছে"।
জাদুঘরে সাজিয়ে রাখা এই যন্ত্রগুলো এখন নিস্তেজ ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলেও, একসময় এগুলোর প্রয়োজন ছিল তুঙ্গে। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে গুণী-নামী নির্মাতা তাদের শ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলো আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। যেগুলো এখনও আমাদের চলচ্চিত্র জগতের জন্য রত্ম ভান্ডার হিসেবে বিবেচিত।
জীবন থেকে নেওয়া, মুখ ও মুখোশ, তিতাস একটি নদীর নাম, সীমানা পেরিয়ে, রুপালী সৈকতে ও আসিয়ার মতো কালজয়ী সব চলচ্চিত্র নির্মাণে এই ক্যামেরা যন্ত্রগুলো ছিল তখন মূল্যবান হাতিয়ার। বিখ্যাত সব নির্মাতার হাতের ছোঁয়া লেগে আছে এই যন্ত্রগুলোতে।
আরও যা আছে
জাদুঘরে সিনেমা যন্ত্রের সংখ্যা বেশি হলেও দেখা মিলবে আরও পুরোনো কিছু মূল্যবান জিনিসের। ৭০ দশকের নায়ক-নায়িকাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা আছে জাদুঘরটিতে। অভিনেতাদের জাতীয় পুরষ্কার ও পদক, নায়ক রাজ্জাকের ব্যবহৃত পোশাক, টুপি; মালা চলচ্চিত্রে অভিনেত্রীর ব্যবহৃত মালা, সিনেমায় ব্যবহৃত পপ বন্দুক, নির্মাতা জহির রায়হানের হাতে লেখা 'জীবন থেকে নেওয়া' সিনেমার স্ক্রিপ্ট থেকে আরও রাখা আছে সিনেমায় ব্যবহৃত ঐতিহাসিক সব জিনিসাদি।
কিংবদন্তি খান আতাউর রহমানের 'শ্রুতি স্টুডিওর' গান রেকর্ডিংয়ের যন্ত্রাদি সযত্নে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে। কিন্তু যে যন্ত্রগুলোতে একসময় দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পীদের গান রেকর্ডিং হতো সেগুলোতে এখন যেন প্রাণ নেই। রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, কনকচাঁপার মতো প্রখ্যাত শিল্পীদের পদচারণায় একসময় মুখর ছিল এই স্টুডিওটি। এই যন্তগুলোতেই বেধেঁছিলেন নিজেদের ক্যারিয়ারের বিখ্যাত সব গানগুলো।
জাদুঘরটি জনসাধারণের জন্য সম্পূর্ণ বিনা টিকেটে উন্মুক্ত করে দেওয়া হলেও দর্শনার্থীর আনাগোনা কম। ফিল্ম -মিডিয়া স্টাডিজ, সংগীত ও সাংবাদিকতার ছাত্রদের পড়াশোনার একটি ক্ষেত্র চলচ্চিত্রের ওপর থাকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে প্রায়ই এই জাদুঘর প্রদর্শনে আসে।
সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার ফিল্ম আর্কাইভের সিনেমা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়। আর্কাইভের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ও পৃষ্টপোষকদের চাওয়া সামনের দিনগুলোতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাংলা চলচ্চিত্রমুখী হবে এবং সিনেমা বিষয়ক বিস্তর জানার আগ্রহ বোধ থেকে ফিল্ম আর্কাইভে নিয়মিত পদচারণা বাড়বে।