প্রতিদিনই মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি
বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস এখন এক বাস্তব হুমকি। ভাইরাসটির বিস্তার রোধে বিশ্বব্যাপী যত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তার কারণে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জনজীবন। প্রতিদিনই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সরবরাহ ব্যবস্থা; কমছে সেবাভিত্তিক ব্যবসার পরিধি। ধারণা করা হচ্ছে, যত দিন যাবে, কড়াকড়ির মাত্রা ততই বাড়বে।
মাত্র একদিন আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। করোনায় বিপর্যস্ত ইতালিতে সরকারি নির্দেশে বন্ধ করা হয়েছে সকল প্রকার দোকানপাট ও বিপণি বিতান।
কর্মীদের ঘরে বসে কাজ করতে বলা বৈশ্বিক বৃহৎ কোম্পানির তালিকায় এবার নাম লিখিয়েছে টুইটার। সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে টুইটার ইঙ্ক তাদের কর্মীদের এমন নির্দেশনা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে জনভীতির আরেক উদাহরণ দেশটির জাতীয় বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে চলতি মৌসুমে সকল প্রকার খেলা বন্ধ রাখার ঘোষণা। সব মিলিয়ে বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে এখন বইছে হিমশীতল উত্তুরে হাওয়ার প্রকোপ।
করোনা বিস্তার বন্ধের যুদ্ধে এসব ঘোষণা অবদান রাখবে- তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনস্বীকার্য। খবর ব্লুমবার্গের।
প্রতিটি বাতিল হওয়া ফ্লাইট, কোয়ারেন্টাইনের আওতায় পড়া প্রতিটি নগর, বন্ধ হয়ে যাওয়া উৎপাদন কেন্দ্র, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সঙ্গীতায়োজন, সম্মেলন বিশ্ব অর্থনীতির জন্য শক্ত আঘাত। এর প্রভাবে চলতি তিন মাসের প্রান্তিকসহ সামনের দিনগুলোতেও বিশ্ব অর্থনীতি ভোক্তা চাহিদায় বড় ধরনের পতন লক্ষ্য করতে পারে।
এমন আশঙ্কার প্রধান কারণ, প্রথমদিকে ভাইরাস আতঙ্কে বাড়তি পণ্য ক্রয়ের প্রবণতা দেখা গেলেও, পরবর্তীকালে এসব ভোক্তার অনেকেই ক্রয় সক্ষমতা হারাবেন। অনেকে হারাবেন কর্মসংস্থান। ফলে বিশ্ববাজারে পরবর্তীকালে চাহিদার পাল্লা ভারি হতে অনেকটা সময় লাগবে।
'সবকিছু মিলিয়েই বৈশ্বিক মহামারি আকারে করোনা ছড়ানোর আতঙ্কে এখন বিশ্ব অর্থনীতি জোর কদমে মন্দার দিকে এগোচ্ছে'- সাম্প্রতিক এক গবেষণা নোটে এমন মন্তব্য করেছেন ইয়ারদেনি রিসার্চ ইঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এড ইয়ারদেনি।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতি চলতি বছর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির চক্রে ফিরবে- এমন অনুমান করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই 'ভি' আকৃতির রেখাচিত্র নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি প্রথম প্রান্তিকে কিছুটা পতন নিয়ে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ফের উত্থানের পথে হাঁটবে বলে আশা করছিলেন তারা। কিন্তু সে আশার গুড়েবালি।
বিশ্ব অর্থনীতি এখন ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বড় মন্দার মুখে। এই অবনতি কতটা ভয়াবহ হবে বা কতদিন ধরে বজায় থাকবে, সেটা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাঝে এখন মতবিরোধ রয়েছে। তবে আসন্ন মন্দা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
এমন একক দৃষ্টিকোণ তৈরির পেছনে মূল অবদান অবশ্য বিশ্ব পুঁজিবাজারের। গত বৃহস্পতিবারও বিশ্ববাজারে কোম্পানি শেয়ার, বন্ড এবং অনান্য সিকিউরিটিজের মুল্যধস অব্যাহত ছিল। এদিন বিশ্ব পুঁজিবাজারের এমএসসিআই সূচকে মন্দায় পড়ার সমূহ বিপদটা আরও স্পষ্ট হয়।
করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অর্থনীতির দেশ চীন ইতোমধ্যেই বিগত কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো প্রান্তিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি সংকোচনে পড়তে চলেছে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশের শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোও করোনার প্রভাবে ভোক্তাচাহিদায় পতন লক্ষ্য করছে। সবমিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির সার্বিক বিকাশে লাগাম টেনে ধরার হুমকি তৈরি হয়েছে।
ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্সের এক গবেষণায় জানা যায়, চলতি বছরের মধ্যেই বিশ্ব পুঁজিবাজার বিগত ১১ বছর ধরে চলমান সম্প্রসারণ হারাবে। ভাইরাস বিস্তারের আগে থেকেই জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির অর্থনীতি সংকোচন চক্রে পড়ে। এর সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি বাড়তি নেতিবাচক অবস্থা যোগ করে এসব দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ব্রেক্সিট নিয়ে টালমাটাল যুক্তরাজ্যের জন্যেও করোনা ভাইরাস এক অন্য মাত্রার বিপদ হিসেবে হাজির হলো।
ভাইরাস বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাহিদা নিয়েও অর্থনীতিবিদরা উদ্বিগ্ন। অর্থনীতির পরিভাষায় এর নাম 'ফিডব্যাক লুপ'। এর মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিতে সংকট ধীরে ধীরে কেটে ওঠার সময় বিদেশি বাণিজ্য সহযোগীদের আমদানি চাহিদা কমার আশঙ্কা করা হয়। এই অবস্থায় মন্দার মেয়াদ আরও বাড়ে।