ইইউ-আমেরিকার বাজারে পোশাক রপ্তানি হারে বাংলাদেশকে ছাড়াল ভারত, পাকিস্তান
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে তৈরি পোশাকের রপ্তানি আদেশ বাড়ছে। তবে ইউরোপের পোশাক আমদানির তথ্য সংরক্ষণকারী ইউরোস্ট্যাটের গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসের পরিসংখ্যান বলছে, ওই অঞ্চলের দেশগুলোতে সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের চেয়েও বেশি হারে রপ্তানি বেড়েছে প্রতিযোগী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের।
ইউরোপের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানির হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ওটেক্সার তথ্যও বলছে, আলোচ্য সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও বাংলাদেশের তুলনায় ভারত ও পাকিস্তান থেকে বেশি হারে রপ্তানি হয়েছে।
দেশে তৈরি পোশাকের প্রধান কাঁচামাল সুতার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তান ও ভারত এ সুবিধা নিয়েছে বলে মনে করছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা। তারা বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় দেশে সুতার দাম ক্ষেত্রবিশেষে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি। ফলে মূল্য সুবিধায় ক্রেতারা সেখানে ঝুঁকছে।
ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। একই সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের বেড়েছে ২২ ও ২৮ শতাংশ।
পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ফতুল্লাহ ফ্যাশন লিমিটেডের সিইও ফজলে শামীম এহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখানে সুতার মাত্রাতিরিক্ত দামের কারণে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত ও পাকিস্তান বেশি হারে রপ্তানি করছে। কেননা সুতার বাড়তি দামের কারণে আমরা অনেক ক্রয়াদেশ ধরতে পারিনি, যা ভারত পাকিস্তানে গেছে।"
তিনি বলেন, "উভয় দেশই পোশাকের মূল কাঁচামাল তুলা উৎপাদন করে। বাংলাদেশের স্পিনিং মিলগুলো তুলা আমদানি করলেও অতীতে দামে এত বেশি পার্থক্য ছিল না। কিন্তু গত কয়েক মাস থেকে দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়তে শুরু করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অন্যান্য দেশের তুলনায় ৫০ শতাংশের মতো বেড়ে যায়। পোশাক তৈরিতে কাঁচামালের ব্যবহার গড়ে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। ফলে কম দাম পেয়ে ক্রেতারা সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানে ঝুঁকেছে।"
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি এবং প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফজলুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের চেয়ে বেশি হারে ভারত-পাকিস্তানের রপ্তানির একটি কারণ হতে পারে কাঁচামালের দামের তারতম্য।"
তিনি বলেন, "আমাদের রপ্তানি বাড়ছে, কিন্তু আমরা তো আরো বেশি হারে বাড়াতে পারতাম। কেন পারছি না, তা বিশ্লেষণ হয় না। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা কোন কৌশলে এগিয়ে যাচ্ছে, তা বিচার বিশ্লেষণ করা দরকার।"
তবে, বাংলাদেশ গারমেন্ট ম্যানুফেকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশ্নের (বিজিএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম টিবিএসকে বলেন, "উভয় দেশ আমাদের চেয়ে বেশি হারে রপ্তানি করলেও আগামী মাসগুলোতে আমরা তাদের পেছনে ফেলতে পারব। বাংলাদেশে এখন প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে।"
ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ইউরোপ বিশ্ববাজার থেকে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক পণ্য আমদানি করেছে, যা পূর্বের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি।
সেখানে রপ্তানিতে চীনের পর যথারীতে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশ ইউরোপের ২৭টি দেশে (যুক্তরাজ্যসহ) রপ্তানি করেছে ৭.৮২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক পণ্য। ওই অঞ্চলের দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলো হলো যথাক্রমে তুরস্ক, ভারত, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, মরক্কো, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাংলাদেশের যেহেতু নিজস্ব তুলা নেই, সেজন্য প্রতিযোগিতায় কিছুটা পিছিয়ে থাকে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও পণ্যের বহুমুখীকরণে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যমে তা কিছুটা লাঘব করা যায়।"
"এছাড়া চীনের ছেড়ে দেওয়া পোশাকের রপ্তানি বাজারের বড় অংশ কার হাতে যাবে, তা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মনোযোগ দিতে হবে', বলেন তিনি।
চলতি বছরের শুরু থেকে তৈরি পোশকের মূল কাঁচামাল তুলার দাম বাড়তে থাকে বিশ্বব্যাপী। এর প্রভাবে বাংলাদেশেও সুতা ও ফেব্রিকের দাম বাড়তে থাকে। তবে গত চার মাস থেকে দাম বেশি হারে বাড়তে শুরু করে।
পোশাক শিল্প মালিকরা মনে করছেন, বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিল মালিকরা সুতার দাম বেশি হারে বাড়িয়ে অতিমুনাফা করেছেন। যদিও স্পিনিং মিল মালিকরা বরাবরই বলে আসছিলেন যে, তুলার দামের ভিত্তিতেই সুতার দাম বাড়ানো হয়েছে।
গত তিন মাস ধরে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনার পর সম্প্রতি দাম নির্ধারণে উভয় পক্ষ আপতত একটি সমঝোতায় এসেছে।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে ৩১.৩৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক পণ্য রপ্তানি করে, যার মধ্যে নিটওয়্যারের অংশ ছিল অর্ধেকের বেশি।
মহামারির বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে পোশাক রপ্তানি করেছিলো ১৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। আর স্বাভাবিক অর্থনীতির বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে রপ্তানি করেছিল পৌনে ১৭ বিলিয়ন ডলারের। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৬০ শতাংশেরও বেশি যায় ইউরোপের বাজারে।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে সুতার দামে তারতম্য
আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য বলছে, বর্তমানে সুতার দাম প্রতি পাউন্ড ৯৫ সেন্টের কিছু কমবেশি। বাংলাদেশে আমদানিকৃত তুলায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় ৩০ কাউন্টের সুতা, যা দিয়ে মূলত নিটওয়্যার পোশাক তৈরি হয়।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, সব ব্যয় যোগ করে এ ধরনের প্রতি কেজি সুতার দাম কোনোভাবেই ৩.৮০ ডলারের বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৪.১৫ থেকে ৪.২০ ডলার দামে।
তবে টেক্সটাইল মিল মালিকরা বলছেন, ৩০ কাউন্টের প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে ব্যয় হয় প্রায় ৪.১২ ডলার, যা তারা ৪.২০ ডলারে বিক্রির জন্য অফার করছেন।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৩০ সিঙ্গেল কার্ড সুতার গত বুধবারের দরের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে ফজলে শামীম এহসান বলেন, "ভারত থেকে একই সুতা চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত আমদানি ব্যয় (সিএন্ডএফ কস্ট) ৩.৬০ ডলার, যা তখন বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছিল ৪.১৫ ডলারে। একই সুতা ভারতের ক্রেতা আরো ১০ সেন্ট কম, অর্থাৎ ৩.৫০ ডলারে কিনতে পারছেন।