বাংলাদেশের পরিষেবা খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী যুক্তরাজ্যের ফার্মগুলো: হাই কমিশনার
বেশ কিছু যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি আর্থিক পরিষেবা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের কথা ভাবছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন এ কথা বলেছেন।
বৃহস্পতিবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অফিস পরিদর্শনকালে ডিকসন ভবিষ্যতের বিনিয়োগ কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশের সম্ভাবনার উপর জোর দেন। তবে তিনি আরও যোগ করেন যে, সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে প্রথমে কয়েকটি খাতে বাংলাদেশের উন্নতির প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ইউনিলিভার ও এইচএসবিসির মতো যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় করদাতা হওয়া সত্ত্বেও, প্রায়ই তাদেরকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলা পোহাতে হয়। এ জাতীয় সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন ডিকসন।
এছাড়া হাই কমিশনার চুক্তি বলবৎকরণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ স্বত্বের মতো ব্যাপারগুলো নিয়েও কাজ করার পরামর্শ দেন।
'যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন কোম্পানিরা বাংলাদেশে এসে বিনিয়োগ করতে চাইছে এবং আমরাও চেষ্টা করছি তাদেরকে এখানে নিয়ে আসার,' তিনি বলেন।
'যুক্তরাজ্য হলো একটি ৮০ শতাংশ পরিষেবা অর্থনীতি। আমাদের এমন কিছু কোম্পানি রয়েছে যারা এখানে আসতে চায় এবং উৎপাদন পরিকাঠামো স্থাপন করতে চায়। তবে মোটের উপর যে কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের চাহিদা মেটাতে পারবে, সেগুলো হলো বিভিন্ন পরিষেবা, যেমনঃ আর্থিক পরিষেবা, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং শিক্ষা পরিষেবা।'
শিক্ষা খাতের উপর আলোকপাত করে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহী।
'আমি এ ব্যাপারগুলো নিয়ে দুই বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছি। কিন্তু এখনও আমরা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছি।'
ডিকসন জানান, ক্রস বর্ডার হায়ার এডুকেশন অ্যাক্টের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পার্টনারশিপ ও প্রোগ্রাম সহজতর হয়ে উঠবে। কিন্তু এ আইনটি প্রবর্তিত হলেও এখনও এর প্রয়োগ ঘটেনি।
'আমরা বেশ কিছু বৃত্তি অফার করে থাকি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি সরাসরি এখানে বিনিয়োগ করে, তবে বিষয়টি আরও কম খরচসাপেক্ষ ও কার্যকরী হবে,' তিনি বলেন।
ডিকসনের মতে, এটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি বড় সুযোগ 'একেবারে নতুন একটি কাস্টমার বেজ (গ্রাহক গোষ্ঠী) গড়ে তোলার জন্য।'
কিছু অবকাঠামোগত সমস্যার কথা উল্লেখ করে হাই কমিশনার বলেন, কর কাঠামো সংস্কারেরও কাজ চলছে।
এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ হাই কমিশনের কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের কাউন্সেলর (প্রসপারিটি অ্যান্ড ইকোনমিক গ্রোথ ফরেন) মহেশ মিশ্রা বলেন, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশ, যা খুবই কম। বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সম্পদের পুনর্বন্টন ও অসাম্য হ্রাস করতে চায়, তাহলে এই অনুপাতের উন্নয়ন ঘটাতে হবে বলেও তিনি জানান।
পুঁজিবাজার প্রসঙ্গে হাই কমিশনার ডিকসন জানান, অর্থনৈতিক কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে।
'স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তীর্ণ হওয়া হবে বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল অর্জন। কিন্তু পরবর্তী এক বা দুই দশকে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে চাইলে আরও বেশি আর্থিক পরিষেবার প্রয়োজন হবে,' তিনি বলেন।
যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশকে একটি আকর্ষণীয় দেশ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের উচিত হবে পুঁজিবাজারে প্রবেশকে আরও সহজসাধ্য করে তোলা।
দেশের পুঁজিবাজারে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে ডিকসন বলেন, বর্তমানে এ দেশের পুঁজিবাজার খুবই সংকুচিত এবং খুচরা বিক্রেতাদের উপর অনেক বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল। তার মতে, 'এটি একটি ক্যাসিনো-সদৃশ মার্কেট।'
ডিকসন আহ্বান জানান এমন আরও অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার, যেখানে সঞ্চয়কারীরা বিনিয়োগ করতে পারবে।
'আর্থিক বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো বেসরকারি খাত, এবং সেজন্য আপনাদের প্রয়োজন একটি উন্নত পুঁজি বাজার। ব্যক্তিগত পুঁজি বৃদ্ধির জন্য লন্ডন হবে একটি দারুণ জায়গা,' তিনি বলেন।
মিশ্রাও একই অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, বর্তমানে দেশে বেশ কিছু পেনশন স্কিম রয়েছে, যেখানকার অর্থ স্বল্প-প্রদায়ক খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। তার মতে, এর পরিবর্তে আরও উচ্চ-প্রদায়ক কোনও খাতে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে হাইকমিশনার ডিকসন বলেন, দেশের পুঁজি বাজারে বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার জন্য যথাযথ নীতিমালার প্রয়োজন, এবং নির্দিষ্ট কিছু আইনেরও সংশোধন আবশ্যক।
'আমরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একটি সিস্টেম তৈরিতে সাহায্য করতে পারি। যুক্তরাজ্যের এ খাতে প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে।'
হাইকমিশনারের মতে, বিনিয়োগের পরিবেশ মুনাফা সৃষ্টি ও তা স্বদেশে প্রেরণের পক্ষে আরও বেশি অনুকূল করে তুলতে হবে।
বাংলাদেশ যে পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, তার প্রশংসা করে ডিকসন বলেন, 'আমার মনে হয় আপনারা যদি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে তাকান, এটি সম্ভব হয়েছে মূলত বিশাল সংখ্যক অর্ধ- ও স্বল্প-দক্ষ কর্মীদেরকে বড় কারখানাগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দেয়ার মাধ্যমে।'
বাংলাদেশে যে ১০০টি নতুন ইকোনমিক জোন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে, সেটিকে একটি ভালো পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করে মিশ্রা বলেন, প্রধান ফোকাস রাখতে হবে ছোট ছোট খাতগুলোতে উন্নতির, তারপর সেখান থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার।
অবশ্য ব্রিটিশ হাই কমিশনার বৈচিত্র্য আনয়নের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সিংহভাগ সাফল্যই এসেছে একটি খাত থেকে, কিন্তু গত বছর দেখা গেছে সেই খাতটির অবস্থা কতটা ভঙ্গুর।
হাতেগোনা অল্প কিছু দেশের সীমিত ক্রেতা-গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন ডিকসন। তিনি অন্যান্য খাতের কথাও উল্লেখ করেন যেখানে বাংলাদেশ ভালো করছে।
সিরামিকস ও ওষুধ খাতে বাংলাদেশের সাফল্যের উপর আলোকপাত করেন তিনি, এমনকি এ-ও যোগ করেন যে বাংলাদেশ এখন বাইসাইকেলও রপ্তানি করছে।
'উৎপাদন কাঠামোকে নতুন ও ভিন্ন ভিন্ন খাতেও বিস্তৃত করতে হবে। আর সেজন্য যেটি প্রয়োজন তা হলো মৌলিক অবকাঠামো। উন্নত রেল যোগাযোগ, উন্নত সড়ক যোগাযোগ।'
জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের পরিকল্পনা হলো বিশ্বব্যাপী কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা। তিনি আরও যোগ করেন যে বাংলাদেশ অন্তত কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি উপকূলীয় বায়ু ও হাইড্রোশক্তিকে সামনের দিনগুলোর প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে অভিহিত করে বলেন, বাংলাদেশ কেবল ভুটানের কাছ থেকেই ৪০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ পেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে একটি আঞ্চলিক চুক্তিও থাকতে হবে বলে তিনি জানান।
'বৈশ্বিকভাবে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যেন প্যারিস চুক্তিতে প্রয়োজনীয় প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা করতে পারি,' ডিকসন বলেন।
রোহিঙ্গা ইস্যুকে 'ট্র্যাজিক' উল্লেখ করে বলেন, 'আমরা নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের প্রবল সমর্থক।'
হাই কমিশনার জানান, যুক্তরাজ্য তার সামর্থ্যের মধ্যে সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করছে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার, কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে দেশটিতে নিরাপত্তার অভাব আরও প্রকট হয়ে উঠেছে, যার ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারটিও থমকে গেছে।
'আমার মনে হয় বিশ্ব এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে (রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে)। ফলে মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ আরও দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি।'
ডিকসন প্রতিশ্রুতি দেন যে রোহিঙ্গা ইস্যুটি যুক্তরাজ্য ভুলে যাবে না।
টিবিএসের অফিসে আগত হাই কমিশনারের দলে আরও ছিলেন হাই কমিশনের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপ-প্রধান খালিদ মুস্তাফিজ গাফফার, প্রেস সেকশনের প্রধান ফ্রান্সিস জ্যাকস, এবং সিনিয়র প্রেস অফিসার ও বাঙালি মুখপাত্র মেহের জেরিন।
হাই কমিশনারের টিবিএস অফিস পরিদর্শন ও পরবর্তী সৌজন্য সাক্ষাতে অন্যান্যদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন টিবিএস সম্পাদক ইনাম আহমেদ, নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার খান, এবং ব্যবস্থাপনা সম্পাদক চৌধুরী খালেদ মাসুদ।