সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমেছে ৩ শতাংশের বেশি
৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ বা ৭ হাজার ৫০১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বরাদ্দ কমিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
এর ফলে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমে হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতে এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা বা কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নের ১১ হাজার ৬২৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা হিসাব করলে এডিপির বরাদ্দ দাঁড়ায় ২ লাখ ৯ হাজার ২৭১ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে এবং অন্যান্য মন্ত্রী ও সচিবরা শেরে বাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষ থেকে এনইসি সভায় অংশ নেন।
পরে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী সংশোধিত এডিপির বিষয়ে সংবাদিকদের অবহিত করেন।
এ সময় জানানো হয়, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলার সঙ্গে যুক্ত প্রকল্পগুলোকে সংশোধিত এডিপিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন, আইসিটি শিক্ষার উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাসকরণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
এসময় জানানো হয়, উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারি তহবিল থেকে অর্থ ব্যয়ের অগ্রহী থাকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এ কারণে সংশোধিত এডিপিতে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ থেকে এবারও বরাদ্দ কমানো হয়নি। সংশোধিত এডিপিতে সরকারি তহবিলের ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
মূলত বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ থেকেই বরাদ্দ কমানো হয়েছে। মূল এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ ছিল ৭০ হাজার ৫০১ কোটি ৭২ লাখ টাকা, যা সংশোধিত এডিপিতে কমে ৬৩ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।
২০২০-২১ অর্থ বছরের এডিপি এবং সংশোধিত এডিপি বরাদ্দ থেকে দেখা যায়, গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিশীলতা বাড়াতে এবং অনেক বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের অনকূলে এডিপির তুলনায় সংশোধিত এডিপিতে সরকারি তহবিল থেকে ৫ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা কমানো হয়েছে।
দেশের সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের লক্ষ্যে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের অনকূলে সরকারি তহবিল থেকে ৯৫০ কোটি টাকা বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ কমানো হয়েছে।
একইভাবে ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে ২৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সরকারি তহবিলের বরাদ্দ বেড়েছে। ৩২ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সরকারি তহবিলের বরাদ্দ কমেছে। দুটি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিডিপি'র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, কোভিডের মধ্যে এডিবিতে সরকারি বরাদ্দ কমেনি এটা ভালো দিক। তবে বৈদেশিক সহায়তার ব্যবহারেও দক্ষতা বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, কোভিডে পরিস্থিতিতে এখন সরকারি বিনিয়োগ অর্থ যত বেশি ব্যয় হবে অর্থনীতির কর্মকাণ্ড তত চাঙ্গা হবে। তবে অর্থ ব্যয়ে গুণগতভাবে হচ্ছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। কারণ অর্থ বছরের আর মাত্র চার মাস বাকি। অথচ এডিপি বাস্তবায়ন হার খুব কম।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, অর্থ বছরের জানুয়ায়ী পর্যন্ত মোট এডিবি বরাদ্দে 32% অর্থ ব্যয় হয়েছে, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
সর্বোচ্চ বরাদ্দ
পর্যালোচনা দেখা গেছে, সংশোধিত এডিপিতে সর্বোচ্চ ৪৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পরিবহন খাতে, যা মোট সংশোধিত এডিপি বরাদ্দের ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ণ খাতে। এখাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৬ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা (১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ)।
এর পর তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৪ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা ( ১২ শতাংশ)। এরপর বিদ্যুৎ খাতে ২১ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা (১১ শতাংশ), পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগে ১৮ হাজার ২৯০ কোটি টাকা (৯ শতাংশ), স্বাস্থ্য পুষ্টি খাতে ১৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকা ( ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ), বিজ্ঞান , তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে ১১ হাজার ৫৭৬ কোটি (৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ), কৃষি খাতে ৭ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ( ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সর্বোচ্চ বরাদ্দ স্থানীয় সরকার বিভাগে
সংশোধিত এডিপিতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। বিভাগটি মোট ৩৪ হাজার ১৭০ কোটি ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে, যা মোট এডিপি বরাদ্দের ১৭ দশমিক ৪১ শতাংশ।
২৫ হাজার ৭৬১ কোটি ৪২ লাখ টাকা বা এডিপির ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা বিদ্যুত বিভাগ বরাদ্দ পেয়েছে হাজার ৯৩৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
এর বাইরে বরাদ্দের শীর্ষ দশের মধ্যে থাকা রেলপথ মন্ত্রণালয় ১১ হাজার ৯৮৮ কোটি ৩৫ লাখ, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ১১ হাজার ৯৭৯ কোটি ৩৪ লাখ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ১০ হাজার ৯০৩ কোটি ৬৯ লাখ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১০ হাজার ৬৮৫ কোটি ৮১ লাখ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ৮ হাজার ৬৮৫ কোটি ২১ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে।
ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ
পদ্মা রেল লিংক, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর সম্পর্কিত দুটি প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে এডিপি'তে। তবে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের বরাদ্দ কমানো হয়েছে।
সংশোধিত এডিপিতে এই প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ ৩৫ হাজার ৭৯১ কোটি থেকে ২৯ হাজার ৪২৪ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়েছে।
তবে আরেক ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্প এমআরটি-৬ এর জন্য বরাদ্দ অপরিবর্তিত রয়েছে।
সংশোধিত এডিপিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বরাদ্দ পাঁচ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২,১০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
তবে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের বরাদ্দ ১,৮০১ কোটি টাকা বেড়ে ৫ হাজার ৪৫৫ কোটিতে দাঁড়িয়েছে, যা মূল এডিপিতে ছিল ৩ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের বরাদ্দ ৫,৮২৪ কোটি টাকা কমে এক হাজার ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা হয়েছে। মূল এডিপিতে প্রকল্পটির বরাদ্দ করা হয়েছিল ১৫,৯৯১ কোটি টাকা।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের বরাদ্দ ৫১০ কোটি টাকা কমে ৯৯০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা যা মূল এডিপি থেকে ৫২৮ কোটি টাকা বেশি।
পায়রা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে ৬৫২ কোটি টাকা, মূল বরাদ্দে যা ছিল ৩৫০ কোটি টাকা।
প্রকল্প সংখ্যা
১৭২ টি নতুন প্রকল্পসহ এখন সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮৮৬টি প্রকল্প । এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ১৬৪০টি , কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১৪৫টি , নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প ১০১টি।
সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত প্রকল্প
চলতি সংশোধিত এডিপিতে সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত প্রকল্পের ৪৪২টি । এসব প্রকল্পে যে কোনোভাবে সময়ে মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
পরিকল্পনা বিভাগের সচিব জানান, পরিকল্পনা ও আর্থিক শৃংখলার স্বার্থে সমাপ্তির জন্য চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত প্রকল্পে মেয়াদ বৃদ্ধির বাড়ানো হবে না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছে। দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রকল্প পরিচালকদের প্রকল্প এলাকায় থাকারও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।