রপ্তানি বিলের হিসাব মেলাতে শর্ট শিপমেন্টের তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক
অপ্রত্যাবাসিত ও মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানি বিলের প্রকৃত হিসাব করতে রপ্তানি পণ্যের শর্ট শিপমেন্টের তথ্য খুঁজছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি অর্থ বাড়তে থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক রপ্তানিকারক ও ব্যাংকগুলোর কাছে এ তথ্য চেয়েছে।
ব্যাংকের এলসিতে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হওয়ার কথা উল্লেখ থাকে, প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে কম রপ্তানি হওয়াকে বলা হয় শর্ট শিপমেন্ট।
এক হিসাবে দেখা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যত মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, তার মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলার দেশে আসেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র অবশ্য বলেছেন, এই পরিমাণ ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাকিতে বিক্রি এবং বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সময়মত পাওনা পরিশোধ না করার কারণে রপ্তানি বিল সময়মত আসেনি। যদিও তাদের বিরুদ্ধে বাড়তি বিনিময় হার নেওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃত দেরিতে রপ্তানি আয় আনার অভিযোগও রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও(আইএমএফ) এই ৩ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় কেনো দেশে আসেনি তা নিয়েছে প্রশ্ন তুলেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সঙ্গে গত ২৫ এপ্রিলের বৈঠকে এ প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয় দেশে আনার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চান ঢাকা সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দল।
শিপমেন্ট ও রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনের মধ্যে পার্থক্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও ভাবিয়ে তুলেছে। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ও প্রাক জাহাজীকরণ রপ্তানি অর্থায়ন তহবিলের ঋণ পাওয়ার সঙ্গে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রপ্তানি আয় দেশে নিয়ে আসার শর্ত জুড়ে দিয়েছে। যারা সময়মত রপ্তানি আয় আনতে পারবে না, তারা এই তহবিল থেকে ঋণ পাবে না। একইভাবে যখন যে রপ্তানি আয় দেশে আসবে, তার বিনিময় হার হবে সেই সময়ের এমন নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় প্রবাহ কম হওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমছে। এমন পরিস্থিতিতে গত ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশন ডিপার্টমেন্ট সকল ব্যাংক ও রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী সমিতিগুলোকে চিঠি দিয়ে শর্ট শিপমেন্টের তথ্য দেওয়ার তাগাদা দিয়েছে। এরজন্য দুই মাসের কিছু বেশি সময় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী ৬ জুলাইয়ের মধ্যে এসব তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে।
এমন নোটিশ জারি এবারই প্রথম নয়; এর আগেও গত ১৭ জানুয়ারি এক চিঠিতে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে শর্ট শিপমেন্টের তথ্য দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংক ও রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে সকল তথ্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক গতকাল স্পষ্ট করেছেন, দেশের অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি বর্তমানে ৩ বিলিয়ন নয় বরং ১.৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
রোববার ঢাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সমাপনী বৈঠক শেষে তিনি এ কথা বলেন।
ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন টিবিএসকে বলেন, সম্প্রতি রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনে কোনো কোনো রপ্তানিকারক কিছুটা বাড়তি সময় নিচ্ছেন। যেটা কমিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অন্যান্য ব্যাংকগুলোও কাজ করছে।
এ বিষয়ে নিটওয়্যার রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাস্তবভিত্তিক অনেক কারণেই শর্ট শিপমেন্ট হয়ে থাকে। তবে তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। অবশ্যই ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ থেকে শর্ট শিপমেন্টে সার্টিফিকেট নিয়ে ব্যাংকে জমা দেয়। এক্ষেত্রে কিছু সময় লাগে। এটা যাতে দ্রুত ও হালনাগাদ করা যায়, সেজন্য বিকেএমইএ সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে।
"বাকিতে বেচাকেনা, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে কিছু রপ্তানি আয় নির্ধারিত সময়ে দেশে আনা সম্ভব হয়ে ওঠে না," যোগ করেন তিনি।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, তবে রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ব্যাংক যে শর্ত দিয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। এটি খুব ঢালাও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ওভেন পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় শর্ট শিপমেন্টের ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল। ওই সময়ের অনেক তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নেই। যে কারণে রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনের হিসাবে সমস্যা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা তথ্য উপাত্ত কাস্টমসকে দিয়েছে। কিন্তু কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জনবলের অভাবে অ্যাসাইকুডা সার্ভারে সেগুলো সংযুক্ত করতে পারছে না। এ নিয়ে চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, অটোমশেনরে আগ র্পযন্ত, অর্থাৎ ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ হাজারের বেশি এলসির বিপরীতে শর্ট শিপমেন্টের ঘটনা হয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে, অনেক অপডক বন্ধ হয়ে গেছে বা অনেকের ডকুমেন্ট সংরক্ষিত নেই। আবার সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট পরিবর্তন হওয়াতে রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো রপ্তানিকারক তথ্যও হারিয়ে ফেলেছেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "এসব প্রতিবন্ধকতা বিবেচনায় নিয়ে কাস্টমসকে একটি হালনাগাদ প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বিজিএমইএর পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলেও আইনগত কারণে তা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এই সমস্যা সমাধানে আইন সংশোধন করতে হবে।"