বিশ্বকাপে জোরাল হচ্ছে 'বয়কট কাতার' ক্যাম্পেইন: ফিফা ও কাতার কি বিচলিত?
কাতার বিশ্বকাপের দামামা বেজে উঠেছে। ক্রীড়া জগতের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ এ আয়োজনকে কেন্দ্র করে ফুটবল ভক্তদের উৎসাহের সীমা নেই, শেষ মুহূর্তে অনেকেই ব্যস্ত জার্সি-ক্যাপ ও পতাকাসহ প্রিয় দলের নানা আনুষঙ্গিক জিনিস কিনতে। আর যারা বিত্তশালী, তারা ইতোমধ্যেই বুক করে ফেলেছেন কাতারের টিকিট। আর মাত্র সপ্তাহখানেক পরেই শুরু হতে যাচ্ছে তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই মহারণ।
কিন্তু এতসব আয়োজনের মধ্যেও একটি বড় সংখ্যক ফুটবলভক্ত যে বিশ্বকাপ বয়কটের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন, তা কী আপনি জানেন? ইউরোপের ক্লাবগুলোর বিভিন্ন ম্যাচে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে 'বয়কট কাতার ২০২২' লেখা বিশাল বিশাল ব্যানার। স্টেডিয়ামে উপস্থিত ফুটবলভক্তদের এই বয়কট ক্যাম্পেইন লাইভ দেখতে পাচ্ছেন টেলিভিশনের পর্দায় ক্লাবের খেলা দেখা লাখ লাখ দর্শক।
কাতার বিশ্বকাপ বয়কটকে কেন্দ্র করে সেই সব ক্লাব, সমর্থক ও খেলোয়াড়রা এক হয়েছেন, যারা কিনা আয়োজক দেশ কাতারের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার।
বয়কট কাতার ক্যাম্পেইনের একজন অংশগ্রহণকারী ও অ্যামেচার ক্লাব মেইনজ-এর ফুটবলার স্টেফান শার্মার বলেন, "বিশ্বকাপ যত এগিয়ে আসছে, আমাদের এই বার্তা আরও জোরাল হচ্ছে। গত দুই-তিন মাস যাবত আমরা এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি এবং আমাদের এই ক্যাম্পেইন আরও গতিবেগ পাচ্ছে।"
বলে রাখা ভালো, কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজন করা নিয়ে শুরু থেকেই চলছে বিতর্ক। কাতারকে নিয়ে বিতর্কিত ইস্যুগুলো যাতে জনসাধারণ ভুলে না যায়, সেই চেষ্টা করছেন যেসব স্বেচ্ছাসেবীরা, শার্মার তাদেরই একজন! সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ কাতারের বিরুদ্ধে ফিফার প্রতিনিধিদেরকে ঘুষ দেওয়ার কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আনে; যদিও দোহা এবং ফিফা এ অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে।
নারী অধিকার, এলজিবিটি কমিউনিটি ও অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার, গণতন্ত্র এবং কাতার বিশ্বকাপে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টেডিয়াম ব্যবহার ও পরিবেশের উপর এর প্রভাব-এর মতো বিষয়গুলো নিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাই এই 'বয়কট কাতার ২০২২' ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য।
বছর আটেক আগে ব্রাজিল বিশ্বকাপে জার্মানির নেতৃত্ব দেওয়া ফুটবলার ফিলিপ লাম সম্প্রতি জানিয়েছেন, তিনি জার্মানির অফিশিয়াল প্রতিনিধি বা ভক্ত হয়ে, কোনোভাবেই কাতারে যাবেন না। সাবেক জার্মান অধিনায়কের ভাষ্যে, "কোনো টুর্নামেন্ট আয়োজনের ক্ষেত্রে মানবাধিকারের বিষয়টিকে আগে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আর ঠিক এই বিষয়টিতেই দুর্বল অবস্থানে থাকা কোনো দেশকে যদি বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে আপনাকে ভাবতে হবে যে কোন মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।"
এদিকে স্পেন ও ফ্রান্সে একযোগে চলছে এ ক্যাম্পেইন, যেখানে বেশ কয়েকটি শহর বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো দেখাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং ফুটবলভক্তদের এই ক্যাম্পেইনে যোগ দিতে আহ্বান জানাচ্ছে।
আগামী ২০ নভেম্বর শুরু হতে যাওয়া কাতার বিশ্বকাপে অংশ নিবে ৩২টি দল। বিশ্বকাপের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে এ ধরনের বয়কট ক্যাম্পেইন এই বিশাল আয়োজনের উপর কতটা প্রভাব ফেলবে তা একটি বড় প্রশ্ন।
স্টেফান শার্মার বলেন, "ফিফা ও কাতারের কাছে এই বয়কট ক্যাম্পেইন অবশ্যই পীড়াদায়ক কারণ এর ফলে বিশ্ববাসীর কাছে তাদের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। তারা চায় এই বিশ্বকাপ হবে একটি দারুণ মজাদার উৎসবের মতো যেখানে সবকিছুই সুন্দরভাবে উদযাপিত হবে। কিন্তু এখন তারা দেখছে যে অনেকগুলো দেশে, অনেক অনেক মানুষই এই বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছে।"
জার্মানি ও কাতারের মধ্যে কূটনৈতিক জটিলতা
বিশ্বকাপ আয়োজ়ন নিয়ে কাতার যে শুধুমাত্র ফুটবল ভক্তদের কাছ থেকেই চাপে আছে তা নয়। গেল অক্টোবরে জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফেজা একাধিকবার কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের কড়া সমালোচনা করেছেন এবং এর ফলে দোহায় থাকা জার্মান রাষ্ট্রদূতের কাছেও অভিযোগ জানানো হয়েছে।
তবে চলতি সপ্তাহে ন্যান্সি ফেজা কাতার সফর থেকে ফিরে এসে জানান যে তিনি কাতারে অবস্থানরত জার্মান এলজিবিটি কমিউনিটির পর্যটকদের জন্য 'সেফটি গ্যারান্টি' বা তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়েছেন। এদিকে আয়োজকরাও বারবার দাবি করে আসছেন যে কাতারে আগত সকল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সব ভ্রমণকারীদের একই সম্মান দেওয়া হবে। অবিবাহিত জুটিদেরও একসাথে থাকার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে না।
'জার্মানির জনসাধারণকে ভুল তথ্য দিচ্ছেন সরকারদলীয় রাজনীতিবিদরা', অথচ 'শক্তিসম্পদ নিয়ে আমাদের সাথে অংশীদারিত্ব বা বিনিয়োগ নিয়ে জার্মান সরকারের কোনো অসুবিধাই নেই' - কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের একদিন পরেই কাতার সম্পর্কে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেন ন্যান্সি ফেজা।
কাতার এই মুহূর্তে বিশ্বের সর্ববৃহত প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ এবং ইউরোপের দেশগুলোর সাথে কাতারের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের লেনদেন রয়েছে। ২০২১ সালে ইউরোপে মোট এলএনজি আমদানির ২৪ শতাংশ ছিল কাতার থেকে।
ফ্রাঙ্কফুর্টার আলেগমাইনে জাইটো'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কাতারের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান আল-থানি বলেন, "আমরা তাদের এই দু'মুখো আচরণ দেখতে দেখতে বিরক্ত।" তিনি দাবি করেন, বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে গত ১২ বছরে এক ধরনের বিরোধিতামূলক সিস্টেমেটিক ক্যাম্পেইনের শিকার হয়েছে কাতার, যা অন্য কোনো দেশ কখনো হয়নি।
আল-থানি বলেন, "এটা একটা পরিহাসের ব্যাপার যে ইউরোপের যেই দেশগুলো নিজেদের উদার, গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে, তারাই এ ধরনের সুরে কথা বলছে। তাদের এই আচরণ খুবই উদ্ধত ও বর্ণবাদী।"
কাতারের অভিবাসী কর্মীদের অধিকারের পক্ষে কাজ করেন এই সাবেক অধিনায়ক
ফিনল্যান্ডের জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক টিম স্পারভ বর্তমানে কাতারের অভিবাসী কর্মীদের অধিকার রক্ষার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। ২০২১ সালে তার অবদানের জন্য তিনি 'প্লেয়ারস' ইউনিয়ন' অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন।
২০১৯ সালের শুরুতে স্পারভের সতীর্থ রিকু রিসকি যখন নৈতিক কারণে কাতারে একটি অনুশীলন ক্যাম্পে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানান, তখনই প্রথম এ বিষয়টির সঙ্গে জড়িত হন স্পারভ।
ইউরোনিউজকে স্পারভ বলেন, "সেসময় আমি জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলাম, তাই এটা নেতৃত্বেরও প্রশ্ন ছিল। সাংবাদিকরা শুধু আপনার ম্যাচ নিয়ে প্রশ্ন করছে না বলেই আপনি পালিয়ে যেতে পারেন না। তাই আমি এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধান করেছি, নিজে জানার চেষ্টা করেছি এবং কাতারের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেছি।"
উল্লেখ্য যে, কাতার ২০১০ সালে কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে অনুমোদন পাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৬৫০০ অভিবাসী শ্রমিক মারা গেছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর। কিন্তু জাতিসংঘ বলছে, এই সংখ্যাটা শুধুই মৃতের হিসাব; তারা যে বিশ্বকাপ আয়োজনের কাজ করতে গিয়ে বা স্টেডিয়াম নির্মাণ কাজের সময়ই মারা গেছেন তা নিশ্চিত নয়। এদিকে কাতারের দাবি, মৃত অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে শুধু ৩৭ জন শ্রমিক বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম নির্মাণকাজের সময় মারা গেছেন।
সম্প্রতি ফিফা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোকে একটি চিঠি প্রদানের মাধ্যমে সতর্ক করেছে শুধুমাত্র খেলার উপর নজর দিতে, অন্য কোনো বিষয়ে নয়।
স্পারভ বর্তমানে স্পার্টা প্রাগ ক্লাবের জুনিয়রদের কোচিং এর দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি মনে করেন, কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরুদ্ধে এত এত জনমত দেখে ফিফা এখন 'বিচলিত'।
"ফিফার চিঠিটি পড়ে মনে হয়েছে এটি খুবই উদ্ধত ভঙ্গিতে লেখা। চিঠিটি পড়ে মনে হবে তারা এখন খানিকটা বিচলিত এবং এই মুহূর্তে বিশ্বকাপ বয়কটের যে ক্যাম্পেইন চলছে এবং মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছে, সেই বিষয়টি ফিফার পছন্দ হচ্ছে না", বলেন স্পারভ।
ফিফার চিঠির জবাবে ইউরোপের দলগুলো নিজেরা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে এখনো কিছু প্রশ্নের উত্তর তাদের জানতে হবে। একই সাথে কাতার সরকারের কাছ থেকে ফুটবল সমর্থক ও এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির সমর্থকদের নিরাপত্তার ব্যাপারেও নিশ্চয়তা পেতে হবে তাদের।
ফিনল্যাডের সাবেক অধিনায়ক টিম স্পারভ বলেন, "আমার মনে হয়, কোনোকিছু বয়কটের জন্যও একটা স্থান-কাল রয়েছে। আর এটা এখন শেষ মুহূর্ত, তাই বয়কট ছাড়াও অন্য উপায় আছে বলে আমি মনে করি। আমি দেখতে চাই কতজন খেলোয়াড়, কোচ, ফেডারেশন ও দল তাদের নিজস্ব সুযোগ ও উপায় ব্যবহার করে বিতর্কিত ইস্যুগুলোকে তুলে ধরে সবার সামনে। তারা যদি একেবারেই মুখ বন্ধ করে রাখে, তাহলে তা খুবই হতাশাজনক হবে। সেটা হবে সুযোগের অপব্যবহার এবং পরে তারা এ নিয়ে অনুশোচনা করবেন।"
বিগত বছরগুলোতে কাতারে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা ও করুণ অবস্থার কথা বেশ ভালোভাবেই নথিভুক্ত করা আছে। এর জবাবে কাতার সরকার দেশের শ্রম আইন সংশোধন করেছে এবং সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করেছে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, কাতারে এখনো অভিবাসী শ্রমিকদের নিপীড়ণের কাজটি চলছে এবং যে শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে তা অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
বিশ্বকাপ 'বয়কট' ক্যাম্পেইন বলতে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে?
"বয়কট কাতার ২০২২ ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য এই ছিল না যে তারা পুরো টুর্নামেন্ট আয়োজনই বন্ধ করতে চায়। কারণ এই টুর্নামেন্ট ক্রীড়াজগত, বিপণন ও ভূ-রাজনীতির জন্য একটি বড় চালিকাশক্তি। তাই টুর্নামেন্ট থামিয়ে দেওয়া হতো স্রেফ একটি 'উদ্ভট কল্পনা", বলেন স্টেফান শার্মার।
কিন্তু এ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তারা মানুষকে নিজেদের মতো করে বিশ্বকাপ বয়কট করতে উৎসাহিত করছে- মন্তব্য করেন শার্মার। তিনি বলেন, "আমি এই বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচই দেখবো না, এমনকি আমাদের মেইনজ ক্লাব নিজেরা অন্যান্য দলের সাথে প্রীতি ম্যাচের মতো করে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি-ফাইনাল ও ফাইনাল খেলবে এ সময়।"
বয়কট ক্যাম্পেইনের পেছনে যারা রয়েছেন, তারা আশা করছেন যে ফুটবলভক্তরা এবার বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো দেখবেন না এবং যে পাবগুলোতে ম্যাচ সম্প্রচার করা হতো, সেখানে নৈতিক কারণে এবারের ম্যাচগুলো দেখানো হবে না। এর বদলে পাবগুলোতে ফুটবলভক্তদের জন্য আলাদা কিছু সৃজনশীল খেলাধুলার আয়োজন করা হবে।
তাদের ভাষ্যে, "বয়কট কাতার হচ্ছে ছোট ছোট অনেকগুলো পদক্ষেপের সমষ্টি, কিন্তু একসাথে মিলে আমরা অনেক জোরাল আওয়াজ তুলতে পারবো এবং এর একটি ইতিবাচক প্রভাব থাকবে।"
সূত্র: ইউরো নিউজ