নেতৃত্বে আগ্রহ নেই কারও, দুর্জয়-দেবব্রতর হাতেই কোয়াব
ক্রিকেটারদের অধিকার সংরক্ষণের সংগঠন ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) বার্ষিক সাধারণ সভা, সেখানে প্রধান অতিথি নাজমুল হাসান পাপন। সংগঠনটি পরিচালনার দায়িত্বে কেউ আসতে আগ্রহী কিনা, প্রশ্নটি করতে হলো বিসিবি সভাপতিকে। বিসিবির কাছ থেকে অধিকার নিশ্চিতসহ আরও কিছু উদ্দেশ্যে যে সংগঠনের সৃষ্টি, সেই সংগঠনের নির্বাচনে প্রার্থী হতে আহ্বান করতে হলো বিসিবি সভাপতিকে! যা অনেকের কাছেই অবাক করার মতোই ব্যাপার।
তবে এরচেয়েও বড় অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, বিসিবি সভাপতির আহ্বানে উপস্থিত বর্তমান-সাবেক কোনো ক্রিকেটারই সাড়া দেননি। অর্থাৎ, কেউ-ই নির্বাচন করতে চান না। কোনো সাড়া না পেয়ে হতাশই হলেন নাজমুল হাসান। বললেন, 'নির্বাচনের জন্য কি কেউ নেই! মাত্র একজন হলে তো নির্বাচন হবে না। আপনারা বলেন, আমরা নির্বাচন আয়োজন করি।' কোয়াবের নির্বাচন আয়োজন করার কথা বললেন বিসিবি সভাপতি, এটা নিশ্চয়ই আরও বড় অবাক করার মতো ব্যাপার!
বরাবরের মতোই যেটা অবাক করার মতো নয়, সেটা হলো কোয়াবের নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন না আসা। আরও একবার তেমনই হয়েছে। কোয়াব গঠনের ১৯ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) আরও একবার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে পুরনো দুজনের হাতে। নির্বাচন না হওয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি হয়েছেন ২০১৪ থেকে একই পদে থাকা বিসিবি পরিচালক ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়। সাধারণ সম্পাদক রয়ে গেছেন বিসিবির বেতনভুক্ত ম্যাচ রেফারি দেবব্রত পাল।
এজিএমে বারবার অনুরোধ করেও নতুন নেতৃত্ব তো খুঁজে পাওয়া গেলোই না, উল্টো উপস্থিত বর্তমান-সাবেক ক্রিকেটাররা হাত তুলে দুর্জয় ও দেবব্রতকে সম্মতি জানান। কেন সংগঠনটির নেতৃত্বে কেউ আসতে চান না, সেটা বরাবরের মতো রহস্যজনক ব্যাপারই থেকে যাচ্ছে। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর নেই কারও কাছেই। অথচ ২০১৯ সালের অক্টোবরে ক্রিকেটারদের আন্দোলনের ১৩ দফার দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল কোয়াবের কমিটি বিলুপ্ত করে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করা।
মাশরাফি বিন মুর্তজা ছাড়া সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে সেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহীম, তামিম ইকবালসহ স্থানীয় সব ক্রিকেটার। অথচ আমন্ত্রণ জানানোর পরও এসব সিনিয়র ক্রিকেটারদের কেউ-ই কোয়াবের এজিএমে অংশ নেননি। দেশে থাকা মাশরাফি, মাহমুদউল্লাহও আসেননি। তাদের না আসার কারণ জানতে চাইলে দুর্জয় বলেন, 'আমাদের তাদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তাদেরকে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দিয়েছি। তাদের সাথে আমাদের ব্যক্তিগতভাবে কথা হয়েছে। তামিম, সাকিব যাদেরকে আমরা রিচ করতে পেরেছি, তারা তাদের থাকতে না পারার বিষয়টি জানিয়েছে। একটা সিরিজ শেষ হয়েছে, তাদের পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য থাকতে পারেনি। ওরা এ পর্যন্তই আমাদের ইনফর্ম করেছে।'
ক্রিকেটারদের আন্দোলনের এক নম্বর দাবি ছিল কোয়াবের নির্বাচন ছাড়াও নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও দেবব্রত পালের পদত্যাগ। সেই সঙ্গে কোয়াবের কোনও কার্যক্রম না থাকায় ওই কমিটিকে বিলুপ্ত করে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কমিটি দেওয়া। যদিও নাজমুল হাসান বলেছিলেন, 'কোয়াব আমাদের অধীনে নেই। তাই এক নম্বর দাবি নিয়ে বিসিবির কিছু করার নেই।' সাকিব অবশ্য আশার কথা শুনিয়েছিলেন, 'আমরা দুর্জয় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাদের সঙ্গে একমত। আমাদের একটা নির্বাচন করতে হবে। জাতীয় লিগের পর ফাঁকা সময়ে আমরা বর্তমান ক্রিকেটারদের নিয়ে নতুনভাবে কমিটি গঠন করবো।' চার বছর পর নির্বাচনের আলোচনা উঠলো, কিন্তু এতে আগ্রহ দেখালেন না কোনো ক্রিকেটারই।
গঠনতন্ত্রে সংশোধনী আনার পর ২০১৪ সালে বিসিবির স্বীকৃতি পায় কোয়াব। তখন থেকেই কোয়াবের দায়িত্বে দুর্জয় ও দেবব্রত। ৯ বছর পর হওয়া এজিএমেও তাদের কাঁধে উঠলো দায়িত্ব, আরও চার বছর দায়িত্ব পালন করবেন তারা। ক্রিকেটারদের আন্দোলনের পর দুর্জয় বলেছিলেন, নতুন ক্রিকেটাররা নেতৃত্বে আসতে চাইলে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন তিনি। কিন্তু কারোরই দেখা মিললো না, তাই পুরনো কথাই বলে গেলেন দুর্জয়।
কোয়াবের সভাপতি পদে নতুন করে মনোনীত হওয়ার পর সাবেক এই ক্রিকেটার বলেন, 'নতুনরা কেউ এলে আমি খুশি হতাম। নতুনরা কেন আসে না এটা ওরা বলতে পারবে। ওদের প্রশ্নের উত্তর তো আমি দিতে পারব না। আসার জন্য দরজা খোলা ছিল। তাদের আমরা আহ্বান জানিয়েছি, যে কেউ আগ্রহী থাকলে একটা প্রক্রিয়া আছে, সেই প্রক্রিয়া অনুযায়ী তারা যদি প্রার্থিতা ঘোষণা করত বা আসত, আমি তো এখনও চাই, এখনও যদি কেউ আসে, আমরা আবারও চেষ্টা করব তাদের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য।'
কোয়াবের এজিএমে জাতীয় দলসহ সব পর্যায়ের ক্রিকেটাররা আমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ খেলে দেশে ফেরা জাতীয় দলের বেশিরভাগ ক্রিকেটারই ছিলেন না। উপস্থিত ছিলেন কেবল মেহেদী হাসান মিরাজ ও নাজমুল হোসেন শান্ত। সাবেক অধিনায়কদের মধ্যে আকরাম খান, খালেদ মাহমুদ সুজন, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, হাবিবুল বাশাররা উপস্থিত হন।
আতহার আলী খান, জাভেদ ওমর বেলিম, রকিবুল হাসানদের পাশাপাশি নাঈম ইসলাম, মার্শাল আইয়ুব, তুষার ইমরান, নুরুল হাসান সোহানরা উপস্থিত ছিলেন এজিএমে। নারী ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিলেন অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি, জাহানারা আলম, ফারজানা হক পিংকি। এজিএমে এসে সুসংবাদ পান তারা। এতোদিন শুধু পুরুষ ক্রিকেটাররা কোয়াবের অংশ থাকলেও এখন নারী ক্রিকেটাররা সদস্য হতে পারবেন এবং চাইলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।
দুর্জয় ও দেবব্রত আরেক দফায় দায়িত্ব পেলেও এজিএমে কোয়াবের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। আলোচনার ভিত্তিতে বাকি পদগুলো পূরণ করা হবে। এতোদিন কোয়াবের কার্যনির্বাহী কমিটি ছিল ১১ সদস্যের। এবারের এজিএমে গঠনতন্ত্রে সংশোধনী এনে আরও ৮টি পদ বাড়ানো হয়েছে। একজন সভাপতি, ৪ জন সহ-সভাপতি, একজন সাধারণ সম্পাদক, ২ জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, একজন সাংগঠনিক সম্পাদক, একজন কোষাধ্যক্ষ ও একজন ৬ জন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ২ জন সদস্য রাখা হবে কমিটিতে।
২০০৪ সালে কোয়াবের যাত্রা শুরু হয়। গেল ১৯ বছরে এবারই প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক এজিএম করলো সংগঠনটি। এর আগে ২০০৮, ২০১৪ সালে ঘরোয়াভাবে এজিএম অনুষ্ঠিত হয়, যদিও সেটার কোনো অনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। বিসিবির গঠনতন্ত্রে কোয়াব স্বীকৃতি পায় ২০১৪ সালে। ২০১২ সালে বিসিবিতে অ্যাডহক কমিটি দায়িত্ব নেয়। এরপর গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ক্যাটাগরি-৩ থেকে কোয়াবের একজন প্রতিনিধিকে বিসিবি পরিচালক হিসেবে নির্বাচন করার অধিকার দেওয়া হয়। ওই সময়ই ঘরোয়াভাবে এজিএম করে দায়িত্বে আসেন সভাপতি দুর্জয় ও সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত।