সংরক্ষিত মহাস্থানগড়ে হাজারো অবৈধ ঘরবাড়ি
হাইকোর্টের নির্দেশ উপেক্ষা করে বগুড়ায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট মহাস্থানগড় দূর্গ নগরীর সীমানার মধ্যে বাড়ি-ঘরসহ নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরি করছেন স্থানীয়রা। এ সব বাড়ি-ঘর তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রাচীন ইটের পাশাপাশি নানা ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন।
১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘন করে ওই দূর্গ নগরীতে অবকাঠামো তৈরির বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ ২০১০ সালে রিট করলে সংরক্ষিত এলাকায় অবৈধ সব নির্মাণ কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানায়, পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘন করে এ নগরীতে নির্মাণ করা হয়েছে অন্তত ৯৮৭টি বাড়ি-ঘরসহ নানা ধরনের অবকাঠামো। এর মধ্যে অন্তত ৭৬টি বাড়ি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে পাল ও সেনসহ নানা আমলে তৈরি ইটের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মুজিবুর রহমান জানান, জরিপে পাওয়া গেছে ৩৯৪ একরের এ দূর্গনগরীতে পাকা, সেমিপাকা ও মাটির বাড়িসহ পাঁচ ধরনের বাড়ি-ঘরের মধ্যেই দ্বিতল ভবন রয়েছে বেশ কয়েকটি।
মহাস্থান প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘরের কাষ্টডিয়ান রাজিয়া সুলতানা বলেছেন, স্থানীয় জনগণকে একাধিকবার হাইকোর্টের নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু প্রভাশালীদের সহযোগিতায় তারা বাড়ি-ঘরসহ নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরি করছেন।
"গত বছরের ১৯ মার্চ কাস্টোডিয়ান হিসেবে যাদুঘরের দায়িত্ব নেওয়ার পর অবৈধভাবে বাড়ি-ঘর তৈরি বন্ধের জন্য ৪৫ জনকে নোটিশ দিয়েছি; আর মামলা করা হয়েছে ২১টি।" বলেন রাজিয়া সুলতানা।
ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্ভাব্য তালিকায় থাকা এ প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটটিতে বিভিন্ন সময় খননে পাওয়া গেছে মৌর্যপূর্ব, মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন ও মুসলিমসহ বিভিন্ন আমলের ধাতব, পাথর ও মাটির তৈরি গুরুত্বপূর্ন প্রত্ন নিদর্শন।
আঞ্চলিক পরিচালক (রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ) ড. নাহিদ সুলতানা জানান, প্রাচীন এ নগরীকে রক্ষায় ভূমি অধিগ্রহনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা ব্যয় হবে এ কাজে।
দূর্গ নগরীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রায় দুই যুগ আগে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স যৌথ খনন দল দূর্গ নগরীর বেষ্টনি প্রাচীরের পূর্ব দিকে খননের সময় একটি মাটির চুলা পায়।
"এ চুলাটি যীশুখৃষ্টের জন্মের অনেক আগে তৈরি। সম্ভবত এটি এ দূর্গ নগরীতে মানুষের বসতির প্রথম চিহ্ন।'' বললের ড. নাহিদ সুলতানা।
ওই সময় খননে আরও পাওয়া যায় উত্তরাঞ্চলীয় চকচকে কালো মৃৎপাত্র, শুঙ্গ যুগের পোড়া মাটির ফলক, ঘরের ছাদে ব্যবহার করার জন্য টালি, ব্রোঞ্জের আয়না, নারীদের হাতের বালা, ছাঁচে ঢালাইকৃত ধাতব মূদ্রাসহ আরও অনেক কিছু।
সংরক্ষিত এলাকায় নির্মাণ কাজ বন্ধে নোটিশ জারি ও মামলা করার পর প্রশাসন কি ব্যবস্থা নিয়েছে এ প্রশ্নের জবাবে বগুড়া পুলিশ সুপার
আলী আশরাফ ভুঞা বলেন, ''যারা হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করবেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।''
মহাস্থান দূর্গনগরীর ভেতর যারা স্থায়ী বাড়ি নির্মাণ করেছেন তাদের একজন গড় মহাস্থান দক্ষিণপাড়া গ্রামের নাসির উদ্দিন। তার ছেলে শহীদুল ইসলাম বলেন, জমি হুকুম দখল করলে সরকারকে জমি দেয়া হবে। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশ থাকার পরও সরকার তা করছে না। আবার পূর্ব পুরুষদের জমিতে বাড়ি-ঘর করলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বাঁধা দিচ্ছেন।
"আমাদের জমি সরকার হুকুম দখল করুক অথবা বাড়ি-ঘর করার অনুমতি দেওয়া হোক, এটা আমাদের দাবি।" বললেন তিনি।
পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘন করে বাড়ি নির্মাণের অভিযোগ এনে কাজ বন্ধ করতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নোটিশ দেয় দূর্গ নগরীরর চান্দিপাড়াপ গ্রামের মোশারফ হোসেনকে। এ নোটিশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গেছেন তিনি। ২০১০ সালে হাইকোর্ট দূর্গ নগরী রক্ষায় যে নির্দেশ দিয়েছে তাতে দ্রুত জমি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অধিদপ্তর জমি অধিগ্রহন করছে না।
"আমার সংসার বড় হয়েছে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে। তাদের জন্য ঘর করতে পারছিনা, এ অবস্থায় আমরা এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই"। বললেন তিনি।
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে জমি অধিগ্রহনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হান্নান মিয়া বলেন, মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছে।