৮০-তে পা রাখলেন অমিতাভ বচ্চন: ফিরে দেখা বলিউডের 'শাহেনশাহ'র সংগ্রাম-সফলতার যাত্রা
ভারতীয় চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তী, অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের জন্মদিন আজ। সত্তরের দশকে বলিউড কাঁপানো এই গুণী অভিনেতা আজ ৮০ বছরে পা রাখলেন। কিন্তু অমিতাভ বচ্চনকে কী নির্দিষ্ট সময়ের ছকে বাঁধা যায়? আশি-তে এসেও তার পদচারণায় মুখর বলিউড। বলিউডের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অভিনেতাদের তালিকায় যার নাম অবশ্যই থাকবে, তিনি 'বিগ বি'।
অমিতাভ বচ্চনের ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে ভারতের ১৭ শহরে চলছে 'অমিতাভ উৎসব'। অমিতাভ বচ্চনের কিছু বিরল ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে সেই সাথে, যা এবারই প্রথম। মূলত চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদ, লেখক ও স্মারক আর্কাইভিস্ট এসএমএম অসাজার সংগ্রহে থাকা ৫০টি বিরল ছবি প্রদর্শিত হবে এ উৎসবে। প্রায় তিন দশক ধরে এসব স্মারক সংগ্রহ করে আসছেন অসাজা। গত ৮ অক্টোবর শুরু হওয়া এই উৎসব চলবে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত।
কিন্তু অ্যাংরি ইয়ং ম্যান থেকে বলিউডের শাহেনশাহ হয়ে ওঠার মাঝে অমিতাভ হরিবংশ বচ্চন পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ পথ। ১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদের এক হিন্দু-শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন অমিতাভ বচ্চন। তার বাবা হরি বংশ রাই বচ্চন ছিলেন নামকরা কবি এবং মা তেজি বচ্চন ছিলেন ফয়সলাবাদের শিখ-পাঞ্জাবি নারী। শৈশবে এলাহাবাদ, এরপর নৈনিতালের বোর্ডিং স্কুল শেরউড কলেজ হয়ে তরুণ অমিতাভ উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন দিল্লীর কিরোরি মাল কলেজে এবং অবশেষে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।
নৈনিতালের বোর্ডিং স্কুলে পড়ার সময়ই অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করার পরপরই সেই পথে পা বাড়াননি অমিতাভ বচ্চন। পড়াশোনা শেষে জীবিকা উপার্জনের জন্য যোগ দিয়েছিলেন কলকাতার শ ওয়ালেস অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডে। এরপর ব্রোকার হিসেবে কাজ করেছেন শিপিং প্রতিষ্ঠান বার্ডস অ্যান্ড কো.-এ। কিন্তু গৎবাঁধা চাকরি আর মাস শেষে পাওয়া বেতনে সন্তুষ্ট ছিলেন না তরুণ অমিতাভ। তিনি চেয়েছিলেন লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের জীবন, যে জীবনে নিজের অভিনয় প্রতিভাকে তিনি মেলে ধরতে পারবেন! সে কারণেই ১৯৬৮ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে অমিতাভ পাড়ি জমান স্বপ্নের শহর বম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই)।
কিন্তু ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বা এই তরুণকে বম্বে তার দুই হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করেনি। শুরুতেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার উচ্চতা। অনেক পরিচালক-প্রযোজক মনে করতেন, এত লম্বা একজন পুরুষ গতানুগতিক নায়ক হতে পারবে না। এরপর অমিতাভ তার কণ্ঠস্বর দিয়ে নিজের ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ। অল ইন্ডিয়া রেডিওর অডিশনে বাদ পড়েন তিনি।
এরপর ১৯৬৯ সালে যখন অমিতাভ হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার পথে, তখন খাজা আব্বাস তাকে নিলেন 'সাত হিন্দুস্তানি' চলচ্চিত্রে। এ ছবির জন্য নবাগত হিসেবে প্রথম জাতীয় পুরস্কার জেতেন অমিতাভ। কিন্তু তার সাথেসাথেই বলিউডের পথ তার জন্য সুগম হয়নি বা তার পেছনে প্রযোজকদের লাইন লেগে যায়নি। পুরস্কার জেতার পরেও সংগ্রাম করতে হয়েছে অমিতাভকে।
এরপর তিনি অভিনয় করেন বলিউডের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র 'আনন্দ'-এ। সেসময় বলিউডের সবচেয়ে বিখ্যাত তারকা রাজেশ খান্নার সাথে একই পর্দায় অভিনয় করলেও, অমিতাভের অভিনয় দক্ষতা কারো নজর এড়ায়নি। এ ছবির জন্যও সেরা পার্শ্বচরিত্রের পুরস্কার জেতেন তিনি।
তবে অমিতাভের ক্যারিয়ারের ব্যবসায়িক সফলতা আসে 'জাঞ্জির' (১৯৭৩) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। অমিতাভের ভাষায়- "'জাঞ্জির' আমার ক্যারিয়ারে বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। তখনই সফলতা আমার কাছে ধরা দিয়েছিল। এই ছবিতে আমার একটি শক্তিশালী চরিত্র ছিল।" প্রকাশ মেহরার এই ছবিতেই প্রথম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অ্যান্টি-হিরো চরিত্রকে দেখানো হয়েছিল। একজন পুলিশ অফিসার যিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেন, তার এই চরিত্রকে আপন করে নিয়েছিল দর্শক।
'জাঞ্জির' সিনেমার সেটেই অভিনেত্রী জয়া ভাদুড়ির সাথে পরিচয় হয় তার। পরিচয় থেকে প্রেম এবং প্রেম থেকে পরিণয়। 'অভিমান' সিনেমা মুক্তির এক মাস আগেই বিয়েটা সেরে ফেলেন বলিউডের বিখ্যাত এই জুটি।
জয়া ভাদুড়িকে পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ব্যক্তি অমিতাভের বাহ্যিক কোন বিষয়টি দেখে তিনি তার প্রেমে পড়েছিলেন? অভিনেত্রী উত্তর দিয়েছিলেন- "অমিতাভের চোখ। এটা আসলে ভাষায় ব্যাখ্যা করার মতো না... এখানে ব্যক্তিগত অনেককিছু জড়িয়ে।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতেই অমিতাভ বচ্চন নিজেকে বলিউডের সবচেয়ে প্রতাপশালী একজন অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় অমিতাভ অভিনীত চলচ্চিত্র 'শোলে', যা ব্যাপক ব্যবসাসফল হয়। সেসময় যেকোনো প্রযোজক জানতেন, অমিতাভকে ছবিতে নেওয়া মানেই তা হিট!
এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি অমিতাভ বচ্চনকে। 'ডন' (১৯৭৮) সিনেমায় অভিনয়ের পর টানা দুইবার সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতে নেন অমিতাভ। যশ চোপড়ার 'ত্রিশূল' ও 'কালা পাথর' দিয়ে আবারও অ্যাংরি ইয়ং ম্যানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও তাতে কোনো সমস্যা হয়নি দর্শকদের সমাদর পেতে।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অমিতাভ বচ্চন জিতেছেন অগণিত পুরস্কার ও সম্মাননা- পদ্মশ্রী, পদ্ম ভূষণ, পদ্ম বিভূষণ, সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার, ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ডসহ আরও অসংখ্য পুরস্কার রয়েছে 'বিগ বি'র ঝুলিতে।
বলিউডে অমিতাভ বচ্চন মানেই বিশেষ কিছু। জন্মদিনেও তাই ভক্তদের সুখবরই দিয়েছেন 'বিগ বি'। অমিতাভ অভিনীত নতুন সিনেমা 'উঁচাই' এর পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছে এবং এ ছবি মুক্তি পাবে ১১ নভেম্বর।
এদিকে অমিতাভ বচ্চনের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর বলিউড তারকারা যে 'শাহেনশাহ'কে শুভেচ্ছাবার্তা ও ভালোবাসায় ভাসিয়েছেন, সে তো বলাই বাহুল্য! আশি বছর বয়সে এসেও এই ঝানু অভিনেতা দেখিয়ে দিয়েছেন যে, তার জয়রথ এখনো চলবেই... তাই অভিতাভ বচ্চনের জাদুতে বুঁদ হয়ে থাকার সুযোগ বহাল থাকছে ভক্তদের!
সূত্র: বিবিসি, ইন্ডিয়া টুডে