সময় এখন রাশিয়ার পক্ষে বলে মনে করছেন ইউক্রেনের অনেক পশ্চিমা সহায়তাকারী
পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেনকে তড়িঘড়ি করে সামরিক সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বটে, কিন্তু কিছু পশ্চিমা দেশ ইতোমধ্যে মনে করতে শুরু করেছে — সময়টা বুঝি রাশিয়ার পক্ষে। খবর দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর।
কিয়েভ, খারকিভ ও খেরসনে ইউক্রেন গত বছরে যে জয় পেয়েছে, তার গতি ধরে রাখতে দেশটির এখন মেইন ব্যাটল ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, ও আরও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দরকার।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধ নিয়ে প্রাথমিক পরিকল্পনা অনেক আগেই ভেস্তে গিয়েছে। আর তার ফলে অতীতে পশ্চিমা সরকারগুলো মনে করেছিল, যুদ্ধ যত দীর্ঘমেয়াদি হবে, ইউক্রেনের জয়ের সম্ভাবনা ততই বেড়ে যাবে।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ইউরোপ ও ওয়াশিংটন হাল ছেড়ে না দিয়ে ইউরোপের কঠিন শীত, মস্কোর নিষেধাজ্ঞা সমস্যা ও সামরিক ব্যর্থতার পর একত্রিত হয়ে ইউক্রেনকে সমর্থন দিলে তা-তে মস্কো যুদ্ধ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করত অথবা শান্তি আলোচনার পথ খুঁজত।
কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছর পর এখন আর সে আত্মবিশ্বাস নেই পশ্চিমাদের মাঝে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাশিয়া এ যুদ্ধে সৈন্য ও রসদ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে দ্বিধা করবে না। তাই কিছু পশ্চিমা সরকার এখন আশঙ্কা করছে, এ যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে তা-তে ক্রেমলিনেরই লাভ হবে।
রাশিয়ার সামরিক বাহিনী চলমান যুদ্ধে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। যুদ্ধে এটি দক্ষ সৈন্যবল ও রসদ হারিয়েছে যথেষ্ট। এমনকি প্রিসিশন মিসাইলের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সক্ষমতা ক্রেমলিনের ক্রমশ কমছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
তেল অবরোধ ও রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির দাম ঠিক করে দেওয়ার মতো পশ্চিমা বিশ্বের কঠিন কিছু নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এখন ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করেছে দেশটির ওপর। এ বছর রাশিয়ার অর্থনীতি মারাত্মক মন্দার মুখে পড়বে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। আর এ মন্দার রেশ পরবর্তী বেশ কয়েকবছরও রয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু এতসব নিষেধাজ্ঞাও রাশিয়াকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হটাতে অথবা ক্রেমলিনের ওপর বেশি অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারছে না। বরং রাশিয়া আসন্ন মাসগুলোতে নতুন করে আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছে। সদ্য নিয়োগ দেওয়া যোদ্ধাদের ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাবে দেশটি।
সাঁজোয়া যান ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মতো অস্ত্রগুলোর উদ্দেশ্য কেবল রাশিয়ান আক্রমণ ঠেকাতে ইউক্রেনকে সাহায্য করা নয় বরং কিয়েভকে রাশিয়ার দখলকৃত এলাকাগুলোর আরও অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ যুদ্ধে হুমকি হিসেবে রাশিয়া আরও বড় হয়ে উঠতে পারে এবং ইউক্রেনকে যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে এমন অস্ত্র সরবরাহ জরুরি বলে প্রকাশ্যেই আলোচনা করেছে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি ইউক্রেনকে সহায়তার ব্যাপারে টু্ইট করে ইতিবাচক সাড়া জানিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক।
এর বাইরে আরও একটি প্রভাবের কথাও মাথায় রাখতে হবে। পশ্চিমা কর্তৃপক্ষের ভাষ্যে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ইউক্রেনকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু পুতিন হয়তো আশা করছেন, বছরের পর বছর যুদ্ধ চললে এ জনসমর্থন একসময় হ্রাস পাবে। আর ভবিষ্যতে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে সরকার পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টিও রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট তার হিসাবনিকাশে রাখছেন।
কয়েক মাস আগে ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে রাশিয়ার দখলকৃত অনেক এলাকা পুনর্দখল করতে পেরেছে। আর এর ফলে পশ্চিমা কর্তৃপক্ষ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে এ ভেবে যে, যুদ্ধে উন্নতির জন্য কিয়েভের যা যা দরকার, তা এটি পাচ্ছে। তবে ইউক্রেনের এসব জয়ে রাশিয়ার কিছু ভুল পদক্ষেপেরও ভূমিকা ছিল।
ওই সময় কিছু সরকার পশ্চিমাদেশগুলোকে ইউক্রেনে সমর্থন বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছিল, যাতে চলমান যুদ্ধ বছরের পর বছর না গড়ায়। কিন্তু অনেক পশ্চিমামিত্র পশ্চিমা সমর্থন বৃদ্ধির ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
গত বুধবার জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলজ বলেছেন, জার্মানি ইউক্রেনে লেপার্ড ২ ট্যাংক পাঠাবে। কিন্তু তিনি আরও বলেন, '...একই সময়ে আমরা এ যুদ্ধ রাশিয়া বনাম ন্যাটোর যুদ্ধে পরিণত হওয়া প্রতিরোধ করতে যা যা করা দরকার, তাও করব।'
এছাড়া অস্ত্র সরবরাহ করার মাধ্যমে এ যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার ধারণাটি আদতে বাস্তবায়নযোগ্য কিনা — এ বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অনেক পশ্চিমা কর্তৃপক্ষ।
গতবার ইউক্রেন পশ্চিমা অস্ত্রের কল্যাণে রণাঙ্গনে যে সফলতা অর্জন করেছে, সামনের দিনগুলোতেও যে এটি একই সাফল্য পাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এছাড়া ইউক্রেনের বশ্যতা স্বীকার ছাড়াই পুতিন যে এ যুদ্ধের কোনো সমাপ্তির বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছে পশ্চিমা রাজধানীগুলো।
আটলান্টিক কাউন্সিলের থিংক ট্যাংক নর্দার্ন ইউরোপ-এর পরিচালক অ্যানা ওয়াইজল্যান্ডার বলেন, 'এ যুদ্ধ কীভাবে শেষ হওয়া উচিত, তা নিয়ে আমাদের (পশ্চিমাদের) মধ্যে এখনো কোনো সাধারণ ভিশন তৈরি হয়নি এবং এসব সরবরাহকৃত অস্ত্রগুলো কীভাবে এ ভিশনের অংশ হয়ে উঠবে, তাও আমরা এখনো জানি না।'