ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ও ফাইটারকে ধোঁকা দিচ্ছে, ক্ষিপ্র শিকারি- রাশিয়ার মিগ-৩১ ফক্সহাউন্ড
চোখের পলক ফেলার সুযোগ না দিয়েই ইউক্রেনীয় যুদ্ধবিমানগুলিকে ধবংস করতে নিজেদের সর্বাধুনিক ফাইটার জেট মোতায়েন করেছে রাশিয়া। খবর ইউরেশিয়ান টাইমসের
তবে ইউক্রেনকে খাটো করে দেখার সুযোগ-ও নেই। রাশিয়ান বিমানবাহিনীর বিশালতা ও সামর্থ্যের তুলনায়– সক্ষমতা ও সংখ্যা কম থাকার পরও– দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও বিমান-বিধ্বংসী অস্ত্র রুশ ফাইটারদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়ে আসছে।
ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনীর সাথে বিমান সংখ্যায় ১০:১ অনুপাতে এগিয়ে থাকার পরও– ঠিক একারণেই যুদ্ধের শুরু থেকেই ব্যাপক সমস্যার মুখে পড়েছে রুশ বিমানবাহিনী। তাদের অনেক বিমান ও পাইলট হারাতে হয়েছে রণাঙ্গনে।
গত নয় মাসের যুদ্ধে রাশিয়া যে গতিতে উৎপাদন করতে পারে, তার চেয়ে বেশি হারে হারিয়েছে যুদ্ধবিমান। ইউক্রেনের আকাশ বিপদমুক্ত না হওয়ায়–নজরদারি মিশন নির্বিঘ্নে চালানো কঠিন হয়ে ওঠে মনুষ্যচালিত রাশিয়ান গোয়েন্দা বিমানের পক্ষে। ফলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অপারেশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে অনেকক্ষেত্রে আগেভাগে সতর্ক হতে পারেনি বা সেগুলিকে প্রতিরোধের ব্যবস্থাও নিতে পারেনি।
ধীরে ধীরে এসব বাধাকে কাটিয়ে ওঠার শিক্ষা নিচ্ছে রাশিয়া। প্রয়োগ করছে চতুর রণকৌশল। তবে এতে নতুন মাত্রা যোগ করছে, রাশিয়ার মিগ-৩১ যুদ্ধবিমান, যার ন্যাটো সাংকেতিক নাম- ফক্সহাউন্ড। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩ হাজার কিলোমিটার বেগে উড়তে পারা বিমানটির এ নাম কিন্তু যথার্থ। যুদ্ধের শুরু থেকেই শিকারি হাউন্ডের মতো ইউক্রেনীয় পাইলটদের কাছে আতঙ্ক হয়েই রয়েছে মিগ-৩১।
মিগ-৩১ একটি দুই আসন বিশিষ্ট- (পাইলট ও অয়েপন অফিসার), শত্রু বিমানকে ইন্টারসেপ্ট বা প্রতিরোধকারী ফাইটার এয়ারক্রাফট। এই মিশন সফলভাবে পরিচালনার জন্য এটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে।
ইউক্রেনের ভূমি-ভিত্তিক আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার বাইরে– অনেক উঁচুতে উড়ে যায় মিগ-৩১। বেশকিছু ইউক্রেনীয় যুদ্ধবিমান ফক্সহাউন্ডের ছোঁড়া দূরপাল্লার ভিম্পল আর-৩৭এম এয়ার টু এয়ার মিসাইলের আঘাতে ভূপাতিত হয়েছে বলেও বিভিন্ন সময় জানা গেছে।
যুক্তরাজ্যের সমর চিন্তক সংস্থা রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (রুসি) তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই ইন্টারসেপ্টর বিমান ঘায়েল করার মতো যথেষ্ট গতি ও পাল্লা নেই ইউক্রেনের বিমান ও মিসাইলের।
প্রতিবেদনে রুসির বিশেষজ্ঞ জাস্টিন ব্রঙ্ক, নিক রেনল্ডস ও জ্যাক ওয়ালটিং লিখেছেন, রুশ বিমানবাহিনীর আত্মরক্ষামূলক টহল ইউক্রেনীয় বিমানের আক্রমণ রুখতে অতি-কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইউক্রেনীয় পাইলটদের কাছে এখন আতঙ্কের অপরনাম মিগ-৩১বিএম যুদ্ধবিমান এবং আর-৩৭এম মিসাইল।
রুশ বিমানবাহিনীতে বর্তমানে তিন রেজিমেন্ট- এ নানান ভার্সনের প্রায় ৯০টি মিগ-৩১ যুদ্ধবিমান সচল সেবায় যুক্ত রয়েছে। ফোর্বসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর অন্তত একটি রেজিমেন্ট মোতায়েন করা হয়েছে ক্রিমিয়ার বেলবেক বিমানঘাঁটিতে। রেজিমেন্টের প্রধান দায়িত্ব নিজ সেনাদের শত্রু বিমানের হামলা থেকে রক্ষায়– প্রতিরক্ষামূলক টহল এবং ইন্টারসেপশন মিশন। শেষোক্তটি হলো– শত্রু বিমান শনাক্ত হওয়া মাত্র তাৎক্ষণিকভাবে উড্ডয়ন করে সেগুলিকে প্রতিহত করা।
যেভাবে মিগ-৩১ এর শিকারে পরিণত হচ্ছে ইউক্রেনীয় ফাইটার
রুসির প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর কাছে থাকা সবচেয়ে ভালো সুখই-২৭ যুদ্ধবিমানও মিগ-৩১ এর উচ্চতা বা গতির সাথে তাল মেলাতে পারে না। মিগ-৩১ ৬০ হাজার ফিটের বেশি উচ্চতায় অনায়সে উড়তে পারে। আর শব্দগতির চেয়ে আড়াইগুণ জোরে ছুটতে পারে অনেকটা সময় ধরে।
মিগ-৩১ এর পাইলট এতে বহন করা একটি আর-৩৭এম মিসাইল দিয়ে– ২০০ মাইলের বেশি দূরে থাকা শত্রু বিমান ঘায়েল করতে পারেন– আকাশের অনেক উচ্চতায় নিরাপদ অবস্থানে থেকে।
তবে এই মিসাইলের কার্যকারিতা সবচেয়ে ভালো হয়– যদি এটি ৮০ মাইল বা তার কাছাকাছি দূরত্ব থেকে ছোঁড়া হয়। সে তুলনায়, ইউক্রেনীয় সুখই-২৭ জঙ্গিবিমান মাত্র ৫০ মাইল দূর থেকে ভিম্পেল আর-২৭ মিসাইল নিক্ষেপ করতে পারে।
এই পরিস্থিতি ফক্সহাউন্ডকে দিয়েছে এগিয়ে থাকার সুবিধা। ফলে বিমানটি নিজে অক্ষত থেকেই শত্রুবিমানকে অনায়সে ভূপাতিত করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও জানিয়েছে যে, ইউক্রেনের বেশকিছু এলাকায় প্রতিরক্ষামূলক টহলে মোতায়েন করা হয়েছে মিগ-৩১গুলিকে।
গত অক্টোবরের শেষে ইউক্রেনের একটি সুখই-২৪ বিমানকে ধবংস করে মিগ-৩১।
বর্তমানে ইউক্রেনে আটটি জোনে সার্বক্ষণিক টহল দিচ্ছে রাশিয়ান বিমান বাহিনী। উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ অভিযান শুরুর পর থেকেই জোরদার করা হয়েছে এ টহল। আর এতে অংশ নিচ্ছে জোরায় জোরায় সুখই-৩৫ আর মিগ-৩১ যুদ্ধবিমান।
আক্রমণ অভিযানে ইউক্রেনীয় সেনাদের সহায়তা দিতে বিমানবাহিনীর সুখই-২৫, সুখই-২৪ বা মিগ-২৯ বিমান অংশ নিচ্ছে কিনা– সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে এসব টহলের মাধ্যমে। আর শত্রু বিমান শনাক্ত করা মাত্রই হামলা করছে সুখই-৩৫ বা মিগ-৩১।
ভারত রাশিয়ার সর্বাধুনিক আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল ও যুদ্ধবিমানের সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী। দেশটির বিমানবাহিনীর সাবেক স্কোয়াড্রন লিডার বিজয়ান্দর কে ঠাকুর ইউরেশিয়ান টাইমসকে জানান, কয়েক মিনিটের মধ্যে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে আর-৩৭; অর্থাৎ এটির গতি প্রায় হাইপারসনিক বা শব্দগতির পাঁচগুণের কাছাকাছি।
গত আগস্টে পাল্টা আক্রমণ অভিযান শুরুর পর অন্তত চারটি মিগ-২৯, ছয়টি সুখই-২৫, একটি সুখই-২৪ এবং একটি সুখই-২৭ যুদ্ধবিমান হারিয়েছে ইউক্রেন। এই সংখ্যা নিশ্চিত করেছে বিভিন্ন স্বাধীন সূত্র।
রুসির প্রতিবেদনে বিশেষ ব্রঙ্ক, রেনল্ডস ও ওয়াল্টিং লিখেছেন, 'অক্টোবর থেকে দিনে অন্তত ছয়টি করে আর-৩৭এম মিসাইল ছুঁড়ছে রুশ বিমানবাহিনী। এই অস্ত্রের গতি প্রচণ্ড, তার সাথে আছে দূরপাল্লার সক্ষমতা। নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া টার্গেট শনাক্ত করার জন্যই ডিজাইন করা হয়েছে এই মিসাইলের সিকার। ফলে এটিকে ফাঁকি দেওয়া এককথায় অত্যন্ত কঠিন।
এপর্যন্ত মাত্র একটি মিগ-৩১ যুদ্ধবিমান হারিয়েছে রাশিয়া। তাও সেটি আকাশে নয়, বরং ক্রিমিয়ার ঘাঁটিতে ইউক্রেনীয় বিমান হামলার সময় ধবংস হয়।