পশ্চিমা ট্যাংক ইউক্রেনকে বড় কোনো সাহায্য করবে না, ধবংস হবে অনায়াসে: রুশ সমর বিশেষজ্ঞ
জার্মানি বা যুক্তরাজ্যের তৈরি ট্যাংক পরিচালনা শিখতে দীর্ঘসময় লাগবে ইউক্রেনীয়দের। তাই কিয়েভকে এসব ট্যাংক দেওয়া হলে, যুদ্ধক্ষেত্রে সেগুলো বিদেশি যোদ্ধারাই চালাবে বলে সামরিক বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে রাশিয়ার তাস নিউজ এজেন্সি।
তাদের মতে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পক্ষে এসব ট্যাংক রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে কঠিন। পাশাপাশি এগুলোর এমন কিছু দুর্বলতা আছে, যার সুযোগ নিয়ে রাশিয়ান অস্ত্র দিয়ে ধবংস করা যাবে।
গত মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) জার্মানির প্রভাবশালী ডার স্পিগেল ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ ইউক্রেনে এক কোম্পানি লেপার্ড-২ ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সামরিক সরঞ্জাম পুনঃরপ্তানি করতে হলে উৎপাদক দেশের অনুমতি নিতে হয়। পোল্যান্ডের কাছেও লেপার্ড-২ ট্যাংক আছে। এখান থেকে তারা ইউক্রেনকে দিতে চায়। এজন্য দেশটি বার্লিনের কাছে অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ করে। শলৎজ প্রশাসনের কর্মকর্তারা আরো জানিয়েছেন, পোল্যান্ডকে এক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হবে না।
যুক্তরাজ্য পৃথকভাবে তাদের তৈরি ১৪টি চ্যালেঞ্জার-২ মেইন ব্যাটেল ট্যাংক (এমবিটি) ইউক্রেনকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ইউক্রেনীয়দের কাছে পশ্চিমা ট্যাংক পরিচালনায় প্রশিক্ষিত হওয়ার মতো সময় নেই
দীর্ঘদিন ধরে সোভিয়েত সাঁজোয়া যান পরিচালনায় অভ্যস্ত ইউক্রেনীয় সেনারা। এগুলোর সাথে পশ্চিমা সাঁজোয়া বহরের রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। ফলে যুদ্ধ চলাকালে দ্রুততর সময়ে নতুন ধরনের ট্যাংক পরিচালনা শেখা তাদের পক্ষে সম্ভব না। তাস এজেন্সির কাছে এ মন্তব্য করেন 'আর্সেনাল অব দ্য ফাদারল্যান্ড ম্যাগাজিনের' সম্পাদক অ্যালেক্সি লিওনকভ।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, 'জার্মানি বা ব্রিটেন তাদের সেনাদের অন্তত এক বছর ধরে ট্যাংক চালনার প্রশিক্ষণ দেয়। পোল্যান্ড যখন লেপার্ড-২ কেনে, তখন তাদের সেনাদের দুই-তিন বছর ধরে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, এরা সকলে ছিল সেনাবাহিনীর পেশাদার সদস্য'।
ইউক্রেনের বর্তমান সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশই যে স্বেচ্ছাসেবী বা নতুন সেনা এর মাধ্যমে সেই সমস্যার প্রতিও ইঙ্গিত দেন তিনি।
'তাছাড়া, শুধু ট্যাংক চালাতে পারলেই হবে না, এ ধরনের ভারী সাঁজোয়া যানকে শত্রুর বিরুদ্ধে সফলভাবে কাজে লাগাতে হলে, লক্ষ্যবস্তু ধবংসে সঠিকভাবে গোলা ছুঁড়তে হলে- ট্যাংক ক্রুদের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় থাকতে হবে। আধুনিক যুদ্ধে একক বীরত্বে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় না আর। তাই ট্যাংক ক্রুদের প্লাটুন, কোম্পানি ও ব্যাটালিয়ন পর্যায়েও যুদ্ধে অংশগ্রহণের দক্ষতা থাকতে হয়' উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এই পুরো প্রক্রিয়া রপ্ত করতে তাদের অন্ততপক্ষে ১২ মাস লাগবেই।
'উদাহরণস্বরূপ; সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে সাঁজোয়া যান পরিচালনার প্রশিক্ষণ নিতে দুই বছর লাগতো। প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় বছর শেষেই কেবল পেশাদার সেনাদের নিয়ে গঠিত কোনো ট্যাংকের ক্রুরা যুদ্ধে যাওয়ার উপযুক্ত হতেন। কিন্তু, (সোভিয়েত ট্যাংকের চেয়ে) লেপার্ড বা চ্যালেঞ্জার ট্যাংক পরিচালনা করা আরো জটিল বিষয়। কারণ এগুলো অত্যাধুনিক সব ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। একটু অসাবধান হলেই পুরো ট্যাংক বিকল হয়ে পড়বে'।
তাস এজেন্সির সমর বিশ্লেষক ভিক্টর লিটোভকিন বলেন, দ্রুত প্রশিক্ষণে এক মাসের মধ্যেই লেপার্ড বা চ্যালেঞ্জার ট্যাংক চালানো শিখতে পারবে ইউক্রেনীয়রা, কিন্তু সেখানেও রয়েছে আরেকটি বড় সমস্যা। কারণ ট্যাংকের সব যন্ত্রপাতির কন্ট্রোল প্যানেলে বিদেশি ভাষায় লেখা চিহ্ন রয়েছে। অর্থাৎ, এজন্য তাদের (জার্মান) ভাষাও শিখতে হবে। কারণ, যুদ্ধের ময়দানে কোন সুইচ কোন কাজের জন্য চাপতে হবে, তা অনুমান করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় থাকে না। সবকিছু করতে হয় দ্রুত ও নিশ্চিত হয়ে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে। আর ক্রুরা তখনই সেরা হয়, যখন তারা নিজেদের ট্যাংকের ওপর ভরসা করতে পারে।
বেশিরভাগ সোভিয়েত ডিজাইনের ট্যাংকে কামানের জন্য থাকে অটোলোডার ব্যবস্থা। এতে কামানের লোডার হিসেবে বাড়তি একজন সদস্য প্রয়োজন হয় না। ফলে ড্রাইভার, কমান্ডার ও গানার- এ তিন সদস্য মিলেই ট্যাংক ক্রু গঠিত হয়। ইউক্রেনও এই তিন ক্রু ব্যবস্থায় অভ্যস্ত।
'কিন্ত, লেপার্ড বা চ্যালেঞ্জার ট্যাংকে তিনজনের বদলে চারজন ক্রু লাগে। ট্যাংক চলমান থাকা অবস্থায় দাঁড়িয়ে কামানের গোলা ভরার কাজটি সহজ নয় লোডারের জন্য। এজন্য পশ্চিমা ডিজাইনের ট্যাংকে (দক্ষ) লোডারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, ইউক্রেনের সেনারা (স্বল্প সময়ে) এতোটা দক্ষ হতে পারবে না' বলেও ব্যাখ্যা করেন লিটোভকিন।
'পরিচালনা নির্দেশিকায় লেপার্ড, চ্যালেঞ্জার ও আব্রামস ট্যাংকের জন্য যে হারে গোলা ছোড়ার দ্রুততার উল্লেখ আছে তা পুরোপুরি লোডারের সক্ষমতার মাধ্যমে অর্জিত হয়। রাশিয়ান ট্যাংকে এই কাজটা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় হয়। এখন ভেবে দেখুন, কামান থেকে দ্রুত গোলা নিক্ষেপ নিশ্চিত করতে হলে, লোডারকে কতোটা সাবলীল হতে হবে।'
শত্রুর ট্যাংকের সাথে যুদ্ধের সময় সবার আগে আঘাত হানার সক্ষমতা বা গোলা ছোড়ার গতিই একটি ট্যাংকের প্রধান রক্ষাকবচ। অর্থাৎ, যে ট্যাংক প্রথমে গোলা নিক্ষেপ করতে পারে, সেই রক্ষা পায়, ধবংস হয় অপরপক্ষের ট্যাংক।
এ সামরিক বিশেষজ্ঞের মতে, 'এজন্যই পশ্চিমা ট্যাংক অপারেট করার জন্য ইউক্রেনীয় সেনাদের আরো বেশি সময় দরকার, যা তাদের হাতে নেই। তবে অনেক আগে থেকেই ইউক্রেনের ট্যাংক দরকার ছিল, এখন যদি ট্যাংক পাঠানো হয়, তাহলে একইসঙ্গে দক্ষ ক্রু'ও পাঠাতে হবে পশ্চিমাদের। কারণ দক্ষ ক্রুরা জানে কীভাবে লক্ষ্য অর্জন করতে হয়; কীভাবে ফায়ারিং পজিশনে যেতে হয় বা কখন সেখান থেকে সরে যাওয়া দরকার'।
অ্যালেক্সি লিওনকভ উদাহরণ দিয়ে বলেন, পোল্যান্ড ইউক্রেনকে যতগুলি স্বচালিত ক্রাব আর্টিলারি সিস্টেম দিয়েছিল, এর সবগুলোর ক্রু ছিল পোলিশ নাগরিক। এতে আবারো প্রমাণ হয়, ইউক্রেনকে দেওয়া বিদেশি ট্যাংকগুলো বিদেশি সেনারাই পরিচালনা করবে।
পশ্চিমা অতিরঞ্জনকে গুঁড়িয়ে দেবে রাশিয়ান বাস্তবতা
অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল দিয়ে সহজেই ধবংস করা যায় লেপার্ড-২। সিরিয়ায় তুর্কি সেনাবাহিনীর এক অভিযানে যা প্রমাণিত হয়েছে। এসময় কুর্দি বিদ্রোহীরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লেপার্ড-২ ধবংস করে।
লিওনকভ উল্লেখ করেন যে, '১৯৬০-৭০ এর দশকে তৈরি প্রথম প্রজন্মের মালিয়ুতকা অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল দিয়েই এসব ট্যাংক ধবংস করেছে কুর্দিরা। তারা ট্যাংকগুলোকে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করতে এতটা সফল হয় যে, তুর্কি সেনারা স্থল অভিযান বন্ধ করে বিমান, ড্রোন, গোলন্দাজ কামান ও রকেট লঞ্চারের মাধ্যমে দূর থেকে কুর্দিদের পজিশনে হামলা শুরু করে'।
সে তুলনায়, রাশিয়ার সর্বশেষ প্রজন্মের অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইলগুলো সহজেই লেপার্ড বা চ্যালেঞ্জার ট্যাংক ধবংস করতে পারবে। ইউকেনে এলে একই পরিণতি হবে আমেরিকার আব্রামস ট্যাংকের।
তার মতে, 'এসব ট্যাংক বিশ্বসেরা বলে যে প্রচার চালানো হয়, রাশিয়ার তৈরি করনেট, ফ্যাগট বা অন্যান্য ট্যাংক-বিধ্বংসী মিসাইলের মুখোমুখি হওয়ার বাস্তবতা- তা এক লহমায় গুঁড়িয়ে দেবে। রাশিয়ান ট্যাংকগুলোও যোগ দেবে এই ধবংসলীলায়'। এমনকী সোভিয়েত আমলের টি-৮০ বা টি-৭২বি৩ ট্যাংকও পশ্চিমা এসব ট্যাংক ধবংস করতে পারবে বলে দাবি করেছেন লিওনকভ।
জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের তৈরি সাঁজোয়া যান ধবংসে টি-৭২ ট্যাংকের সক্ষমতা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'শত্রুর ট্যাংকের বিরুদ্ধে এটা আমাদের কার্যকর একটা অস্ত্র, বিশেষ করে এর বি-৩ মডিফিকেশন খুবই উন্নত। এতে অত্যাধুনিক ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম আছে। ছুঁড়তে পারে নতুন ধরনের এপিএফএসডিএস (আর্মার পিয়ার্সিং ফিন-স্ট্যাবিলাইজড ডিসকার্ডিং স্যাবো) শেল। এটি লেপার্ড ট্যাংককে যেকোনো অ্যাঙ্গেলে ভেদ করতে পারবে'।
(রাশিয়ান ট্যাংকের তুলনায়) পশ্চিমা ট্যাংকগুলোর অধিক উচ্চতাকেও একটি অন্যতম দুর্বলতা বলে উল্লেখ করেন লিটোভকিন। তিনি বলেন, 'আমাদের ট্যাংকগুলোর উচ্চতা ২.২৩ মিটার, অন্যদিকে তাদের সাঁজোয়া যানের উচ্চতা ২.৭০ থেকে ২.৯০ মিটার। আমেরিকার আব্রামস ট্যাংকের দৈর্ঘ্য আবার রাশিয়ার তৈরি যেকোনো ট্যাংকের চেয়ে এক মিটার বেশি। সাঁজোয়া যানের আকারে যত বড় হয়, ততো সহজেই একে টার্গেট করা যায়'।
কিয়েভকে লেপার্ড-২এ৪ ভ্যারিয়েন্টের ট্যাংক দেওয়া হচ্ছে। লিওনকভের দাবি, এগুলো চলমান অবস্থায় গোলা ছুঁড়তে সক্ষম নয়, বরং থেমে তারপর গোলাবর্ষণ করে।
'আমাদের ট্যাংকগুলো চলমান অবস্থায় নির্ভুলভাবে লক্ষ্যভেদে সক্ষম। তাদের ট্যাংককে থামতে হবে। এতে মূল্যবান সময় নষ্ট হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে স্থির ট্যাংক একটি ভালো টার্গেট, কারণ সহজে তাদের ওপর লক্ষ্যস্থির করা যায়' ব্যাখ্যা করেন তিনি।
যুদ্ধক্ষেত্রে পশ্চিমা ট্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে, এগুলো সারাই করতেও সমস্যার মধ্যে পড়বে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী। লিটোভকিন বলেন, 'যেমন ধরেন ট্যাংকের ক্যাটারপিলার ট্র্যাক যদি ধবংস হয়, তাহলে এটা কীভাবে বদলাবেন, আর কোন প্রক্রিয়ায়? ইঞ্জিন বিকল হলে সমস্যাটা কোথায় খুঁজে বের করে ঠিক করতে হবে। এগুলো ইউক্রেনীয়দের শিখতে অনেক সময় লাগবে। অথচ, ট্যাংক ক্রুদের কোনো প্রকার নির্দেশিকা ছাড়াই দ্রুত সময়ে এসব সারাইয়ের কাজ করতে হয়'।
তবে পশ্চিমা ট্যাংকগুলোর ইঞ্জিন মাল্টি-ফুয়েল বা একাধিক জ্বালানিতে চলতে পারায়, জ্বালানি নিয়ে ইউক্রেনীয়দের কোনো সমস্যা হবে না বলে জানান তিনি।
পুরো রণাঙ্গনের জন্য মাত্র ৪০টি পশ্চিমা ট্যাংক
এই মুহূর্তে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে প্রায় ৪০টি ট্যাংক দিতে পারবে। এরমধ্যে ১৪টি দেবে যুক্তরাজ্য, ১২টি পোল্যান্ড এবং আরো ১২টি দেবে জার্মানি। সামান্য এ কটি ট্যাংকে যুদ্ধের সমীকরণে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হবে না বলে দাবি করছেন রুশ বিশেষজ্ঞরা। কারণ, ইউক্রেনে রণাঙ্গনের সম্মুখভাগ এখন এক হাজার কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত।
লিটোভকিন বলেন, 'রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, এপর্যন্ত আমরা ৮৫০টি ট্যাংকসহ শত্রুর ৭ হাজার ৬০০ সাঁজোয়া যান ধবংস করেছি। এর আগে পোল্যান্ড ইউক্রেনকে ২০০ টি-৭২ ট্যাংক দিয়েছিল। এর অধিকাংশ হয় নষ্ট হয়েছে নাহয় রুশ বাহিনীর হাতে ধবংস করেছে। তাই এক ব্যাটালিয়ান বা তার চেয়ে কম সংখ্যায় ট্যাংক যুদ্ধের সম্মুখভাগে কোনো প্রভাব ফেলবে না'।