দীর্ঘযুদ্ধের মুখে ইউক্রেন: কৌশল পরিবর্তন ছাড়া পথ নেই!
প্রত্যাশাকে বারবার হোঁচট দিয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ; আবারো তাই ঘটছে। করণীয় নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় কিয়েভ ও তার মিত্ররা।
গত জুনে ইউক্রেন যখন তার পাল্টা-আক্রমণ অভিযান শুরু করে, তখন আশা করা হয়েছিল, পশ্চিমা অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ইউক্রেনীয় সেনারা যথেষ্ট পরিমাণ ভূমি পুনর্দখল করতে পারবে – যার ভিত্তিতে, দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব শান্তি আলোচনায় দর কষাকষিতে শক্তিশালী অবস্থানে থাকবেন।
এ পরিকল্পনা কাজ করছে না। বীরোচিত চেষ্টা এবং রাশিয়ার প্রতিরোধ ব্যূহের কিছুটা ভেদ করা সত্ত্বেও – গত জুনে রাশিয়া যেসব ভূমি দখল করেছিল, তার মাত্র দশমিক ২৫ শতাংশ মুক্ত করতে পেরেছে ইউক্রেন। ফলে প্রায় এক হাজার মাইল দীর্ঘ সম্মুখভাগের সামান্যই বদলেছে।
আগামী সপ্তাহগুলোতে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী হয়তো রাশিয়ার প্রতিরোধ কাঠামো সম্পূর্ণভাবে ভেদ করে ব্রেক থ্রু অর্জন করতে পারবে। কিন্তু, গত তিন মাসের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, তার ওপর পুরোপুরি ভরসা রাখাটা ভুল হবে।
এই পরিস্থিতিতে, যুদ্ধবিরতি বা শান্তি আলোচনার আহ্বান জানানো অর্থহীন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শান্তি আলোচনায় আগ্রহী– এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর যদি তিনি আগ্রহী হন, তবুও তার ওপর ভরসা রাখতে পারবে না কিয়েভ ও তার মিত্ররা।
পুতিন চাইছেন, যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা দিতে দিতে ক্লান্ত, তিতিবিরক্ত হোক পশ্চিমা বিশ্ব। একইসাথে আশা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আগামী জাতীয় নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হবেন। তাছাড়া, স্বদেশে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ধরে রাখতেও পুতিনের চাই এ যুদ্ধ; এই অবস্থায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে- রাশিয়া সেই সুযোগে সামরিক শক্তি পুনর্গঠিত করে ফের আক্রমণ চালাবে। তাই ইউক্রেনীয়রা লড়াই বন্ধ করলে, নিজ দেশই হারাতে পারে।
ইউক্রেন ও পশ্চিমা মিত্ররা – উভয়পক্ষই উপলদ্ধি করতে শুরু করছে, যে এই যুদ্ধ হবে সুদীর্ঘ এক শক্তিক্ষয়ের লড়াই। চলতি সপ্তাহে আলোচনার জন্য ওয়াশিংটন সফর করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি। তিনি দ্য ইকোনমিস্টকে বলেছেন, 'আমাকে দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।'
কিন্তু, দুর্ভাগ্যের বিষয়, ইউক্রেন এখনো প্রস্তুত নয়; কিয়েভের পশ্চিমা সহযোগিরাও নয়। উভয় পক্ষই এখনো কাউন্টার-অফেন্সিভের ওপর বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
অথচ, তাদের উচিত সামরিক কৌশল পুনর্বিবেচনা করা এবং দীর্ঘমেয়াদে ইউক্রেনের অর্থনীতি কীভাবে চালিত হবে- তা ঠিক করা। প্রথমে বিজয় অর্জন, এবং তারপরে দেশ পুনর্গঠন– এমন লক্ষ্যের বদলে ইউক্রেনের যেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো নিজস্ব সামর্থ্য থাকে – তা নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে, যেন যুদ্ধের সত্ত্বেও অর্থনীতি প্রাণবন্ত থাকে।
সামরিক পুনর্গঠনটাই আগে দরকার। ইউক্রেনের সেনারা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। সুদক্ষ, চৌকস সেনাদের অধিকাংশই নিহত হয়েছে। নতুন সেনা ভর্তির উদ্যোগ সত্ত্বেও– জনবলের ঘাটতি রয়েছে বৃহৎ পরিসরে স্থায়ী কাউন্টার-অফেন্সিভ চালিয়ে যাওয়ার।
এজন্য বিদ্যমান সব ধরনের সম্পদ জড়ো করে, খেলার গতিই বদলে দিতে হবে। নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল রাশিয়ার ওপর আক্রমণকে জোরালো করতে পারে। ইউক্রেনের প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা ড্রোন উৎপাদন বাড়াচ্ছেন; সাম্প্রতিক সময়ে তাদের তৈরি ড্রোন ধবংস করেছে রুশ যুদ্ধজাহাজ। মিসাইল হামলায় ধবংস হয়েছে অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপে রাশিয়ার একটি শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই ধরনের হামলা আরও বাড়ানো সম্ভব। তাতে করে, কৃষ্ণসাগরে নিরাপদ বন্দরের সুবিধা-বঞ্চিত হবে রুশ নৌবাহিনী। ড্রোনের সাহায্যে রাশিয়ার সামরিক অবকাঠামোগুলোয় হামলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। অবশ্য তাতেই বাজিমাৎ হবে, এমনটা ধরে নেওয়ার কারণ নেই। কারণ রাশিয়াও নিজস্ব ড্রোন উৎপাদনে গতি এনেছে। তবে সুবিধা যা পাওয়া যাবে তাহলো– রাশিয়া ড্রোন হামলা চালালে, ইউক্রেনও তার পাল্টা-জবাব দিতে পারবে। এই সামর্থ্যের কথা চিন্তা করে, কিছুক্ষেত্রে হয়তো রাশিয়া হামলা করবে না।
আক্রমণ চালানোর সামর্থ্যের পাশাপাশি, ইউক্রেনকে তার অদম্যতাকে বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে ভারী অস্ত্রের পাশাপাশি– কয়েক বছরব্যাপী যুদ্ধ চালানোর মতোন রক্ষণাবেক্ষণ সক্ষমতা তৈরিতে সাহায্য দরকার দেশটির। এই সামর্থ্য থাকলে, কিয়েভ আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের জরুরি মেরামত নিজেই করতে পারবে। একইসঙ্গে, ইউক্রেনের জন্য আর্টলারি গোলার নির্ভরযোগ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিতে হবে।
তবে দীর্ঘ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার আরও উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। গত ১৮ মাস ধরেই নির্বিচারে ইউক্রেনের অবকাঠামো ধবংস করছে রাশিয়া – এ ধারা চলতে থাকলে দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। কার্যকর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকার ফলেই রাজধানী কিয়েভে একটি প্রাণচঞ্চল, কর্মমুখর পরিবেশ আছে। একই ব্যবস্থা এখন অন্যান্য বড় শহরগুলোর জন্যেও দরকার। এজন্য দেশটিকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান এবং আরও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিতে হবে।
অর্থনীতির একটি পুনর্গঠনও দরকার। তার অর্থ হলো– যুদ্ধ পরবর্তী দেশ পুনর্গঠনের অতিরঞ্জিত পরিকল্পনা কমিয়ে এখনই মনোযোগ দিতে হবে– উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মূল বিনিয়োগে। ইউক্রেনের অর্থনীতি যুদ্ধের আগের সময়ের তুলনায় একতৃতীয়াংশ সংকুচিত হয়েছে। দেশটির জাতীয় বাজেটের অর্ধেকই দিতে হচ্ছে পশ্চিমাদের অর্থে। এই অবস্থায়, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে ধস নেমেছে। ১০ লাখের বেশি মানুষকে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ লড়তে হচ্ছে। আরও লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ফলে কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে।
যুদ্ধ চলমান থাকার মধ্যেই ইউক্রেনের অর্থনীতিকে ত্রাণের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে, বিনিয়োগ আকর্ষণের দিকে নিতে হবে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে, কিয়েভ দুটি খাত – অস্ত্র ও কৃষি – উৎপাদনের ওপর বিশেষ মনোযোগ দিতে পারে। কৃষি ইউক্রেনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত। অন্যদিকে, যুদ্ধের প্রয়োজনে অস্ত্র চাহিদা তো আছেই। যদি এ দুটি খাতকে চাঙ্গা করা যায়, তাহলে বিদেশে পালানো লাখ লাখ ইউক্রেনীয় স্বদেশে ফিরতে পারে। ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলে যুদ্ধের তাণ্ডব নেই, অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ এসব এলাকায় তারা ফিরতে পারে। এতে কর্মী সংকট দূর করা যাবে।
অর্থনীতির সহায়ক হবে উন্নততর নিরাপত্তা। যেমন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যত শক্তিশালী হবে– রুশ হামলায় নতুন কোনো কারখানা ধবংস হওয়ার ঝুঁকি ততোই কমবে। আক্রমণ চালিয়ে রুশ নৌবাহিনীকে যতটা পিছু হঠানো যাবে, কৃষ্ণসাগরের বন্দর দিয়ে রপ্তানি করা ইউক্রেনের জন্য ততোটাই সহজ হবে।
একইসঙ্গে অর্থনৈতিক সংস্কারগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, দুর্নীতির সমূলে উৎপাটন দরকার। ইউক্রেনের দীর্ঘকালের এই সমস্যা দূর করতে হলে- বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসা পরিচালনা সহজ করতে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। বিদেশে গিয়ে শরণার্থীরা যেসব কাজের দক্ষতা অর্জন করেছে, দেশে ফিরলে তারা যেন সেগুলো কাজে লাগাতে পারে, সে প্রচেষ্টা থাকতে হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে যুদ্ধকালীন ঝুঁকির বিমা সুবিধা দিতে হবে।
এসব কাজের জন্য ইউক্রেনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। পশ্চিমা মিত্রদেরও তা থাকতে হবে। ন্যাটো সদস্যপদই দীর্ঘমেয়াদে ইউক্রেনের নিরাপত্তার একমাত্র গ্যারান্টি হতে পারে। কিন্তু, ন্যাটো যুদ্ধরত ইউক্রেনকে সদস্যপদ দিতে আগ্রহী নয়। বরং পশ্চিমারা দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এগুলো তাদের রক্ষা করতে হবে।
একইভাবে, ইউক্রেনের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো- ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ। কিন্তু, এজন্য চাই গতিশীল একটি অর্থনীতি। চারদিকে যখন যুদ্ধ, ধবংসযজ্ঞ আরও বিস্ফোরণের ত্রাস – তারমধ্যে অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করাটা খুবই কঠিন। এমনকী ইসরাইলকেও কখনো এত শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে হয়নি। কিন্তু, ইসরাইল যা পায়নি, কোন একদিন ইউক্রেন তা পেতে পারে। আর সেটা হলো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী অর্থনৈতিক জোটের সদস্যপদ। ইইউ সদস্যপদ পেতে এক দশকের বেশি সময় লাগতে পারে। এজন্য এখন থেকেই একটি রোডম্যাপ নিতে হবে ইউক্রেনকে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিভিন্ন মাইলফলক অর্জনের সুস্পষ্ট রূপরেখা থাকতে হবে। গতিশীল করতে হবে অর্থনীতির সংস্কারকে। ১৯৯০ এর দশকে ইইউ সদস্যপদ লাভের উদ্দেশ্যে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো একইভাবে উদ্যোমী হয়েছিল– সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারে কিয়েভ।