কুর্স্ক অঞ্চলে উ. কোরীয় সেনাদের উপস্থিতিতে হিতে-বিপরীত হতে পারে মস্কো, পিয়ংইয়ংয়ের জন্য!
রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে উত্তর কোরীয় সেনারা, এনিয়ে এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই। পশ্চিমা গোয়েন্দাদের দাবি, প্রশিক্ষণ শেষে খুব শীঘ্রই তারা কুর্স্কের লড়াইয়ে অংশ নেবে।
সত্যি-ই তেমনটা হলে রাশিয়ার জন্য হিতে-বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এমনকী পিয়ংইয়ংয়ে কিম জন উনের শাসন অস্থিতিশীল হতে পারে।
কুর্স্ক রাশিয়ার ভূখণ্ড এটি মনে রাখা দরকার। যেখানে আগ্রাসনকারী পক্ষ হচ্ছে ইউক্রেন। যতদূর জানা গেছে, কুর্স্ক দখলমুক্ত করতে রুশ বাহিনীর পাল্টা-আক্রমণে ইউক্রেনীয়রা অনেক সেনা ও সরঞ্জাম হারাচ্ছে। এভাবে ইউক্রেনীয়দের কুর্স্ক অঞ্চলের গ্রামগুলো থেকে ধীর গতিতে হলেও– বিতারিত করতে সফল হচ্ছে মস্কো।
এই লড়াইয়ে ময়দানে তিন হাজার বা এমনকী ১০ হাজার উ. কোরীয় সেনাও যদি অংশ নেয়– তাতেও খুব বেশি হেরফের হবে না। কারণ, রাশিয়ার একটি যুদ্ধকালীন ব্রিগেডে পদাতিক সেনা থাকে প্রায় ৮ হাজার, উ. কোরিয়দের পাঠানো সেনা খুব বেশি হলে এক ব্রিগেডের সমান শক্তি যোগ করবে।
পূর্ব রাশিয়ায় যেসব উ. কোরীয় সেনাদের দেখা গেছে তারা হলো পদাতিক সেনা। তাদের কাছে কোনো ট্যাংক, সাঁজোয়া যান বা কামানও দেখা যায়নি। রাশিয়ার যুদ্ধকৌশলেও তাদের প্রশিক্ষণ রয়েছে ন্যূনতম পর্যায়ের। তাদের বেশিরভাগ-ই রুশ ভাষা জানে না।
সম্প্রতি উ. কোরিয়ার সাথে করা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি অনুমোদন করেছে রাশিয়ার পার্লামেন্ট দ্যুমা। সংশোধিত এই চুক্তির অধীনে, দুই দেশের যে কেউ আক্রান্ত হলে– অপরপক্ষ তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে।
মনে রাখা দরকার, কুর্স্কে ইউক্রেনের আক্রমণ অভিযান রুশ ভূখণ্ডে আগ্রাসনেরই নামান্তর। এই পদক্ষেপের ফলে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পাদিত প্রতিরক্ষা চুক্তিটি কার্যকর করার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।
উ. কোরিয়ার সামরিক বাহিনী সম্পর্কে অবশ্য খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। তবে কিছু বিষয় স্পষ্ট, যা তাদের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। যেমন ১৯৫৩ সালে অস্ত্রবিরতির মধ্যে দিয়ে কোরীয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে– অনেক দশক তারা কোনো বড় স্থলযুদ্ধে অংশ নেয়নি। আর আধুনিক সময়ের মানদণ্ডে, আধুনিক সাজ-সরঞ্জাম ও অভিজ্ঞতাহীনতা– এ দুয়েই বহু পেছনে রয়েছে তারা।
উ. কোরিয়ার ট্যাংকগুলো মান্ধাতার আমলের, সেগুলো রাশিয়ায় আনা হয়নি বলেও জানা যাচ্ছে। উ. কোরিয়ার কাছে বিপুলসংখ্যক কামান আছে ঠিকই, কিন্তু তার অংশবিশেষও রাশিয়ায় মোতায়েন করা সেনাদের কাছে দেখা যায়নি। এই সেনাবাহিনীর যোগাযোগ, কমান্ড ও কন্ট্রোল ব্যবস্থা সম্পর্কেও বিশেষ কিছু জানা যায় না, তবে এগুলো বহু পুরোনো সরঞ্জাম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে রাশিয়ার তুলনামূলক আধুনিক সরঞ্জামের সাথে এগুলোর সংযোগ আদৌ স্থাপন করা যাবে কিনা– তা নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ রয়েই যায়।
এরপরেও কুর্স্কে উ. কোরীয় সেনাদের উপস্থিতির বিষয়ে ইউক্রেন শোরগোল করছে একটাই উদেশ্যে, আর তা হলো– ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি ও তার সামরিক গোয়েন্দা প্রধান চাইছেন, পশ্চিমারা সেনা পাঠিয়ে তাদের পরাজিত হওয়া থেকে রক্ষা করুক। সেক্ষেত্রে উ. কোরীয় সেনাদের আগমনকে একটি বড় সুযোগ হিসেবে নিতে চান তারা। যাতে ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্য বা ন্যাটোতে যেকোনোভাবে অঙ্গীভূত করার পক্ষে আরো দৃঢ় যুক্তি দেওয়া যায়। আর একবার ন্যাটোভুক্ত হলে– বাধ্যতামূলকভাবে দেশটিকে রক্ষার জন্য সেনা পাঠাতে হবে ন্যাটো জোটকে।
ইউক্রেনকে সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে কোনো ঐক্যমত্য নেই। ফরাসীরা এর পক্ষে থাকলেও, জার্মান ও পোলিশ সরকার এর বিরুদ্ধে। অন্যান্য সদস্য দেশের বিরোধিতাও রয়েছে। তবে ইরাক যুদ্ধের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছিল, তেমন করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে ইচ্ছুক দেশদের নিয়ে একটি কোয়ালিশন গঠনের উদ্যোগ নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সও এতে যোগ দিতে পারে। তবে একাজটি করতে হলে, ন্যাটোর অনিচ্ছুক সদস্যদের সমর্থন নিতে হবে বা তাদের রাজী করানোর চেষ্টা করতে হবে। কিছু দেশ এতে রাজী হবে না, যার মধ্যে জার্মানি ও পোল্যান্ড হতে পারে অন্যতম।
সম্মতির ভিত্তিতে গঠিত এই কোয়াশিলশনের পোল্যান্ডে সামরিক ঘাঁটি ও সেনা মোতায়েনের দরকার হবে। কিন্তু, তাতে করে এসব ঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালাবে রাশিয়া, আর পোল্যান্ড সেই লক্ষ্যবস্তু হতে চায় না। এর আগে ইউক্রেনের পক্ষ নিয়ে ওয়ারশ যতই বাহাদুরি দেখাক, এ ধরনের কোয়ালিশনকে পোল্যান্ডের সমর্থন দেওয়ার সম্ভাবনা কার্যত শূন্য।
তীব্র নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকা উ. কোরিয়ার সেনারা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে— যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা হবে অপমানজনক। নিঃসন্দেহে সে হুমকি দিয়েই ওয়াশিংটনকে খোঁচাচ্ছেন পুতিন। তবে তিনি নিশ্চিতভাবে এটাও জানেন যে, এসব সেনাদের দিয়ে লড়াই করানো হলে– সামরিক কার্যক্রম ও রসদ সরবরাহ সংক্রান্ত বোঝা তৈরি করবে।
ইউক্রেনকে সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে কোনো ঐক্যমত্য নেই। ফরাসীরা এর পক্ষে থাকলেও, জার্মান ও পোলিশ সরকার এর বিরুদ্ধে।
উ. কোরীয় সেনারা যুদ্ধে অংশ নিলে — যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব তাদেরকে হত্যার সুযোগ পাবে ইউক্রেন। ফলে সহায়ক হওয়ার বদলে ক্ষতিগ্রস্তই বেশি হবে রাশিয়া-উ. কোরিয়ার নতুন জোট। একইভাবে, ইউক্রেন যুদ্ধে সেনাদের বিপুল প্রাণহানি ও সেনাবাহিনীর অদক্ষতা প্রমাণিত হলে– তা কিম জং উনের শাসকগোষ্ঠীকে অস্থিতিশীল করতে পারে। পরিবারতারন্ত্রিক যে শাসনব্যবস্থা ক্ষমতায় টিকে থাকতে সামরিক বাহিনীর ওপরই নির্ভর করে, এবং জনগণের সমর্থন আদায়ের কোনো পন্থাও যারা জানে না।
অন্যদিকে, উ. কোরীয় সেনাদের নিয়ে তেমন শঙ্কার কোনো কারণও নেই ইউক্রেনীয়দের। এসব সেনাদের ব্যবস্থাপনা করাও রাশিয়ার জন্য এক চ্যালেঞ্জ হবে। এতে যুদ্ধ কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে, যা রাশিয়ার কুর্স্ক দখলমুক্ত করার অপারেশনকে ব্যাহত করবে।
ইউক্রেনীয় নেতারা এসব বিষয় নিশ্চয় জানেন, তবে তারা আশা করছেন, এই ঘটনা কিছু ন্যাটো দেশের মনোভাব পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে, এবং তারা উদ্যোগ নিয়ে ইউক্রেনকে পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে। সেক্ষেত্রে এই দুর্যোগ থেকে তাদের পরিত্রাণের টিকেট হচ্ছে উ. কোরীয় সেনারা।
লেখক: স্টিফেন ব্রিয়েন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির নিকটপ্রাচ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সাবেক স্টাফ ডিরেক্টর। নিবন্ধটি প্রথমে লেখকের সাবস্টাকে প্রকাশিত হয়, পরবর্তীতে তার অনুমতি নিয়ে সেটি পুনঃপ্রকাশ করেছে এশিয়া টাইমস।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।