রোদ, বৃষ্টি, ময়লায় ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে তারা
ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত পটুয়াখালীর বাসিন্দা রোজিনা আক্তার (৩০)। কেমোথেরাপির কারণে মাথায় চুল নেই। বিষণ্ণ চেহারা। রোজিনার সাতটি কেমো দেয়া শেষ হয়েছে। আরও কয়েকটি কেমোথেরাপি দেওয়ার পর তার সার্জারি করা হবে। তারপর দেয়া হবে রেডিওথেরাপি।
রোজিনা থাকছেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এনআইসিআরএইচ) পাশে একটি খালি জায়গায় ময়লার স্তূপে। এখানে পাটি বিছিয়ে ও মশারি টানিয়ে বসবাস করছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রোজিনার মতো আরও দরিদ্র ক্যান্সার রোগীরা।
বসবাসের অযোগ্য এই জায়গাটিকে একটু বসবাসযোগ্য করার জন্য একটি পাটি ও মশারি টানিয়ে বসবাস করেন রোজিনা। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর দুই সন্তানকে নিয়ে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে রোজিনা বলেন, 'একেকটা কেমোথেরাপিতে ১২-১৪ হাজার টাকা প্রয়োজন হয়। মানুষের কাছে হাত পেতে সেই সাহায্য এনে চিকিৎসা চলছে। রিকশাচালক ভাই মাঝে মাঝে চিকিৎসার খরচ দেয়। বাড়ি যাওয়া-আসায় খরচ হয় ২ হাজার টাকা। সে টাকা নাই, তাই এখানেই থাকি।'
এভাবেই বছরের পর বছর ধরে লড়ছেন ঢাকার জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা দরিদ্র রোগীরা। তবু এই মানুষগুলোর কোনো দুঃখ নেই, অভিযোগ নেই; বরং হাসপাতালের কাছাকাছি থাকার একটা জায়গা পেয়ে তারা বেশ খুশিই।
দিনের বেলায় তারা চিকিৎসার অর্থ জোগাড়ের জন্য ভিক্ষা করতে বের হন, আর রাতে এসে ঘুমান মশারি টানিয়ে, পাটি বিছিয়ে।
৭ বা ২১ দিনের বিরতিতে তাদের কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। কিন্তু ৭ বা ২১ দিন পরপরই গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার দুই-তিন হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া তাদের নেই। আবার ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া করে থাকার সামর্থ্যও তাদের নেই।
৬ মাস ধরে ওই খোলা জায়গায় বসবাস করছেন রোজিনা। বাড়ি যাওয়া-আসার খরচ জোগাড় করতে পারেন না বলে এখানেই থাকেন। তাতে অন্তত হঠাৎ শরীর খারাপ হলে ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসা নিতে পারেন বলে জানালেন।
ক্যান্সারের কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি দেয়ার সময় রোজিনা আক্তারের মতো ক্যান্সার রোগীরা ক্যান্সার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি থাকেন। তারপর তাদের জায়গা হয় এই ময়লার স্তূপের পাশে। এই রোগীদের তাই ক্যান্সারের পাশাপাশি রোদ, বৃষ্টি, মশার সঙ্গেও লড়তে হচ্ছে।
'নোংরা জায়গা হোক, তা-ও আমরা ভালো আছি। চিকিৎসা তো করতে পারছি। যেহেতু আমাদের পয়সা নেই, উপায় নাই। আমরা গরিব মানুষ; টাকা নাই, পয়সা নাই, বাসা ভাড়া করতে পারি না,' স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসা রংপুরের কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন টিবিএসকে।
রংপুরের কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ঢাকায় তিন বছর ধরে ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত স্ত্রী হামিদা বেগমের চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে সিরাজুল ইসলামের।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'রংপুর মেডিকেলে রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি দেয়া হয় না। রংপুরে যদি ক্যান্সারের চিকিৎসা হতো, তাহলে আমাদের হয়রানি ও খরচ কিছুটা কমতো।'
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের হেমাটোলজি স্পেশালিষ্ট গুলজার হোসেন টিবিএসকে বলেন, '৫০০ বেডের ক্যান্সার হাসপাতালে প্রতিদিন ৫০০ রোগী ভর্তি থাকে। বেডের অতিরিক্ত কোনো রোগী এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় না।
'প্রতিদিন আউটডোরে ১,০০০ রোগী চিকিৎসা নেয়। তার মধ্যে থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫০ জন রোগী ভর্তি করা হয়। কিন্তু ভর্তি রোগীর চাহিদা থাকে অনেক বেশি।'
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, প্রতিদিন প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ রোগীকে কেমোথেরাপি ও ৪০০ রোগীকে রেডিওথেরাপি দেয়া হয় এখানে। হাসপাতালে শয্যা সংকটের কারণে সব রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না। এ কারণে স্থিতিশীল রোগীকে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দেয়ার পর ছেড়ে দেয়া হয়। রোগীরা তারপর নিজ দায়িত্বে যেকোনো জায়গায় থেকে চিকিৎসা চালিয়ে যান।
গ্লোবোক্যান ২০২০-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় ১ লাখ ৫৬ হাজার মানুষ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি ক্যান্সার কেন্দ্র দরকার। সেই হিসাবে বাংলাদেশে ক্যান্সার কেন্দ্রের প্রয়োজন ১৬০টি। কিন্তু এর বিপরীতে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ক্যান্সার কেন্দ্র রয়েছে ২০টিরও কম। এসব ক্যান্সার কেন্দ্রও আবার রাজধানীকেন্দ্রিক।
শুধু হাসপাতাল সংকট নয়, ক্যান্সার চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ও জনবলের সংকটও আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, সারা দেশের জন্য রেডিওথেরাপি মেশিন দরকার ৩০০টি। কিন্তু দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৩৭টি মেশিন আছে। অধিকাংশ মেশিনই কারিগরি ত্রুটির ফলে বছরের অধিকাংশ সময় অচল থাকে।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিট এবং হাসপাতালে রেডিওথেরাপির সিরিয়ালের জন্য তিন থেকে চার মাস অপেক্ষা করতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন রোগীরা।
ক্যান্সার এপিডেমিওলজিস্ট ও প্রিভেন্টিভ অনকোলজিস্ট অধ্যাপক ড. হাবীবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন টিবিএসকে বলেন, 'দেশের আট বিভাগীয় শহরে ক্যান্সার হাসপাতাল করা হচ্ছে। তাহলে হয়তো মানুষের ভোগান্তি কিছুটা কমবে।
'তবে শুধু হাসপাতাল স্থাপন ও মেশিন দিলেই হবে না, তা পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন। এছাড়া ক্যান্সার চিকিৎসার পাশাপাশি প্রিভেন্টিভের ওপর এখন জোর দিতে হবে।'
মাথায় চুল নেই, চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। দেখে বোঝার উপায় নেই ইসমত আরার বয়স মাত্র ২৭ বছর। ব্লাড ক্যান্সারে আক্তান্ত ইসমত আরাকে ছয় মাস আগে তার স্বামী ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেখে গেছেন।
ইসমত আরা বলেন, 'হাসপাতালের আশেপাশের বাড়িতে প্রতিদিন ২০টাকা দিলে ভাত ও তরকারি রান্না করতে চুলা ব্যবহার করতে দেয়। আর পাশের বক্ষব্যাধি হাসপাতাল থেকে পানি এনে খাই।
'নিরাপত্তা প্রহরীরা এখানে থাকতে দিতে চায় না, আমরা জোর করে থাকি। এভাবে থেকে কত দিন চিকিৎসা করতে পারব জানি না।'