কৈখালীর নারীদের পিরিয়ড নিয়ে সংগ্রামে পাশে থাকবে সেনোরা'র পানির ট্যাঙ্ক
পিরিয়ড বন্ধ করতে মায়ের গর্ভনিরোধক বড়ি চুরি করে সাতক্ষীরার এক কিশোরী। পিরিয়ডের সময় কাপড়ের ন্যাকড়া ব্যবহার এবং এরপর লবণাক্ত পানিতে সেই কাপড় পরিষ্কার করার মতো ঝামেলা এড়াতে সে এই কাজ করে।
আরেক কিশোরী মাকে দীর্ঘদিন ধরে জরায়ু রোগে ভুগতে দেখেছে। সে নিজেও মায়ের মতো ভুক্তভোগী হতে চায়নি। আর তাই এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে বড়ি নিয়ে সেগুলো সেবন করতে শুরু করে। দুই বান্ধবীকেও একই পরামর্শ দেয় সে।
পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংবাদ পোর্টাল মঙ্গাবে-তে জেসমিন পাপড়ি 'ফর উইম্যান অন বাংলাদেশ'স কোস্ট, রাইজিং সিজ পোজ আ রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ ডিলেমা'- শীর্ষক এক প্রতিবেদনে পিরিয়ডের সময় লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ঝামেলা এড়াতে নারী ও কিশোরীদের জন্মনিরোধক বড়ি সেবনের গল্পগুলো বিশদভাবে তুলে ধরেন।
বিশুদ্ধ পানির উৎসের অভাব ও স্যানিটারি ন্যাপকিন সহজলভ্য না হওয়ায় কৈখালী, সাতক্ষীরার মতো বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য বড়ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এসব অঞ্চলে কয়েকটি পুকুর বাদে অন্যসব পানির উৎসের বেশিরভাগই লবণাক্ত।
এমনকি কিছু দোকানে স্যানিটারি ন্যাপকিন পাওয়া গেলেও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে নারীরা সেখানে গিয়ে নিজেদের জন্য সেগুলো কিনতে পারে না। পরিবারের কোনো ঘনিষ্ঠ পুরুষ সদস্যকে বলে ন্যাপকিন কিনে আনায় তারা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং চিংড়ি চাষের কারণে এসব অঞ্চলে পানির লবণাক্ততা বাড়চ্ছে এবং সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণ ও চর্মরোগের মতো নানান স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার সঙ্গে লবণাক্ততার যোগসূত্র রয়েছে। এধরনের সংক্রমণ থেকে জরায়ুর বিভিন্ন রোগ হতে পারে। নোনা পানি অধ্যুষিত এলাকায় এসব রোগ বেশি দেখা যায়।
চলতি বছরের জুলাই মাসে স্কয়ার টয়লেট্রিজের মালিকানাধীন দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রতিষ্ঠান সেনোরা- কৈখালীর নারীদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নেয়।
কৈখালী বর্ষাকালে ভারী বৃষ্টিপাতের জন্য পরিচিত। সেনোরা নারীদের জন্য ইউনিয়নের ছয়টি পয়েন্টে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করতে ১২টি পানির ট্যাঙ্ক স্থাপন করে। জুলাই মাসে দুই সপ্তাহের ভেতর ট্যাঙ্কগুলো নির্মিত হয়।
পেইন্ট করা রঙিন এই ট্যাঙ্কগুলো স্কুল এবং মসজিদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোর কাছে নির্মাণ করা হয়। যত্নসহকারে এর ছাদ নির্মিত হয়েছে যাতে বৃষ্টির পানি সেখানে জড়ো হয়ে পাইপের মাধ্যমে ট্যাঙ্কে এসে জমা হয়।
একেকটি ট্যাঙ্ক ৭,৫০০ লিটার পানি ধারণ করতে পারে। পাইপের মুখে রেগুলার ফিল্টার বসানো হয়েছে যাতে ট্যাঙ্কে প্রবেশ করা পানি মোটামুটি পরিষ্কার থাকে। তবে এই পানি পান করা যাবে না।
একই সঙ্গে পিরিয়ড সম্পর্কিত পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সেনোরা কৈখালীর নারীদের সঙ্গে সাতটি 'উঠান বৈঠক'-এর আয়োজন করে। এছাড়া তারা ৩০০ জনের বেশি কিশোরীকে বিনামূল্যে তিন মাসের স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করে।
এই মিটিংগুলোর মাধ্যমে কমিউনিটির দুজন নারীকে 'নোরা আপা' হিসেবে কাজ করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নোরা আপারা হলেন আশেপাশের বন্ধুসুলভ নারীকর্মীরা যারা বিনামূল্যে সেনোরা ন্যাপকিনগুলো বিতরণ করছেন। পিরিয়ড সংক্রান্ত বিভিন্ন সাধারণ পরামর্শের জন্যও নারীরা তাদের কল করতে পারবেন। তবে তারা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তারদের বিকল্প নন।
এমনই একজন শৈলখালী গ্রামের ২১ বছর বয়সী খাদিজা সুলতান। খাদিজা এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে তিনি 'নোরা আপা' হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, 'লবণাক্ত পানি ও স্যানিটারি ন্যাপকিনের সংকটের জন্য কৈখালীর নারীদের কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, আমি সেসব জানি। স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে আমরা দোকানে যেতে পারি না, তাই মেয়েরা এখন আমার কাছে বিনামূল্যে প্যাড নিতে আসছে। সত্যিই ভালো লাগছে।"
কুমুদিনী উইমেন'স মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব ব্যাখ্যা করে বলেন, 'বড়ি ব্যবহারের কিছু নিয়ম আছে যেমন প্রতিদিন একই সময়ে খাওয়া ইত্যাদি। আপনি ইচ্ছামতো এগুলো ব্যবহার করতে পারবেন না এবং অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া তো নয়ই,' বলেন তিনি।
অনিয়ন্ত্রিতভাবে বড়ি ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, 'যদি মুখে খাওয়ার বড়ি একবার ব্যবহার করে বন্ধ করে দেওয়ার পর আবার ব্যবহার করা হয় তবে এর কারণে অনিয়মিত রক্তপাত হতে পারে যার কারণে রক্ত স্বল্পতা দেখা দিতে পারে'।
সেনোরার বিশ্বাস তাদের প্রচেষ্টা ছোট পরিসরে হলেও কৈখালীর নারীদের জীবন পরিবর্তনে সাহায্য করবে।
স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের মার্কেটিং বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক ও সেনোরার মুখপাত্র তেহসিনা খানম জানান, প্রথমে তারা শুধু কৈখালীর পরিস্থিতি কেমন এবং সেখানে কী ধরনের সহায়তা দেওয়া যায় সেসব দেখতে চেয়েছিলেন। 'আমরা দেখেছি যে মাসিকের মতো একটি প্রাকৃতিক জিনিস বড়ি দিয়ে বন্ধ রাখা হচ্ছে। এটি আমাদের বেশ চিন্তায় ফেলে দেয়,' বলেন তিনি।
আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের পর তারা জানতে পারেন যে এখানকার পরিস্থিতি তাদের কল্পনার চেয়েও অনেক খারাপ। আর তাই অবিলম্বে কিছু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
আপাতত প্রতিষ্ঠানটি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিনামূল্যে প্যাড দিচ্ছে। সেনোরা অক্টোবরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে একটি ফলোআপ সেশন পরিচালনা করবে। এরপর পরিকল্পনামাফিক এগুলে নারীরা নোরা আপার কাছ থেকে ছাড়কৃত মূল্যে প্যাড কিনতে পারবেন।
তেহসিনা বলেন, 'কৈখালী থেকে আমাদের দল ফিরে আসার পর মাঠপর্যায়ের কাজ থেকে নারীদের দুর্ভোগের ব্যাপ্তিটা সামনে আসে। এমনকি তারা যে পানি পান করে সেটিও লবণাক্ত পানি,' বলেন তহসিনা।
স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের মার্কেটিং ডেভলপমেন্টের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মীর মনিরুল হোসেন মনে করেন ৩০০ জন মেয়েকে সাহায্য করা মানে ৩০০ পরিবারকে সাহায্য করা। 'আমরা স্থানীয়দের বলার চেষ্টা করেছি তাদের মা এবং মেয়েরা পিরিয়ডের সময় পরিষ্কার পানি ব্যবহার করছে এটা যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তারা সুস্থ থাকবে। এছাড়া তারা যদি সুস্থ থাকে তাহলে পরিবারের সদস্যদের আরও ভালো করে যত্ন নিতে পারবেন।'
২২ বছর বয়সী মুসলিমা সেনোরার এই উদ্যোগের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে তিনি বিশ্বাস করেন যে এগুলো যথেষ্ট নয়। লবণাক্ততা কমানো এবং পরিষ্কার পানির উৎস বাড়াতে স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে।
'আমার বাড়ির সবচেয়ে কাছের পানির ট্যাঙ্কটি প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে। কিছু মানুষ ইতোমধ্যেই ট্যাঙ্কের পানি পান করার জন্য ব্যবহার করা শুরু করছে কারণ এখানে সবজায়গায় লবণাক্ত পানি," তিনি উল্লেখ করেন।
পানির ট্যাংক যে স্থায়ী সমাধান নয় সে বিষয়ে তেহসিনা খানমও একমত। 'আমরা জানি শুষ্ক মৌসুমে এর ওপর নির্ভর করা কঠিন হবে। আর মূল সমস্যাটি লবণাক্ত পানি নিয়ে।'
সরাসরি লবণাক্তরার জন্য কোনো সমাধান দেওয়া যায় কি না, তা তারা তিন মাস পর দেখার চেষ্টা করবেন বলে জানান তিনি।