ইরানের দেওয়া ড্রোন আর রাশিয়ার প্রচণ্ড বাধার মুখে থমকে যাচ্ছে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ
দক্ষিণে কৃষ্ণসাগর উপকূলের কাছে, আর পূর্বে– ডনবাস অঞ্চলের ছোট আকৃতির পাহাড়ি ভূুমিতে–উভয় অঞ্চলেই ইতোমধ্যে উদ্ধারকৃত এলাকার নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে নতুন এলাকা দখলে অগ্রসর হচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। কিন্তু, শত্রুর প্রবল বাধার মুখে থমকে যাচ্ছে তাদের অগ্রযাত্রা।
প্রতিরোধকারী রুশ বাহিনীর সাথে তাদের সামনের প্রতিটি ইঞ্চি ভূমি মুক্ত করার জন্য লড়তে হচ্ছে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন বলছে, ইউক্রেনীয় বাহিনীকে এখন ইরান থেকে সংগ্রহ করা ড্রোনের হামলার মুখে পড়তে হচ্ছে। জনবল বাড়াতে জেল থেকে দুধর্ষ কয়েদিদের মুক্তি দিয়ে তাদের যুদ্ধে নামিয়েছে রাশিয়া। রুশ বাহিনীর অতিরিক্ত এসব শক্তি মোকাবিলা করতে গিয়ে আগের গতিই হারাচ্ছে ইউক্রেনীয় 'কাউন্টার- অফেন্সিভ'।
রোববার ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির দেওয়া নৈশকালীন ভাষণেও ছিল তার আভাস। তিনি বলেন, 'অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সিরিজ জয়ের পালার পর এখন থমকে যাচ্ছে অগ্রগতি। তবে এটি থেমে যাওয়া নয়, বরং যুদ্ধের পরবর্তী অংশের প্রস্তুতি'।
গত সপ্তাহান্ত (রোববার) নাগাদ রুশ বাহিনীর ওপর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী। শত্রুপক্ষের শক্তঘাঁটি ও রাশিয়ার প্রতি অনুগত স্থানীয় কর্মকর্তাদের দপ্তর লক্ষ্য করে চালাচ্ছে তীব্র হামলা। দিনিপ্রো নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত রুশ বাহিনীর সরবরাহ লাইনেও আঘাত হানা অব্যাহত রেখেছে। রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত খেরসন শহরে তাদের হামলার ফলে সেখানকার নিরাপত্তা বাহিনী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে, শহরে অরাজকতা তৈরি হওয়ারও খবর দিয়েছে পশ্চিমা গণমাধ্যম।
ইউক্রেনীয় বাহিনীকে ঠেকাতে ডনবাস অঞ্চলের আরও উত্তর ও পূর্বে অগ্রসর হচ্ছে রাশিয়ান সেনারা। রোববার বাখমুত শহরে তাদের এগিয়ে আসার জানান দিয়েছে কামানের গগনবিদারী গর্জন। একইসঙ্গে, এতে করে যুদ্ধ-সাংবাদিকরা ধারণাও পেয়েছেন ইউক্রেনীয় বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কোন কোন অবস্থানে হামলা চলছে। এতে ইউক্রেনীয়রা বেশ বিপদের মধ্যেই পড়েছে। কারণ উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে হামলা চালিয়ে ইউক্রেনের বাকি অংশের সাথে তাদের সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইছে রাশিয়ানরা।
যুদ্ধের আগে বাখমুতের জনসংখ্যা ছিল ৭০ হাজার। আকারে ছোট শহর হলেও বাখমুতের আছে কৌশলগত গুরুত্ব। খনিজ-সমৃদ্ধ ডনবাস অঞ্চলের বাদবাকি অংশ দখলে নেওয়ার রুশ পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে এই শহর।
ইতঃপূর্বে গত জুলাইয়ের শুরুতে শিল্পনগরী লিশিচানস্ক দখলে নেয় রুশ বাহিনী। এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করে লুহানস্ক প্রদেশে। এরপরই তারা বাখমুত দখলে ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করে।
গত সপ্তাহজুড়ে ইউক্রেনের উত্তরপূর্ব অঞ্চলে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে রুশ বাহিনী, পশ্চিমাদের দাবি, তারা একের পর এক লড়াইয়ে হেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এসময় খারকিভ শহরের আশেপাশে কয়েক ডজন গ্রামসহ প্রায় এক হাজার বর্গমাইল এলাকা পুনরুদ্ধারের দাবি করে কিয়েভ।
তারপরও বাখমুতে হামলা অব্যাহত রেখেছে রুশরা।
ইউক্রেনীয় সেনারা বলছে, বাখমুতে তাদের ওপর হামলাকারী রাশিয়ান সেনাদের সংখ্যায় কোনো কমতি দেখা যাচ্ছে না। তাদের অনেকেই নিয়মিত রুশ সেনা নয়।
বাখমুতের প্রতিরক্ষায় জড়িত সম্মুখভাগের এ সেনাদের আরও দাবি, এখানে হামলাকারী রুশ সেনাদের বেশিরভাগই মার্সেনারি সংস্থা– ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধা। বেসরকারি এই ভাড়াটে যোদ্ধা কোম্পানির সাথে রয়েছে ক্রেমলিনের নিবিড় সম্পর্ক। এর আগে সিরিয়া ও লিবিয়ার যুদ্ধেও ক্রেমলিনের হয়ে লড়েছে ওয়াগনারের যোদ্ধারা। ইউক্রেনীয় সেনাদের মতে, ওয়াগনার গ্রুপ জেলখানার কয়েদিদের নিজ বাহিনীতে ভর্তি করেছে।
গত মঙ্গলবার অনলাইনে প্রকাশিত একটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। এতে দেখা যায়, ওয়াগনার গ্রুপের কর্মকর্তারা কয়েদিদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, ছয় মাস ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিলে তাদের কারাদণ্ড পুরোপুরি মওকুফ করা হবে। তবে ভিডিওটি কবে ধারণ করা হয়েছে– টাইমস সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি।
কিয়েভ দখলে ব্যর্থতার পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ডনবাস দখলে নেওয়াকেই এ যুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেন, যেখানে এখন চলছে প্রচণ্ড লড়াই।
পুতিন বলেছেন, ডনবাস ঘিরে রুশ বাহিনীর লক্ষ্যপূরণ হচ্ছে। কিন্তু, তার যথাযথতাও প্রশ্নবিদ্ধ।
বিগত সপ্তাহে ইউক্রেনীয় পাল্টা-আক্রমণ অভিযানে দক্ষিণের বন্দর নগরী খেরসন এবং উত্তরপূর্বে ব্যাপক হারের সম্মুখীন হয় রুশরা। এরপরও গত শুক্রবার উজবেকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)- এর আঞ্চলিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে, ডনবাসের দখলই তার 'বিশেষ সামরিক অভিযানের প্রধান লক্ষ্য '- এমন দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন পুতিন।
রোববার দেশটির কর্মকর্তারা দাবি করেন, খেরসনের একটি কটন মিলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা হয়েছে, যা রুশ বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছিল। শহরটির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ক্রেমলিন-সমর্থিত সামরিক প্রশাসনের একটি কার্যালয়ও হয় হামলার লক্ষ্যবস্তু।
খেরসনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে রাশিয়া যে দাবি করছে, তাকে চ্যালেঞ্জ করছে গত শনিবার রাতে শহরের রাস্তায় হওয়া বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা। রাশিয়ান সামরিক ব্লগারদের প্রকাশিত ভিডিওচিত্রে যা দেখা যায়। অথচ খেরসন রাশিয়ার কাছে অতি-গুরুত্বপূর্ণ। গত ফেব্রুয়ারিতে আগ্রাসন চালানোর পর থেকে ইউক্রেনের প্রাদেশিক রাজধানীগুলির মধ্যে একমাত্র খেরসন-ই গেছে রাশিয়ার দখলে।
শনিবার রাতে সেখানে কাদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে তা জানা জানা যায়নি। তবে স্থানীয় রুশ প্রশাসন লুকিয়ে থাকা ইউক্রেনীয় গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয় বলে জানিয়েছে। এবিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি দেয়নি ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী। তবে কিয়েভের কর্মকর্তারা বলছেন, মস্কো পক্ষীয় যোদ্ধাদের মধ্যে এটি গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের ঘটনা হতে পারে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের শীর্ষ উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াক বলেন, 'পালিয়ে যাওয়ার আগে রুশদের মধ্যে লুট করা সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে বচসা থেকেই বন্দুকযুদ্ধের সূত্রপাত'।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে খেরসনে কাউন্টার-অফেন্সিভে আছে ইউক্রেন। সেখানকার রুশ যোদ্ধাদের রণক্লান্ত করে তাদের আত্মসমর্পণ বা পিছু হঠতে বাধ্য করতে চাইছে। কিন্তু, উত্তরপূর্বের ডনবাসের তুলনায় এখানে তেমন সফলতা পাচ্ছে না কিয়েভ। ডনবাসে রুশ সেনারা বিশাল সম্মুখভাগে কম সংখ্যায় ছড়িয়ে থাকায় ঝটিকা প্রতি আক্রমণের শক্তি মোকাবিলা করতে না পেরে পিছু হটে যায়। কিন্তু, দক্ষিণে (খেরসনে) আক্রমণ আসবে জেনে আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল রাশিয়ানদের। সেখানে তারা অনেক শক্তঘাঁটিও গড়েছে।
তাই ইউক্রেনের প্রচণ্ড হামলার পরও সেখান থেকে রুশ সেনাদের গণহারে পিছু হটার মতো কোনো ইঙ্গিত মেলেনি। উল্টো রুশ বাহিনী ইউক্রেনীয় অবস্থান লক্ষ্য করে প্রতিঘাত করছে, গোলায় গুঁড়িয়ে দিচ্ছে তাদের আয়ত্তে থাকা শহর ও গ্রাম।
দনিপ্রো নদীর পশ্চিম পাড়ে খেরসন এবং এর আশেপাশের অঞ্চলই কেবল রাশিয়ার দখলে। সেখানে রুশ বাহিনীর কম্যান্ড সেন্টার ও গোলাবারুদের মজুদাগারে হামলা অব্যাহত রেখেছে ইউক্রেন। তাদের সরবরাহ লাইনে মিসাইল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে কিয়েভ, চাইছে খেরসনের প্রতিরক্ষায় থাকা ২৫ হাজার রুশ সেনাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে।
তবে খেরসনে তৃতীয় সপ্তাহে পা রাখা ইউক্রেনীয় কাউন্টার-অফেন্সিভ থমকে যাচ্ছে। রুশ সেনারা প্রতিরোধের মনোবল ফিরে পেয়েছে। তবে সবচেয়ে প্রাণঘাতী আঘাত হানছে ইরান থেকে পাওয়া রাশিয়ার নতুন ড্রোনগুলি। এগুলির ব্যাপক ও সফল ব্যবহার হচ্ছে, যা অত্যন্ত ভীতিকর বলে স্বীকার করছেন ইউক্রেনীয় অফিসাররা।
রাশিয়া ইরানের শাহিদ-১৩৬ ড্রোন ব্যবহার করছে। কিন্তু, এনিয়ে কোনো চুক্তি হওয়ার বিষয়ে তেহরান বা মস্কো নীরবতা পালন করছে। তবে এই ড্রোনের কিছু অংশবিশেষ খেরসনের যুদ্ধাঞ্চল থেকে উদ্ধারের দাবি করেছেন ইউক্রেনের এক সামরিক কর্মকর্তা।
শাহিদ-১৩৬ একটি কামিকাজি বা আত্মঘাতি ড্রোন, যেটি শত্রুকে শনাক্ত করার পর তার ওপর আঘাত হেনে নিজেই বিস্ফোরিত হয়য়। এতে প্রায় ৪০ কেজি ওজনের বিস্ফোরক থাকায়, ধ্বংসক্ষমতাও মারাত্মক। ইউক্রেনে উপস্থিতির মধ্য দিয়ে এই প্রথম মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে ড্রোনটির ব্যবহার হচ্ছে।
ড্রোনের ঘটনায় আরও প্রমাণ হয়, যুদ্ধের ময়দানে চীন ও ভারতের সরকার-প্রধানদের সহায়তা না পেলেও, মস্কো তা ইরান থেকে ঠিকই জুটিয়ে নিয়েছে। এতে ইউক্রেনে আরও অনেক দেশ জড়িয়ে পড়ছে অস্ত্র সরবরাহে, বহু জাতির এই সম্পৃক্ততা সংঘাতকে আসছে দিনে আরও জটিল রূপ দেবে।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ইরান রাশিয়ার কাছে দুই ধরনের ড্রোন বিক্রি করেছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র অ্যাড্রিয়ানে ওয়াটসন বলেছেন, গত আগস্টে ইরানের একটি বিমানঘাঁটি নিয়ে ড্রোন লোড নিয়ে রওনা দেয় রাশিয়ার পরিবহন বিমান।
এর আগে ইরানি ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশ করেছিল প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
ওয়াটসন দাবি করেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ইউক্রেনে রাশিয়াকে সরবরাহে সংকটে ফেলতে অবদান রেখেছে। ফলে অনির্ভরযোগ্য (প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা) দেশের সরবরাহ ও অস্ত্রসরঞ্জাম ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছে রাশিয়া। ইরান থেকে পাওয়া ড্রোনগুলির ব্যর্থতার অনেক ঘটনা জেনেছে মার্কিন গোয়েন্দারা।
তার যুক্তির প্রতিফলন অবশ্য মাঠপর্যায়ে দেখা যাচ্ছে না। বরং ইরানি ড্রোনের উৎপাতে ত্রস্ত থাকতে হচ্ছে ইউক্রেনীয় সেনাদের।
ইউক্রেনে প্রথমবার ব্যবহারেই আমেরিকার সরবরাহ করা এম-৭৭৭ হাউইটজার ধ্বংস করেছে ইরানি ড্রোন। খারকিভ অঞ্চলের ইউক্রেনীয় আর্টিলারি কমান্ডার কর্নেল রডোগিন কুলাগিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এসব ড্রোন দিয়ে তাদের অন্তত ছয়টি হাউইটজার, সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়েছে।
তাই উত্তরপূর্বে সফলতা পেলেও ড্রোনের আবির্ভাবে ভ্রকুঞ্চিত হচ্ছে ইউক্রেনীয় সমরনায়কদের। কর্নেল কুলাগিন দ্রুত পশ্চিমা মিত্রদের এগুলি মোকাবিলার যথাযথ অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানান।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস