ঢাকায় ত্রিমাত্রিক ছবির এক আশ্চর্য জগত!
খ্রিস্টপূর্ব ৫ হাজার বছর আগে মিসরে তৈরি হয়েছিল পিরামিড। পিরামিড ও এর আশেপাশের এলাকাগুলো জুড়ে রয়েছে কতশত মমি। ধরুন, এরকম এক কফিন থেকে বেরিয়ে এলো ফারাও রাজা তুতেনখামেন! আর তার সঙ্গে সঙ্গে বেরোলো আরও বেশ কয়েকটি মমি। দেখে তাড়াতাড়ি করে লুকানোর জন্য আপনি আশ্রয় নিতেই পারেন কোনো গুহায়। গুহা থেকে বেরিয়েই পড়লেন তুমুল জলপ্রপাতে। সেখান থেকে তাড়াতাড়ি পাড়ি না দিতে পারলে গম্ভীর শিম্পাঞ্জি সাহেবের মুখোমুখি যে হবেন না, তার কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই! এরমধ্যে চাইলে ডলফিনের সঙ্গে একটা সৌজন্য সাক্ষাতও সেরে নিতে পারেন।
এরপর ধরুন তুমুল বৃষ্টি, ভিজতে ভিজতে প্রেয়সীর সঙ্গে ছাতা মাথায় নিয়ে অবশেষে সন্ধান পেলেন রিকশার, ক্লান্ত-বিধস্ত শরীরটাকে একটু চাঙা করতে টঙে গিয়ে মামার হাতের এক কাপ কড়া চা, একটু জিরিয়ে নিয়ে এরপর হারিয়ে গেলেন সবুজ অরণ্যে, ডুবে গেলেন পিয়ানোর সুরের মূর্ছনায়। চোখ কপালে তোলার কিছু নেই। কারণ এগুলো সবই ছবি! ত্রিমাত্রিক মোটিফগুলোর প্রাণবন্ত উপস্থিতি অবশ্য সত্যি ভেবে বসলেও ক্ষতি নেই। সেক্ষেত্রে এই গুহা, মমি কিংবা ডলফিন বা শিম্পাঞ্জি দেখে চোখ বন্ধ করে ঝেড়ে দৌড় দেবেন, না বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পিয়ানো বাজাবেন তা নিতান্তই আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা! তবে সবকিছুর স্বাদ একসঙ্গে পেতে, সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য হলেও আপনাকে যেতে হবে ত্রিমাত্রিক মোটিফ নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশের একমাত্র আর্ট মিউজিয়াম `থ্রিডি আর্ট ওয়ার্ল্ড'-এ।
রাজধানীর বিজয়সরণির বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরে অবস্থিত আর্ট ওয়ার্ল্ড। তবে ত্রিমাত্রিক ছবির ভুবনটিতে প্রবেশ করতে হলে কাটতে হবে ২০০ টাকার টিকিট। বেশ কিছুদূর হেঁটে গেলে তবেই মিলবে থ্রিডি আর্ট ওয়ার্ল্ডের প্রবেশপথ। বুধবার ছাড়া সপ্তাহে ৬ দিনই সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে থ্রিডি আর্ট ওয়ার্ল্ড।
কত্ত ছবি!
তিন ফ্লোর মিলে মোট ৭৫টার মতো ছবি রয়েছে মিউজিয়ামটিতে। প্রথমতলায় তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশি সংস্কৃতি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ত্রিমাত্রিক রূপ আবার একইসঙ্গে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর বীরত্বগাঁথা সবই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুনিপুণভাবে। আবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফ্রেমবন্দি হওয়ারও রয়েছে সুযোগ।
মিউজিয়ামটির ভেতরে প্রবেশের পর প্রথমেই চোখে পড়বে মস্ত এক চা বাগান! সেখান থেকে চায়ের পাতা তুলছেন এক চা শ্রমিক। ছবি তোলার জন্য হলেও দাঁড়িয়ে পড়তে পারেন তার পাশে, একটু চা পাতা তুলতেও পারেন সেই সঙ্গে। কৃষকের ধান ভানা কিংবা গরু চড়ানোর দৃশ্য, গ্রামবাংলার পালতোলা নৌকা, জেলের জালে ধরা পড়া জাতীয় মাছ ইলিশ সবই রয়েছে এ ফ্লোরে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দর্শন সুনিশ্চিত বটেই, চাইলে কয়েকটা ছবিও তুলে নিতে পারেন একসঙ্গে।
বেসমেন্টে প্রথমতলার চিত্র
এতো গেল কেবল গ্রাউন্ড ফ্লোরের কথা। চোখ ধাঁধানো বেসমেন্টের প্রথমতলায় ছবির রাজ্যে মোগলির সঙ্গে দেখা হওয়া কিংবা মিনা কার্টুনের সেই জাদুর পাটিতে করে ঘুরে বেড়ানোর আর ছবি তোলার সুযোগ যেমন রয়েছে। তেমনি ঘুরতে ঘুরতে মাঝেমধ্যে বোতলবন্দি হয়ে আটকে পড়ার ভয়ও রয়েছে। একইভাবে ভূতের সঙ্গে সাক্ষাত, কী বুনোহাতির তাড়া সবকিছুরই সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
এত তাড়া খেয়ে একটু তো বিশ্রাম প্রয়োজন, এজন্য `শাহি' ব্যবস্থা রেখেছে আর্টওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষ, সেসব থ্রিডিময় মুহূর্তের ছবি ফ্রেমবন্দি করে রাখতে পারেন। বাদশাহদের যেমন বিরাট বিরাট পাখা নিয়ে বাতাস করা হতো, দেখে মনে হবে যেন ছবির ফ্রেম থেকে বের হয়ে ঠিক তেমনিভাবেই বাতাস দিতে প্রস্তুত তারা! সঙ্গে মরুভূমির উটের সঙ্গে বসে একটু অরেঞ্জ জুস খেয়ে, সেই মুহূর্তও বন্দি করে রাখতে পারেন ছবি তুলে রাখার মধ্য দিয়ে। এছাড়া গুহা, পিয়ানোর সঙ্গে ছবি তোলা, বৃষ্টির মধ্যে রিকশার জন্য ছাতা মাথায় দিয়ে অপেক্ষার ছবি, জলপ্রপাত বা ডলফিনের ছবি সবই এই ফ্লোরে রয়েছে।
কী আছে বেসমেন্টের দ্বিতীয়তলায়!
বেসমেন্ট এক থেকে দুইয়ে নামতে গেলে প্রথমে আপনাকে পাড়ি দিতে হবে টাইটানিক। এরপর উত্তরা-মতিঝিল ট্রেন। তবেই পৌঁছুবেন নিচতলায়। প্রতিবন্ধীদের কথা ভেবে বেসমেন্ট এক থেকে দুইয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি বিশেষ পথে এ চমক রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
এরপরই পুরো ফ্লোরজুড়ে বরফ আঁকা। যা দেখে হঠাৎ করে মনে হতেই পারে হয়তো উত্তর মেরুতে চলে এসেছেন আপনি। নিচতলায় আরও রয়েছে `ঘুমন্ত সিংহের গুহা'। সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রের 'পায়ে পড়ি বাঘ মামা' নামে বিখ্যাত সেই গানটির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? সিংহটি যতই ঘুমন্ত হোক, আর থ্রিডি ঢঙে আঁকা হোক, কৃত্রিম সেই গুহার ভেতর থ্রিডি ইফেক্টে আঁকা সিংহকে দেখলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যে 'পায়ে পড়ি সিংহ মামা' ধরনের অনুভূতি কাজ করবে, তা তো বলাই বাহুল্য।
আর্টওয়ার্ল্ডের থ্রিডি চক্করে যখন ঘুরফির খাচ্ছি বারবার, সেরকম একসময় চোখ পড়ল, ৮ বছর বয়সী শিশু সুজানের দিকে। মোগলী কি ডলফিন বা গেরিলার ছবি থেকে শুরু করে অন্যান্য সব ছবির সঙ্গে ত্রিমাত্রিক মোটিফের পরাবাস্তব দুনিয়ায় যে নিজেকে গুলিয়ে ফেলছিল, তা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল তার বিভিন্ন অঙ্গ-ভঙ্গিমায় ছবি তোলার মধ্য দিয়েই। পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে আসা সেই শিশুটির উচ্ছ্বাস আর মনমতো ছবি না হওয়ায় মায়ের সঙ্গে তার খুনসুটিই যেন বলে দিচ্ছিল থ্রিডি রাজ্য ঠিক কতটা উপভোগ্য হয়ে উঠেছে তার জন্য।
প্রত্যেকটি ফ্লোরের পেইন্টিংই ছবিতে একদম জীবন্ত হয়ে উঠছে বলে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জানালেন নোভা ফাতেমী নামে এক দর্শনার্থী। বাংলাদেশেও যে এরকম থ্রিডি গ্যালারি হতে পারে, আর্টওয়ার্ল্ডে না এলে বিশ্বাসই হতো না বলে জানালেন রাজধানীর লালমাটিয়া থেকে বেড়াতে যাওয়া নোভা।
ছবিগুলো আঁকতে সময় লাগল কেমন!
বেসমেন্ট আর গ্রাউন্ডফ্লোর মিলে তৈরি এ আর্ট ওয়ার্ল্ডটির ছবিগুলোর প্রত্যেকটিই যে একই মাপের তা নয়। তবে দৈর্ঘ্যের দিক থেকে মোটামুটি সবই সমান। ৭ থেকে ৮ ফুট দৈর্ঘ্যের ছবিগুলো প্রস্থের দিক থেকে ৯/১০ ফিট বা তারও কিছুটা বেশি। বিভিন্ন থিম ও মোটিফের ওপর আঁকা ছবিগুলোর প্রতিটি পরতেই রয়েছে বাস্তবচিত্রের অনন্য উপস্থাপন।
বলুন তো এসব ছবিগুলো আঁকতে কেমন সময় লাগতে পারে! পুরো তিনতলার ৮৫ শতাংশ ছবি আঁকতে সময় লেগেছে প্রায় ১৮ দিনের মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চারুকলা অনুষদের প্রায় ২৫ জন শিক্ষার্থীর হাতের হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পায় থ্রিডি মিউজিয়ামটি।
ঘুরে দেখানোর দায়িত্বও আর্টওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষের!
প্রিয়জনের সঙ্গে বিশেষ মুহূর্ত কাটাতে চাইলে তো আর্টওয়ার্ল্ডের কোনো জুড়ি নেই। ঘুরে, গল্প করে, ছবি তুলে দিব্যি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেওয়ার মতোই এক জায়গা।
তবে একা গেলেও উপভোগের সুযোগ কিন্তু কোনো অংশে কম নয়। কেননা কাউকে একা দেখলে নিজ দায়িত্বে পুরোটা ঘুরে দেখানোর দায়িত্ব আর্টওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষের। এ কাজের জন্য মোট ৪ জন রয়েছে। শুধু ঘুরে দেখানোই নয়, প্রত্যেকটি ছবির সঙ্গে ছবি তুলে দেওয়ার কাজটিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে করে থাকেন তারা। সাফিন নামে এক কর্মীর কথায় জানা গেল এর সত্যতা।
রয়েছে ছবি তোলার ব্যবস্থাও!
এমনকি ছবি তুলে দিতে প্রস্তুত রয়েছে একদল। ঘুরতে ঘুরতেই দেখা মিলবে তাদের। দেড়শ' টাকা দিলেই দুটি ছবি প্রিন্ট করে ফ্রেমও করে দেবে তারা। একদম নিচতলায় রয়েছে তাদের ফটো স্টুডিও। ফলে ছবি তোলার পর হাতে পেতে দেরি হওয়ারও সুযোগ নেই। সামরিক জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে বলে জানালেন স্টুডিওটির ফটোগ্রাফার তুষার খান। তাদের দলে মোট ৪ জন ফটোগ্রাফারের একটি দল রয়েছে বলেও তিনি জানান।
নেপথ্যের গল্প
থার্ড ডাইমেনশন বা থ্রিডি আর্ট বিশ্বে নতুন নয়। প্রতিবেশি ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই রয়েছে এ ধরনের মিউজিয়াম। তবে বাংলাদেশে এ ধরনের কাজ একদমই নতুন।
বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরে থ্রিডি আর্ট ওয়ার্ল্ড তৈরি করতে পারার বিষয়টি খুবই সৌভাগ্যের বলে মনে করেন এর নেপথ্য কারিগর, বিজ্ঞাপনী সংস্থা থার্ড আই সল্যুউশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাসের মহসীন। জানালেন অভিনব এ আইডিয়াটির পেছনের গল্প। প্রায় ৭-৮ বছর আগে থেকেই এরকম একটি আর্ট ওয়ার্ল্ড তৈরির পরিকল্পনা ছিল তার। শিশুদের প্রতি আগ্রহের জায়গা ছিল বরাবরই। ক্যারিয়ারের শুরুতে হ্যারি পটারের হগওয়ার্টসের আদলে একটি সেট তৈরি করেন, যেখানে খোদ হ্যারি পটার, ডাম্বলডোরসহ অনেকগুলো চরিত্র নিয়ে কাজ করেন তিনি। সেখানে মিশ্রণ ঘটান মিনা কার্টুনসহ দেশীয় বেশ কয়েকটি কার্টুন চরিত্রকেও। সেখান থেকেই থ্রিডি আর্টের ওপর কিছু করা যায় কিনা এমন ভাবনা মাথায় আসে তার।
তবে নতুন কোনোকিছুকে প্রতিষ্ঠিত করা তো খুব একটা সহজ নয়, ফলে সেসময় তার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। সেইসময় থেকে বার্জার পেইন্টসের সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনার বেশ কয়েকটি বিল্ডিংয়ে ত্রিমাত্রিক একটি রূপ দেওয়ার কাজ করে তার প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে ২০২২ সালেই সামরিক জাদুঘরের এ ধরনের কাজ করার সুযোগ পায় তার প্রতিষ্ঠান। প্রথমে এক সপ্তাহ, এরপর ৪ ও ৬ মাস, পালাক্রমে ১ বছর পর্যন্ত আর্টওয়ার্ল্ডটিতে ছবি প্রদর্শনীর অনুমতি পান তিনি।
১ সেপ্টেম্বর থেকে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পরে ১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। তবে সামরিক জাদুঘরের সঙ্গে হওয়ায় প্রথম থেকেই দর্শকদের মন জয় করে নেয় আর্ট ওয়ার্ল্ড। এরইমধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষ ঘুরে গেছেন বলে দাবি থ্রিডি আর্ট ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের। যদিও প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। ছুটির দিনগুলোয় জাদুঘরটির সামনে টিকিটপ্রত্যাশীদের দীর্ঘ লাইনই বলে দেয় যে তাদের দাবিটি একেবারেই ভুল নয়!