পার্বত্য চট্টগ্রামে দরিদ্র, অসহায় বিচারপ্রার্থীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস
রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার উগলছড়ি গ্রামের বাছনি খাতুনের ৩৬ শতক জায়গা বেদখল করার চেষ্টা হয়েছিলো ভুয়া দলিলে। দুই বছর ধরে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করেন তিনি।
তবে বাছনি খাতুন আদালতে না গিয়েই জেলা লিগ্যাল এইড, রাঙ্গামাটি কার্যালয়ের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান পেয়েছেন।
জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, রাঙ্গামাটি হলো একটি সরকারি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা যা জাতীয় আইনি সহায়তা প্রদান সংস্থার আওতায় দরিদ্রদের আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে।
সংস্থাটি মামলার আগে-পরে দুই সময়েই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে আর্থিক অসচ্ছলতা, নিঃস্বতা, অসহায়ত্ব এবং বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে বিচার চাইতে অক্ষম বিচারপ্রার্থীদের জন্য বিনামূল্যে আইনি সেবা দেয়।
তিন পার্বত্য জেলায় পারিবারিক আদালত না থাকায় সম্পত্তি, বিশেষ করে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে প্রশংসনীয় সাফল্য দেখিয়েছে এই সংস্থা।
রাঙ্গামাটির রাঙাপানি মৌজার ৭৩ বছর বয়সি বিধবা ছালমা বেগম। পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে নিজেদের মতো সংসার করলেও এই বৃদ্ধার খোঁজ নেয় না তার তিন ছেলে-মেয়ের কেউই।
নিরুপায় হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন ছালমা। পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইনে মামলা করেন তিন ছেলের বিরুদ্ধে। গত বছরের ২৩ অক্টোবর রাঙামাটির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে মামলাটি রেকর্ডভুক্ত হয়। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন।
লিগ্যাল এইড অফিস প্যানেল আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে ছালমা বেগমের অধিকারের জন্য লড়ছে।
এ কার্যালয়ের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি জেলার এরকম অন্তত ৩০০ বিচারপ্রার্থী মামলা না করে আপসের মাধ্যমে বিচার পেয়েছেন।
এতে আদালতে মামলার সংখ্যা কমছে। পাশাপাশি দ্রুত সুবিচার পাচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা।
এ কার্যালয়ের সাফল্য
জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাঙ্গামাটি লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে ১ হাজার ২০৫টি আবেদন জমা পড়ে।
এর মধ্যে ১ হাজার ৯৫টি আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। বিরোধ আপসের ফলে ১ কোটি ২২ লাখ টাকা আদায় হয়েছে।
এছাড়া ৪২০টি দেওয়ানি, ফৌজদারি ও পারিবারিক মামলা মীমাংসা হয়েছে।
আইনি পরামর্শ পেয়েছেন ১ হাজার ১৭৫ জন। আদালতে বিচারাধীন ১০১টি মামলা আপসে মীমাংসার ফলে প্রত্যাহার হয়েছে।
সার্বিক মামলা মীমাংসার হার ৩৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বিরোধপূর্ণ জমিতে গিয়ে মীমাংসা বৈঠক
রাঙ্গামাটি লিগ্যাল এইড অফিসের অন্যতম উদ্যোগ হলো বিরোধপূর্ণ জমিতে গিয়ে মীমাংসা বৈঠক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ অঞ্চল হওয়ায় এ কার্যক্রমের আওতায় ১৪৫টির অধিক বিরোধপূর্ণ জমিতে গিয়ে মীমাংসা বৈঠক করা হয়েছে। এটি দেশে রাঙ্গামাটিতেই প্রথম শুরু হয়েছে।
রাঙ্গামাটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ মো. জুনাইদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সাম্প্রতিক কোনো জরিপ না থাকায় রাঙ্গামাটিতে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি একটি জটিল কাজ।
'এক্ষেত্রে আমরা সরাসরি বিবাদমান স্থানে গিয়ে উভয়পক্ষের সম্মতিতে সমাধান করি,' বলেন তিনি।
মো. জুনাইদ আরও বলেন, 'আমরা সাধারণত তিনটি ধাপে কাজ করে থাকি। প্রথমত, মানুষকে বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা প্রদান; দ্বিতীয়ত, আপসে বিরোধ নিষ্পত্তি; তৃতীয়ত, জমি বিরোধ, পারিবারিক বিরোধ ও ভরণপোষণ সংক্রান্ত ফৌজদারি মামলা মীমাংসা।'
তবে তারা যাতায়াতের জন্য যানবাহনের সুবিধা পান না জানিয়ে মো. জুনাইদ বলেন, 'আমাদের যাতায়াতের জন্য কোনো যানবাহন নেই এবং পর্যাপ্ত জনবলের সংকট রয়েছে। সার্ভেয়ারসহ যদি জনবল সংকট ও পরিবহন সংকট নিরসন হয়, সেক্ষেত্রে আমরা বিচারপ্রার্থীদের জন্য আরও বেশি পরিমাণে কাজ করতে পারব।'
লিগ্যাল এইডের প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালিমা ওয়াহিদা জেনী বলেন, লিগ্যাল এইড কার্যালয় রাঙ্গামাটির দরিদ্র ও অসহায় বিচারপ্রার্থীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, 'সার্ভিসের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ পারিবারিক বিরোধ, জমিজমার বিরোধ নিষ্পত্তিসহ নানান সুফলভোগী হচ্ছেন। আমরা লিগ্যাল এইডের প্যানেল আইনজীবী হিসাবে এই সেবা দিয়ে যাচ্ছি।'
বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি
খাগড়াছড়িতে লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে এক বছরে ১৩০টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সাফল্যের হার প্রায় ৯০ শতাংশ।
খাগড়াছড়ির লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ রাজীব দে বলেন, 'আদালত বা কারাগার থেকে আমাদের কাছে বিশেষ মামলা পাঠানো হলে আমরা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করি।'
বান্দরবান লিগ্যাল এইড অফিস এক বছরে প্রায় ৩০০ মামলা সামলেছে বলে জানান জেলা কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুবর্ণ তঞ্চঙ্গ্যা।