ইউক্রেনের সামনে এরপর কী?
গত জুনে ইউক্রেন যখন পাল্টা-আক্রমণ অভিযান শুরু করে, তখন দেশটির কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন, গত বছরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে খুব দ্রুতই বিপুল পরিমাণ ভূখণ্ড রাশিয়ার দখলমুক্ত করা যাবে। অথচ তার পরিবর্তে প্রথমদিকে কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি ইউক্রেনীয় বাহিনী। গত দুই-তিন সপ্তাহে তার চেয়ে সামান্য কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে, কতিপয় গ্রাম দখলে নিতে পেরেছে তারা।
হয়তো এমন ফলাফলই প্রত্যাশা করা উচিত ছিল পশ্চিমা মিত্রদের। কারণ, যুদ্ধ সাধারণত শক্তিক্ষয়ের লড়াই হয়। সেই সংজ্ঞায়, গত বছর ইউক্রেন যেভাবে ঝটিকা আক্রমণ অভিযানে হাজার হাজার মাইল ভূমি পুনরুদ্ধার করেছিল– তেমন উদাহরণ-ই বিরল। ইউক্রেনের মতো বড় যুদ্ধে একে একে শত্রুর অঙ্গহানি করাটাই দস্তুর। যেমনটা গতকাল পূর্বাঞ্চলের ছোট অথচ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রাম দখলের মাধ্যমে ইউক্রেন করেছে। এ ধরনের অগ্রগতি– শত্রুর প্রতিরোধ ব্যূহকে ব্যাপকভাবে ভেদ করারই প্রস্তুতি। যদিও সে সাফল্য এবার তারা নাও পেতে পারে।
প্রথম মহাযুদ্ধের পরিখার লড়াই বা এমনকী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এ সংজ্ঞা কাজ করেছে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ বা কোরীয় যুদ্ধের সময়েও দেখা গেছে– বিজয়ের জন্য ছোট ছোট পদক্ষেপগুলোই গুরুত্বপূর্ণ।
যেমনটা বলেছেন ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের বিশ্লেষক জর্জ ব্যারোস। তার মতে, 'যুদ্ধ মানেই সবসময় চোখ-ধাঁধানো বিজয় নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেসব একঘেয়ে বিষয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি থাকে না– সেগুলোই বিজয় অর্জনের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে।'
অন্যভাবে বলা যায়, কাউন্টার-অফেন্সিভের ওপর খুবই উচ্চ প্রত্যাশা হয়তো করেছিল ইউক্রেন ও তার মিত্ররা। অথচ ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। ইউক্রেন যদি রাশিয়াকে তার ভূখণ্ড থেকে লক্ষণীয়ভাবে পিছু হঠাতে চায়– তাহলে শুধু কয়েক মাস নয়, বরং কয়েক বছর লাগবে। আর সেটাই স্বাভাবিক।
এই প্রেক্ষাপটে, সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সীমিত অগ্রগতি এবং এরপরে তাদের সামনে কী অপেক্ষা করছে তা ব্যাখ্যা করেছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
তবে মার্কিন পত্রিকাটি সে ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, রুশ প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করার মাধ্যমে পূর্ব ও দক্ষিণে ইউক্রেনে মোতায়েন রুশ বাহিনীকে বিভাজিত করতে চায় ইউক্রেনের নেতৃত্ব। কিন্তু, সময় খুবই কম, নভেম্বরেই শুরু হবে বৃষ্টি ও কাদার মৌসুম। তখন সেনা ও ভারী যুদ্ধাস্ত্র পরিবহনে গতি থাকবে না। আক্রমণ অভিযানের এই গতিহীনতার সুযোগ কাজে লাগাবে প্রতিপক্ষ।
মারাত্মক প্রতিরোধ
প্রথমদিকে কোনোপ্রকার অগ্রগতি করতে পারছিল না ইউক্রেনের আক্রমণ অভিযান। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর মূল পরিকল্পনা ছিল– পদাতিক সেনাদের সাথে পশ্চিমা মিত্রদের দেওয়া ট্যাংক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে দক্ষিণপূর্বাঞ্চলে রুশ বাহিনীর প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে এগোনোর। লক্ষ্য ছিল, দক্ষিণের ক্রিমিয়া উপদ্বীপে অবস্থানকারী রুশ বাহিনীর সাথে পূর্বের ডনবাস অঞ্চলের রুশ বাহিনীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা।
লড়াই অব্যাহত থাকার সময়, পূর্ব বা দক্ষিণাঞ্চল – যখন যেখানে ইউক্রেনীয় বাহিনী আক্রমণের চাপ বাড়াচ্ছে, সেখানে বাড়তি সেনা বা রসদ পাঠাচ্ছে রাশিয়া। যেমন পূর্বে লড়াই তুমুল হলে দক্ষিণ থেকে বাড়তি সেনা, সরঞ্জাম পাঠাতে পারে। ইউক্রেন যদি মেলিটোপোল পর্যন্ত দখলে নিয়ে রুশ বাহিনীর দুই অংশকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে, তাহলে এই সুবিধা পাবে না মস্কো। ইউক্রেনীয় করিডর তখন মস্কোর 'গলার কাঁটা' হয়ে উঠবে।
কাগজে-কলমে পরিকল্পনাটি ভালোই শোনায়; কিন্তু বাস্তবায়নের সময় প্রচণ্ড রুশ প্রতিরক্ষার মুখে পড়ে ইউক্রেনীয়রা।
কিয়েভ যখন পশ্চিমা মিত্রদের থেকে কাউন্টার-অফেন্সিভের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ পেতে অপেক্ষা করছিল, ঠিক তখনই মস্কো পূর্ব থেকে দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত বহুদূর বিস্তৃত, শক্তিশালী কয়েক স্তর-বিশিষ্ট প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তোলে। এতটা শক্তিশালী প্রতিরোধ আশা করেনি ইউক্রেন। কাউন্টার-অফেন্সিভের শুরুতে হাজার হাজার ইউক্রেনীয় সেনা প্রাণ দিয়ে সেই ভুল ধারণার মাশুল দিয়েছে। রাশিয়ার বেছানো মাইনে ধবংস হয়েছে ইউক্রেনের অনেক ট্যাংক, সাঁজোয়া যান।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলদ্ধি করে ইউক্রেনীয়রা তাদের সাঁজোয়া যান সম্মুখভাগ থেকে সরিয়ে নেয়। মাইন ধবংস বা অকেজো করে করে এগুনোর সিদ্ধান্ত নেয়। একইসঙ্গে, রুশ সেনা অবস্থান দুর্বল করতে কামান থেকে গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। ইউক্রেনের পদাতিক বাহিনীকে এই কৌশলে খুবই ধীরে ধীরে এগোতে হচ্ছে।
গত মাসে শেষপর্যন্ত ইউক্রেনীয়রা কিছুটা তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি লাভ করে। এসময় তারা দক্ষিণপূর্বে রাশিয়ার প্রথম প্রতিরোধ সারি ভেদ করে, এবং এগোনোর সময় কয়েকটি ছোট মফস্বল ও গ্রাম দখল করে। বর্তমানে তারা দুদিক দিয়ে এগুনোর চেষ্টা করছে। একটি পথ দখলকৃত গ্রাম রবোতিনের মধ্যে দিয়ে গেছে, অন্যটি ধরে এগুলে পৌঁছানো যাবে রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত উপকূলীয় শহর বার্দিয়ানস্কে। ইউক্রেনীয়রা যে পথই বেছে নিক না কেন, যদি তারা আরও এগোতে পারে– তাহলে রুশ বাহিনীকে বিভাজিত করার মূল লক্ষ্য অর্জিত হবে।
তবে খুব ধীরে এই এগোনোর ঘটনা– শক্তিক্ষয়ের এ যুদ্ধের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কারণ, মাইনক্ষেত্র এড়িয়ে বা ধবংস করে এগোনো এবং একইসঙ্গে গোলাবর্ষণের মাধ্যমে রুশ অবস্থানগুলো দুর্বল করতে- সময় লাগারই কথা। তবে সার্বিকভাবে দেখে মনে হয়েছে, তেমন কিছুই যেন বদলায়নি, কারণ উভয়পক্ষের অবস্থান আগের জায়গাতেই আছে। কিন্তু, বাস্তবতা হলো- ইউক্রেনীয় সেনারা চরম বাজি ধরেছে, তারা এগিয়েও যাচ্ছে। রাশিয়ার প্রতিরোধ দুর্বল হলেই তারা দুর্বার আঘাত হানতে পারবে।
এবিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের ওয়েলস্লে কলেজের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ স্টেসি গডার্ড এর মন্তব্য , 'আক্রমণ পরিচালনা কোনো সরল বিষয় নয়।'