প্রতিরক্ষামূলক কৌশল নিচ্ছে ইউক্রেন, ব্যর্থ ‘পাল্টা-আক্রমণ’ শেষ বলছেন বিশ্লেষকরা
রাশিয়ার সামরিক সম্পদ জড়ো করার সক্ষমতা ও শীতকালীন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আবারও কৌশল পাল্টাচ্ছে ইউক্রেন। সোমবার কিয়েভের পক্ষ থেকে আরও রক্ষণাত্মক কৌশল গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা-আক্রমণে ব্যর্থ হওয়ার পরেই কিয়েভ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সোমবার (৪ ডিসেম্বর) ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়ক উল্লেখ করেন, 'যুদ্ধের সম্মুখভাগে ও শহরগুলোয় এরমধ্যেই আমরা ভিন্নতর যুদ্ধকৌশলের দিকে যাচ্ছি। এর আওতায় নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় থাকবে কার্যকর প্রতিরক্ষা, অন্যদিকে কিছু এলাকায় আক্রমণ অভিযান চলতে থাকবে। একইসঙ্গে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ও কৃষ্ণসাগরের জলরাশির বুকেও আমাদের বিশেষ কৌশলগত অভিযানগুলো অব্যাহত থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো রক্ষায় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থারও উল্লেখযোগ্য সংস্কার করা হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, স্থানীয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদনে আরও সম্পদ নিয়োজিত করা হবে এবং ইউক্রেনের 'নতুন পর্যায়ের' আক্রমণ অভিযানগুলো পরিচালনার জন্য মিত্রদের সাথে রণসরঞ্জাম সরবরাহ বাড়ানোর আলোচনাকে বেগবান করা হবে।
পোডোলিয়াক এমন সময় এসব কথা জানালেন, যখন গত সপ্তাহেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি বলেছেন, পুরো শীতকালটাই যুদ্ধের এক নতুন অধ্যায়। তীব্র শীতের কারণে (আক্রমণ অভিযানের) লড়াই চালিয়ে যাওয়া অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে, এবং এই সময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলো রক্ষা করাই আরও বড় অগ্রাধিকার। জেলেনস্কি ইঙ্গিত দেন যে, সম্মুখভাগের সকল অংশে রক্ষণাত্মক কাঠামো গড়ে তোলার কাজও দ্রুত করা দরকার।
গত জুনে রাশিয়ার দখলকৃত এলাকাগুলো মুক্ত করতে পাল্টা-আক্রমণ (কাউন্টার অফেন্সিভ) অভিযান শুরু করে ইউক্রেন। এতে প্রত্যাশিত সফলতা লাভে ব্যর্থ হয়েই ইউক্রেন কৌশল বদলাচ্ছে কিনা– সে প্রশ্নই এখন তুলছেন কিছু বিশ্লেষক।
ইউরেশিয়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ইয়ান ব্রেমার বলেন, 'ইউক্রেনীয়রা প্রতিরোধ কাঠামো নির্মাণের দিকে ঝুঁকছে, এর মধ্যে দিয়ে নিজদের ব্যর্থ কাউন্টার-অফেন্সিভের ইতি টানছে তারা।'
যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক– ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ)- এর বিশ্লেষকরা বলছেন, 'প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সম্মুখভাগের পুরোটা জুড়ে ইউক্রেনীয় ও রুশ সেনাদের লড়াই কার্যক্রম মন্থর হয়ে পড়েছে, তবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি।'
কিছুদিন আগেই ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর প্রধান ভ্যালেরি জালুঝনি এক পর্যালোচনায় জানিয়েছিলেন, 'যুদ্ধ একটি অচলাবস্থায় পৌঁছেছে'। কিয়েভের মেয়র ভিটালি ক্লিশস্কো সুইজারজারল্যান্ডের একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, এই পর্যবেক্ষণের সাথে তিনি একমত পোষণ করেন।
গত মাসে দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনকে জালুঝনি বলেন, 'যুদ্ধ একটি অচলাবস্থায় পৌঁছেছে' এবং শত্রু বাহিনীর 'গভীরে কাঙ্ক্ষিত ব্রেক থ্রু' অর্জন আরও বেশি অধরা হয়ে উঠছে।
শত্রু বাহিনীর সম্মুখসারির প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে এগিয়ে যাওয়াকেই সামরিক পরিভাষায় 'ব্রেক থ্রু' বলা হয়। ইউক্রেন সে চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু, তাতে সফল হয়নি। তবে এই মন্তব্য করায় সামরিক বাহিনীর প্রধান জালুঝনির সাথে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। জেলেনস্কি যুদ্ধের এই পর্যালোচনার বিরোধিতা করে পাল্টা বক্তব্যও দিয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটে সুইস গণমাধ্যমকে টুয়েন্টি মিনুটেন নামক সুইস গণমাধ্যমকে কিয়েভের মেয়র ভিটালি ক্লিশস্কো বলেন, জালুঝনি 'সত্যিটাই বলেছেন।'
তিনি বলেন, 'কেউ কেউ হয়তো সত্যটা শুনতে চান না, কিন্তু আমাদের নিজ জনগণকে এবং মিত্রদের অনবরত মিথ্যা বলতে পারি না।'
এসময় জেলেনস্কির সমালোচনাও করেন ক্লিশস্কো। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে, 'কারণ মানুষ দেখতে পারছে, কে বেশি কার্যকর আর কে নয়। তাঁর কাছে আগেও অনেক প্রত্যাশা ছিল মানুষের, এখনও অনেক রয়েছে। জেলেনস্কি নিজের ভুলগুলোরই মাশুল দিচ্ছেন।'
জেলেনস্কির ভুলগুলো কী এমন প্রশ্নের জবাবে ক্লিশস্কো বলেন, প্রথমত এই যুদ্ধের জন্য ইউক্রেন প্রস্তত ছিল না। 'মানুষ ভেবে অবাক হয় কেন আমরা এই যুদ্ধের জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। কেন (যুদ্ধ শুরুর) আগমুহূর্ত পর্যন্ত জেলেনস্কি এর সম্ভাবনাকে নাকচ করে গেছেন। অথবা কীভাবেই বা এত দ্রুত কিয়েভের উপকণ্ঠে পৌঁছতে পেরেছিল রুশ সেনারা।'
তবে সমালোচনা করলেও ক্লিশস্কো স্বীকার করেন, 'প্রেসিডেন্টের একটি গুরুদায়িত্ব (বিজয় অর্জনের) আছে, আর যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের তাঁকে সমর্থন করতে হবে। তবে যুদ্ধ শেষে প্রত্যেক রাজনীতিবিদকে তাঁর সাফল্য বা ব্যর্থতার মূল্য দিতে হবে।'