দাম পাচ্ছে না ‘লিচু রাজ্যের’ কৃষক
নানামুখী উদ্যোগের অভাবে কাঙ্খিত দাম পাচ্ছেন না লিচুর রাজ্য খ্যাত দিনাজপুরের কৃষক, বাগানী ও ব্যবসায়ীরা। কৃষকরা বলছেন- গত কয়েক বছর ধরেই অব্যাহতভাবে দাম কমেছে লিচুর। সঠিক দাম পেতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তারা।
কৃষিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে, লিচুর মূল্য পেতে বিদেশে লিচু রপ্তানি, প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি ও সংরক্ষণাগার তৈরি করা প্রয়োজন। আর কৃষি বিভাগ বলছে- লিচু সম্পর্কিত খাদ্যপণ্যের ইন্ডাস্ট্রি, সংরক্ষণাগার এবং প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করার জন্য অধিদপ্তরে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি লিচু বিদেশে রপ্তানিরও চিন্তা-ভাবনা চলছে।
দেখতে টসটসে লাল ও খেতে রসালো, সুমিষ্ট ও স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হওয়ায় দেশব্যাপী খ্যাতি বেড়েছে দিনাজপুরের লিচুর। এ জেলায় বোম্বাই, বেদেনা, চায়না থ্রি, কাঁঠালি, হাড়িয়াসহ বিভিন্ন প্রকারের লিচু ওঠে।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার উৎপাদিত ৮০ শতাংশ লিচুই ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। এ জেলায় প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে লিচুবাগান রয়েছে। যেখানে প্রতিবছর ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন লিচু উৎপাদন হয়।
বিরলের মাধববাটী এলাকার কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, গত কয়েক বছর লিচু উঠেছে রমজান মাসে। তাই ওই তিন বছরে লিচুর চাহিদা কমে যাওয়ায় দাম পাওয়া যায়নি। আর এবার করোনার কারণে ক্রেতা কম ও বিভিন্নস্থানে পর্যাপ্ত লিচু না যাওয়ায় এবারও ভাল দাম পাওয়া যায়নি।
''লিচু সংরক্ষণ ও বাজারজাতের ব্যাপারে সরকারিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে আগামী বছরগুলোতেও ভাল দাম পাওয়া যাবে না'' বললেন সিরাজুল।
সদর উপজেলার বোলতৈড় এলাকার কৃষক সেলিম রেজা বলেন, লিচু এমন একটি ফল যা খুব বেশিদিন রাখা যায় না। লিচু পাকার ৩/৪ দিনের মধ্যেই বাজারজাত করতে হয়, না হলে লিচু নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু যদি লিচু সংরক্ষণ করে রাখা যেতো, তাহলে মৌসুম ছাড়াও অন্যান্য সময়ে লিচু বাজারজাত করা যেতো। তখন দাম মিলতো অনেক বেশি।
দিনাজপুর হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ প্রদীপ কুমার গুহ বলেন, লিচু নিয়ে আমরা যারা কৃষি বিভাগে আছি তারাও চিন্তা-ভাবনা করছি। ইতোমধ্যেই দিনাজপুরে যে অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে সেখানে লিচু সংরক্ষণাগার স্থাপনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, সেই সংরক্ষণাগার হলে লিচুর মৌসুমে তা সংরক্ষণ করে পরে বাজারজাত করা সম্ভব হবে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন দেশে যেভাবে ফল প্রসেসিং করা হয় সেভাবে লিচুরও সময় এসেছে। প্রসেসিং করে রাখা হলেও অন্যান্য সময়গুলোতে লিচু পাওয়া যাবে।
''এতে করে পুষ্টির চাহিদা পুরণের পাশাপাশি ভালো দামও পাওয়া যাবে। এজন্য শুধু সরকারিভাবেই নয়, বেসরকারিভাবেও উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে'' যোগ করেন তিনি।
দাম বৃদ্ধিতে লিচু ভারতে রপ্তানিরও সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন আমদানি-রপ্তানিকারকেরা। লিচু রপ্তানির জন্য দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সেক্টরে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। লিচু রপ্তানিরজন্য সরকারিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন-অর রশিদ বলেন, ভারতে স্বল্প পরিমাণে লিচুর উৎপাদন হয়, তাই সেখানে লিচুর বেশ চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া দিনাজপুরের লিচুর যেমন গুনাগুন আছে তাতে করে লিচু রপ্তানির অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। আর এখন দিনাজপুরের পাশাপাশি অন্যান্য জেলাগুলোতেও কমবেশি লিচুর উৎপাদন হচ্ছে।
''লিচু যাতে রপ্তানিদাম পাচ্ছে না 'লিচু রাজ্যের' কৃষক, সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহনের দাবি করা যায় সেজন্য ইতোমধ্যেই আমরা ভারতীয় হাইকমিশনসহ বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে লিচু নিতে এখনও তারা আগ্রহী হয়নি। অথচ আমরা ভারতীয় বিভিন্ন পণ্য দেশে নিয়ে আসছি'' বলেন তিনি।
হারুন-অর রশিদ আরও বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যাতে এগিয়ে আসে সে জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এতে সরকারি রাজস্ব বাড়বে এবং লিচু চাষী ও বাগানীরাও ভাল দাম পাবে।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ তৌহিদুল ইকবাল বলেন, লিচুর চাষিরা এবার কাঙ্খিত দাম পাচ্ছেন না। অধিদপ্তরে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে লিচু সম্পর্কিত খাদ্যপণ্যের ছোট ছোট ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করা, সংরক্ষণাগার এবং প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি করার।
তিনি বলেন, লিচু ভারতে রপ্তানির ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে এবারে আম যাবে। লিচুর সংরক্ষণ ক্ষমতা অনেক কম। তাই কিভাবে লিচু বিদেশে রপ্তানি করা যায় সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা চলছে। লিচুর ব্যাপারেও আমরা আশাবাদী। আগামীতে আমরা লিচুর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিব।
কৃষিবিদ তৌহিদুল ইকবাল বলেন, কুলিং ভ্যান দিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা গেলে লিচুর দাম বৃদ্ধি পাবে। বেসরকারিভাবে ব্যবসায়ীরা যদি লিচু সম্পর্কিত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে এগিয়ে আসে তাহলে কৃষক, বাগানী, ব্যবসায়ী ও সরকার সকলেই লাভবান হবেন। বিশেষ করে লিচুর প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি করা খুবই প্রয়োজন বলে জানান তিনি।