দেশজুড়ে বইছে তাপপ্রবাহ, মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন উদ্যোগ
রাজধানীর রাস্তায় পানি ছিটানোর গ্রীষ্মের নারকীয় উত্তাপ তাৎক্ষণিক স্বস্তি পান সালেহ হোসেনের। ঢাকার আগারগাঁওয়ে ট্রাক থেকে ওয়াটার স্প্রে ক্যানন মেশিনের মাধ্যমে পানি ছিটানোর সময় ওই এলাকার শিশু ও ৬০ বছর বয়সি সালেহও সেই পানিতে ভেজেন।
চলমান তাপপ্রবাহে ঢাকার তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি পৌঁছে গেছে। এ তাপপ্রবাহ থেকে নগরবাসীকে কিছুটা স্বস্তি দিতে চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিনের পরামর্শে রাজধানীর নির্দিষ্ট কিছু সড়কে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)।
চিফ হিট অফিসারের পরামর্শে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় 'কৃত্রিম বৃষ্টি' তৈরি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
শনিবার (২৭ এপ্রিল) আগারগাঁওয়ে পানি ছিটানো কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, 'চিফ হিট অফিসারের বিভিন্ন সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা সিটি কর্পোরেশনের স্প্রে কামান গাড়ি ব্যবহার করে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরি করব।'
মেয়র আরও বলেন, 'আমাদের দুটো স্প্রে মেশিন আছে। এগুলো রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে এবং সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরি করবে। প্রতিটি গাড়ি প্রতিদিন প্রায় ৪ লাখ লিটার পানি স্প্রে করতে পারে।'
'কৃত্রিম বৃষ্টি' হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এটি আসলে নগর এলাকাকে শীতল করার জন্য বড় ফগ গান ট্রাক থেকে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে স্বস্তি দিতে এভাবে পানি ছিটানো হয়। দুই বছর আগে রেকর্ড তাপমাত্রা হওয়ার পর চীনের হাংজু, উহান ও চংকিং শহরে এরকম ফগ গান ট্রাক ও মিস্ট ক্যানন ব্যবহার করা হয়েছিল।
গত বছর ইউরোপ যখন তীব্র তাপপ্রবাহে ভুগছিল, তখন অনেক শহর প্রচণ্ড গরমে মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার জন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল। স্পেনে শহরের কিছু ব্যস্ত শপিং এলাকায় ক্রেতা ও পথচারীদের প্রচণ্ড রোদ থেকে বাঁচাতে নগর কর্তৃপক্ষ ভবনের ওপরে কাপড়ের ছাউনি ঝোলায়।
দেশব্যাপী বয়ে যাওয়া চলমান তাপপ্রবাহের সময়ে নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থাসহ বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও।
নগরবাসীকে সুপেয় খাবার পানি সরবরাহ, হাত-মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা, ছাতার ব্যবস্থাসহ রাস্তায় পানি ছিটানো ও 'কৃত্রিম বৃষ্টি'র উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান।
শনিবার দুপুরে আগারগাঁও এলাকায় বায়ুদূষণ রোধ ও তীব্র তাপদাহে শহরকে ঠান্ডা রাখতে ঢাকা উত্তর সিটির দুটি ওয়াটার স্প্রে ক্যানন মেশিনের মাধ্যমে পানি ছিটানোর সময় ওই এলাকার শিশুসহ কয়েকজন বৃদ্ধও সেই পানিতে ভিজছিলেন। এসব মেশিন যেমন তীব্র তাপদাহের সময় নগরের তাপমাত্রা কমাতে সহায়তা করে, তেমনি বায়ুদূষণ হ্রাসেও ভূমিকা রাখে। বৃষ্টির পানির ফোঁটার সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে ভেসে থাকা দূষিত কণাগুলো মাটিতে পড়ে যায়।
ষাটোর্ধ সালেহ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পানি ছিটানো দেখে শিশুদের সাথে আমিও ভিজলাম। গরম থেকে যেটুকু মুক্তি পেয়েছি, এতেও অনেক শান্তি লাগছে।'
এদিকে ঢাকা ওয়াসা গত ২১ এপ্রিল থেকে ঢাকার ১০টি জোনে ২০০টিরও বেশি পয়েন্টে খাবার পানি সরবরাহ করছে।
ঢাকা ওয়াসার মুখপাত্র এ এম মোস্তফা তারেক টিবিএসকে বলেন, 'আমরা প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কারওয়ানবাজার, শাহবাগ, পল্টনসহ ২০০টিরও বেশি পয়েন্টে সুপেয় খাবার পানি সরবরাহ করে যাচ্ছি। যতদিন তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে, ততদিন বিনামূল্যে খাবার পানি এভাবে সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।'
কারওয়ান বাজারে ঢাকা ওয়াসার স্থাপন করা খাবার পানির বুথ থেকে পানি সংগ্রহ করছিলেন রিকশাচালক ইয়াসিন। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'কারওয়ান বাজারের এখানে কোনো ট্রিপ নিয়ে এলেই এখান থেকে পানি পান করি। বারবার তো পানি কিনে খাওয়া যায় না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে এমন পানির ট্যাংক থাকায় গরম থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছি।'
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনও পানি ছিটানোর কার্যক্রম বাড়িয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, 'ঢাকা দক্ষিণ থেকে ১২টি গাড়ির মাধ্যমে পানি ছিটানো হয় বিভিন্ন রাস্তায়। আগে ৯টি গাড়ি ছিল, এখন আরও ৩টি বাড়ানো হয়েছে। চলমান আপপ্রবাহের সময়ে আগের থেকে অনেক বেশি রাস্তায় পানি ছিটানো হয়।'
চলমান তাপপ্রবাহের এই সময়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ ট্রাফিক পুলিশদের পর্যাপ্ত সুপেয় খাবার পানি, শরবত, স্যালাইন ও ছায়ার জন্য ছাতা সরবরাহ করে যাচ্ছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক বিভাগ) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, 'ডিএমপির আটটি ট্রাফিক বিভাগে বিশুদ্ধ খাবার পানি, খাবার স্যালাইন ও ছায়ার জন্য ছাতা দেওয়া হচ্ছে।'
তাপপ্রবাহ থেকে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার প্রচেষ্টায় শামিল হয়েছে বেসরকারি সংস্থাগুলোও। হামদর্দ থেকে রাজধানীর কয়েকটি স্পটে রুহ্ আফজার শরবত বিনামূল্যে পথচারীদের মধ্যে বিতরণ করতে দেখা যায়। অন্যদিকে সুপারশপ চেইন স্বপ্নও পথচারীদের বিনামূল্যে পানীয় সরবরাহ করছে।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন জানিয়েছে, উত্তরের আওতাধীন এলাকার রিকশাচালকদের মাঝে ৩৩ হাজার ছাতা বিতরণ করবে তারা।
ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, শহরের বিভিন্ন রাস্তায় 'কৃত্রিম বৃষ্টি' তৈরি করা হবে। এক সপ্তাহের মধ্যে পার্ক ও খেলার মাঠেও কৃত্রিম বৃষ্টির ব্যবস্থা করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র।
তিনি বলেন, 'যেসব রাস্তায় বড় গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে না, সেই অলিগলির রাস্তায় পানি ছিটানোর গাড়িগুলো পানি ছিটাবে। এমন গাড়ি আছে ১০টি। এতদিন নির্দিষ্ট কিছু এলাকাতে স্বল্প পরিসরে এ কার্যক্রম চললেও এখন এই হিটওয়েভের সময়ে নিয়মিত চলবে।'
মেয়র আতিকুল আরও জানান, ঢাকা উত্তরের বিভিন্ন এলাকায় ২০০টি ভ্যান খাবার পানি বিতরণ করবে। প্রতি ওয়ার্ডে তিনটি ভ্যান থাকবে। এই ভ্যানগুলো পার্ক ও খেলার মাঠের কাছে পানি সরবরাহ করবে। উদ্যোগটি শনিবার থেকে শুরু হয়েছে।
নগরীর বাসিন্দাদের প্রতি তাদের বাড়ির আশেপাশের গাছের যত্ন নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন মেয়র।
তিনি বলেন, 'আমি ঢাকা উত্তরের দোকানদার, ব্যবসায়ী ও মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দদের অনুরোধ করছি, আপনারা প্রতিটি দোকান, শপিং মল, মার্কেটের সামনে পানি খাওয়ার জন্য একটি ড্রামের ব্যবস্থা রাখবেন। সবাই যেন পানি খেতে পারে।'
ঢাকা উত্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ) সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব ডিপ টিউবয়েলের পাম্পের মাধমে তোলা পানি এসব গাড়িতে করে বিভিন্ন স্থানে ছিটানো হয়। মহাখালী, গাবতলীতে সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্কশপ ও আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে তাদের পাম্প স্থাপন করা রয়েছে। এ পানি সরাসরি পানযোগ্য পানি।'
এছাড়া খাবার পানি ওয়াসা থেকে সংগ্রহ করে সরবরাহ করা হয় বলে জানায় ঢাকা উত্তর।
তাপদাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করার আহ্বান
এদিকে 'ইমপ্যাক্ট অভ ক্লাইমেট চেঞ্জ অন অক্যুপেশনাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি অ্যান্ড বায়োকেমিক্যাল হ্যাজার্ড ইন ওয়ার্কপ্লেস' শীর্ষক সভায় আলোচকরা তাপপ্রবাহকে সরকারিভাবে দুর্যোগ ঘোষণা করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ অক্যুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ সভায় জানানো হয়েছে, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ঢাকায় প্রতি বছর ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার সমমূল্যের উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তাপদাহের এ ধারা অব্যহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শুধু পোশাক খাতেই ৬০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হবে এবং প্রায় আড়াই লাখ পোশাক কর্মী কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন বলে উল্লেখ করেন বক্তারা।
এছাড়া তাপপ্রবাহের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতিমালায় তাপদাহ নিঃসরণ-সংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা, শুষ্ক এলাকার জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাংলাদেশ শ্রম আইনে তাপদাহকে পেশাগত স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান বক্তারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যায়লের অধ্যাপক শেখ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, তীব্র তাপদাহের কারণে এপ্রিল ও মে মাসে শ্রমিকরা তাদের মোট কর্মঘণ্টার ২৫ ভাগ হারাতে পারেন এবং এর ফলে প্রাক্কলিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা।
এছাড়াও, তারা সম্প্রতি তাপপ্রবাহে প্রাণ হারিয়েছেন এমন শ্রমিকদের পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা, জলবায়ু
তাপপ্রবাহ চলছেই, সীমিত বৃষ্টি হতে পারে
শনিবার আবারও চুয়াডাঙ্গায় বছরের সর্বোচ্চ ৪২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। টানা দ্বিতীয় দিনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হলো চুয়াডাঙ্গায়।
অন্যান্য জেলায়ও তাপপ্রবাহ চলছে। রাজশাহী ও পাবনায় গতকাল তাপমাত্রা ৪১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সন্ধ্যার বুলেটিন অনুযায়ী, গতকাল সারাদেশে সিলেটে সর্বোচ্চ ৮৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, আর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে মাত্র ৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে কোনো বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়নি।
আবহাওয়া অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ বিচ্ছিন্ন বৃষ্টি বা বজ্রঝড়ের সম্ভাবনার পূর্বাভাস দিয়েছে। কিছু এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে শিলাবৃষ্টিও হতে পারে। দেশের অন্যত্র মাঝে মাঝে আংশিক মেঘলা আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, 'বৃষ্টি বা বজ্রঝড় বাড়তে পারে। ২ মের পরে সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা কমতে পারে। তার আগে দেশব্যাপী বৃষ্টিপাতের বড় কোনো সম্ভাবনা নেই।'