১৯২১ সালের যক্ষ্মার টিকা কী কোভিড-১৯ থেকে প্রাণরক্ষা করতে পারবে?
ফুসফুসের এক প্রাণঘাতী রোগ যক্ষ্মা। রোগটি বিস্তার লাভ করে ব্যাসিলাস কেলমেটে গুয়েরিন নামক এক জীবাণুর মাধ্যমে। এক শতাব্দী আগে ১৯২১ সালেই এ জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ বা টিকা আবিষ্কার করা হয়। বিসিজি জ্যাব নামক সেই টিকা কোভিড অতিমারিতে জীবন বাঁচাতে পারবে কিনা- তা নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা।
বিসিজি টিকা যক্ষ্মার জন্য হলেও এটি যে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুরক্ষা দিতে পারে, ইতোমধ্যেই তার কিছু দিক প্রমাণিত হয়েছে।
এজন্য বিসিজি টিকার সক্ষমতা পরীক্ষা করছে যুক্তরাজ্যের এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় এক হাজার স্বেচ্ছাসেবক সেখানে অংশ নিচ্ছেন।
যুক্তরাজ্য-সহ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ যক্ষ্মার টিকা শৈশবেই পেয়েছেন। কিন্তু, বিজ্ঞানীদের ধারণা কোভিডের বিরুদ্ধে সুফল পেতে এটি আবারও নিতে হবে।
কোনো নির্দিষ্ট একটি জীবাণু সংক্রমণের বিরুদ্ধে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করার লক্ষ্য মাথায় রেখেই তার টিকা তৈরি করা হয়। এরফলে ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে শরীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।
আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অবশ্য এর ফলে বেশকিছু পরিবর্তন ঘটে। এতে অন্য রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বিরুদ্ধেও তা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
সেই সূত্রেই বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, দুটোই ফুসফুসে সংক্রমণকারী জীবাণু হওয়ায়, যক্ষ্মার টিকা বিসিজি-জ্যাব দিয়ে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে মানব শরীরকে বাড়তি সুরক্ষা কবচ দেওয়া সম্ভব।
বিজ্ঞানীরা চলমান অতিমারির অনেক আগেকার তথ্যের ভিত্তিতেই এমন ধারণা করছেন। নিচে এমন কিছু ঘটনা আলোচনা করা হলো;
- গিনি-বাসাউ'তে পরিচালিত এক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা যায়, বিসিজি দেওয়ার পর নিউমোনিয়া এবং সেপসিসে নবজাত শিশু মৃত্যুর হার ৩৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
- দক্ষিণ আফ্রিকায় করা আরেক গবেষণায় বিসিজি জ্যাব নাক, গলা এবং ফুসফুসে সংক্রমণ ৭৩ শতাংশ কমিয়ে আনতে সফল হয়।
- নেদারল্যান্ডে করা আরেক পরীক্ষায়, এটি প্রয়োগ করার পর শরীরে পীতজ্বর সৃষ্টিকারী ভাইরাসের মাত্রা হ্রাস পায়।
এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধ গবেষণা অনুষদের অধ্যাপক জন ক্যাম্পবেল বিবিসি'কে বলেন, 'বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এসব গুণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।'
''যদিও আমরা শুধুমাত্র কোভিডের জন্যই এটি দ্বিতীয়বার দেওয়ার কথা চিন্তা করছি না। তবে পরীক্ষা সফল হলে চলমান মহামারি মোকাবিলায় এটি গুরুত্বপূর্ণ এক অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। তখন সম্পূর্ণ নিরাপদ কোভিড টিকা তৈরিতে বা ভিন্ন চিকিৎসা উদ্ভাবনে কয়েক বছর সময় পাওয়া যাবে।''
যুক্তরাজ্যের ট্রায়ালটি আন্তর্জাতিক গবেষণা উদ্যোগ ব্রেস- স্টাডির অংশ। এর আওতায় অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, স্পেন এবং ব্রাজিলে ১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের কাজ চলছে।
প্রাথমিকভাবে, নিয়মিত করোনা সংক্রমিত রোগীর সংস্পর্শে আসা স্বাস্থ্য কর্মীদের স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে গ্রহণ করা হচ্ছে। বিসিজি জ্যাব করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর হয় কিনা- এরফলে বিজ্ঞানীরা তা আরও দ্রুত জানার সুযোগ পাচ্ছেন।
এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক শ্যাম হিলটন নিজেও এ পরীক্ষায় নাম লিখিয়েছেন। কারণ, চিকিৎসক হিসেবে তার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও অনেক বেশি।
তিনি বিবিসি'কে বলেন, ''দুইবার বিসিজি নেওয়া থাকলে কোভিড-১৯ আপনাকে সহজে কাবু করতে পারবে না, এমন তত্ত্বের বেশ জোরালো ভিত্তি আছে। একারণেই এরমধ্য দিয়ে আমি আরেকটু বেশি নিরাপদ থাকার সুযোগ পাব, বলে ধারণা করছি। আর নিরাপদ থেকে আমি শীতকালেও অন্যকে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ পাব।''
ইতোপূর্বে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব ড. তেদ্রোস আঢানম ঘেব্রেইসুস চিকিৎসা বিজ্ঞানের শীর্ষ সাময়িকী ল্যানসেটে লেখা এক নিবন্ধে জানান, 'কোভিড প্রতিরোধে রোগ নির্দিষ্ট টিকা তৈরির আগে সে শূন্যস্থানটি আপাতত বিসিজি ভ্যাকসিন পূরণ করার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।'
নিবন্ধটি অনুসারে, কোভিড বা আগামীতে ফুসফুস আক্রান্তকারী জীবাণুর মহামারি মোকাবিলায় যক্ষ্মার এ টিকা একটি ফলপ্রসূ উপকরণ হয়ে উঠতে পারে।
তবে বিসিজি স্থায়ী সমাধান হবে না। কারণ, দ্বিতীয়বার নেওয়ার ফলে এর উদ্দীপ্ত প্রভাব কিছুদিন থাকবে, এবং ধীরে ধীরে আবারও শরীরে করোনা বিরোধী প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়বে। ঠিক একারণেই, ছোটবেলায় যক্ষ্মার টিকা পাওয়ারা এখন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হচ্ছেন।
তাছাড়া, যক্ষ্মার টিকা কোভিডের বিরুদ্ধে আমাদের রোধ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অ্যান্টিবডি তৈরি করবে না এবং রক্তের শ্বেত কণিকাকে তা করোনাভাইরাস শনাক্ত করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রশিক্ষণও দেবে না।
তবে এতে সফল ও সম্পূর্ণ নিরাপদ টিকা আসার আগে মানবজাতি কিছুটা বাড়তি সময় পাবে।
- সূত্র: বিবিসি