একজন ‘নূরলদীন’-এর সারা জীবন
বিদ্রোহী নূরুলদীন, শুনলেই মনে ভেসে ওঠে এক দৃপ্ত মুখ, মনে পড়ে যায় সরল অথচ কঠোর কণ্ঠের কথা। তিনি আলী যাকের। প্রায় ৪০ বছর ধরে বেতার, মঞ্চ, টেলিভিশন, বিজ্ঞাপনজগত মাতিয়ে আজ শুক্রবার সকালে না ফেরার দেশে চলে গেছেন আমাদের নূরলদীন। দীর্ঘদিন থেকে ভুগছিলেন ক্যান্সারে, গেল সপ্তাহে ধরা পড়ল কোভিড-১৯।
স্বাধীনতা-পরবর্তী মঞ্চনাটকের অন্যতম সংগঠক ও সফল নাট্যনির্দেশক তিনি। সংস্কৃতিজগৎ ছাপিয়ে তার মেধা স্পর্শ করেছে বিজ্ঞাপনের জগতেও। একুশে পদকসহ বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন এই গুণীজন।
চলুন আমাদের এই একমেবাদ্বিতীয়ম নূরুলদীনের জীবনটা কেমন ছিল দেখে আসি।
প্রথম জীবন
১৯৪৪ সাল। দুনিয়া জুড়ে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডব। সেই বছর ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের সদর স্ট্রিটে মোহাম্মদ তাহের ও রিজিয়া তাহেরের সংসারে জন্ম নেন আলী যাকের।
পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে হলেও বাবা ছিলেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের এসডিও (তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক)। বদলির চাকরি, সেই সুবাদে এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরতে থাকে গোটা পরিবার।
আলী যাকেরের শৈশব আর কৈশোর কেটেছে খুলনা, কুষ্টিয়া ও মাদারীপুরে। প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক পড়াশোনা বিভিন্ন স্কুলে।
পরবর্তীকালে ঢাকায় ১৯৬০ সালে সেন্ট গ্রেগরিজ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন ১৯৬২ সালে। এর মাঝে হার্ট অ্যাটাকে ১৯৬১ সালে বাবা মাহমুদ তাহের মারা যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এ সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন।
১৯৬৪ সালে মা রিজিয়া তাহেরও ছেড়ে চলে গেলেন, ১৯৬৫ সালে চলে গেলেন বড় বোন। এর মাঝেই শেষ হয়েছে স্নাতকের পড়াশোনা।
চাকরি-বাকরি
১৯৬৭ সালে স্নাতক শেষ করে চাকরি খুঁজতে চলে যান করাচিতে। সেখানে দু'বছর থেকে শেষপর্যন্ত চাকরি পান এশিয়াটিক কোম্পানিতে। সেখানকার ঢাকা অফিসে যোগ দিতে ফিরে আসেন ১৯৬৯ সালে। আর সেসময় ঢাকা উত্তাল।
মুক্তিযুদ্ধের শব্দসংগ্রামী
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গেলেন প্রশিক্ষণ নিতে। কলকাতায় দেখা হলো চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাংবাদিক আলমগীর কবিরের সঙ্গে। তিনিই বললেন, 'মুক্তিযুদ্ধে ময়দানের যুদ্ধের মতোই জরুরি হলো প্রচারযুদ্ধ। বিশ্ববাসীকে বোঝাতে হবে আমরা ন্যায়যুদ্ধ করছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটা ইংরেজি সার্ভিস শুরু করছে, লেগে যাও।' সেখানেই ছিলেন যাকের। প্রচারণা চালিয়েছেন। হয়েছেন বেতারে শব্দসংগ্রামী।
মঞ্চনাটক ও অভিনয়
১৯৭২ সালে আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন আলী যাকের। এই নাটকের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে।
১৯৭২ সালের জুন মাসের দিকে আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন। ঐ দলে তিনি আতাউর রহমানের নির্দেশনায় বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নাটকে অভিনয় করেন, যার প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ওয়াপদা মিলনায়তনে ।
১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে তিনি প্রথম নির্দেশনা দেন বাদল সরকারের 'বাকি ইতিহাস' নাটকে, যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনীর যাত্রা।
এরপর একে একে বিদগ্ধ রমণী কুল, তৈল সংকট, এই নিষিদ্ধ পল্লীতে, সৎ মানুষের খোঁজে, অচলায়তন, কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, নূরলদীনের সারাজীবন নাটকে নির্দেশনা দেন।
টেলিভিশনে আলী যাকের
পরবর্তীতে টিভি নাটকের জগতেও জনপ্রিয়তার কাতারে এসেছেন গুণী এই অভিনেতা। হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত একাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। 'আজ রবিবার', 'বহুব্রিহী' তে তার অভিনয় দর্শকনন্দিত হয়েছিল সেসময়।
আলী যাকের ২০১০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাভিশনের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনুষ্ঠান ভালোবাসার বাংলাদেশ উপস্থাপনা করেন।
অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রেও। আগামী (১৯৮৬), নদীর নাম মধুমতী (১৯৯৬), লালসালু (২০০১), রাবেয়া (২০০৮) চলচ্চিত্রে।
পরিবার
স্ত্রী স্বনামধন্য অভিনয়শিল্পী সারা যাকের। ১৯৭৩ সালে সারা যোগ দেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে। কিন্তু তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কিছু করে ওঠেননি। একজন অভিনয়শিল্পী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে চরিত্রটি তুলে নিয়ে অভিনয় করেন সারা। আলী যাকেরই তাকে তৈরি করে নেন। এরপর সারা যাকের হয়ে ওঠেন মঞ্চের তুখোড় অভিনয়শিল্পী। আলী যাকের ও সারা যাকের বিয়ে করেন ১৯৭৭ সালে।
এই পরিবারে দুই সন্তান। পুত্র ইরেশ যাকের অভিনয় করে সাফল্য পেয়েছেন। কন্যা শ্রিয়া সর্বজয়াও অভিনয় করছেন। পুরোপুরি নাট্য পরিবার এটি।
পুরস্কার
শিল্পকলায় অবদানের জন্য দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক একুশে পদক পেয়েছেন ১৯৯৯ সালে। এরপর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক ও নরেন বিশ্বাস পদক অর্জন করেছেন এই গুণিজন।
- তথ্যসূত্র: আলী যাকেরের সারা জীবন, জাহীদ রেজা নূর
উইকিপিডিয়া