চট্টগ্রামে করোনা রোগীর হিসাবে অব্যবস্থাপনা, খোঁজ নেই সাড়ে ১২ হাজার ‘পজেটিভ’ রোগীর
চট্টগ্রামে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ১২ হাজার ৫৮৫ জন রোগীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পক্ষ থেকে এই বিশাল সংখ্যক রোগী চিকিৎসাধীন আছে দাবি করা হলেও তারা কোথায় চিকিৎসা নিচ্ছেন সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তারা কি বর্তমানে করোনা পজেটিভ নাকি নেগেটিভ তাও জানেন না তারা।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ২০২০ সালের ৩ এপ্রিল প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত এক বছরে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০ হাজার ৪৭৮ জন। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ৫৪০ জন। সুস্থ হয়েছেন ৩৬ হাজার ৭২৪ জন। এ অবস্থায় বাকি ১২ হাজার ৫৮৫ জন রোগী কি অবস্থায় আছেন সে তথ্য স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে জানা যায়নি।
যদিও ৪ মে ২০২১ সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা তথ্যে জানানো হয়েছে, বর্তমানে চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি ২৭টি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৬০৯ জন। হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ২০ জন করোনা রোগী। আইসোলেশনে কেউ নেই। তাহলে কেন চট্টগ্রামে সাড়ে ১২ হাজার রোগীকে পজেটিভ দেখানো হচ্ছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'একজন রোগী সুস্থ হতে প্রায় ৩ সপ্তাহ সময় লেগে যায়, এ কারণে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা বেশি দেখাচ্ছে।'
তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, একসময় বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে মোবাইলে তদারকি করা হলেও বর্তমানে তা নেই। তাই পজেটিভ রোগীর বিষয়ে জানা গেলেও সুস্থ হওয়া বা করোনায় মৃতদের সঠিক হিসেব স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে নেই।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাজিদ আনোয়ারের বাবা সামাদ আনোয়ার একমাস আগে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরে তিনিসহ পরিবারের বাকি পাঁচজনের সবাই করোনায় আক্রান্ত হন। বর্তমানে তার মা ফাতেমা বেগম গুরুতর অসুস্থ হয়ে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সাজিদ নিজে চিকিৎসা নিচ্ছেন বাড়িতে।
সাজিদ বলেন, 'করোনা পরীক্ষার তিনদিন পর পজেটিভ হওয়ার একটি মেসেজই এসেছে। এরপর বাবা মারা গেছেন, মা হাসপাতালে আর আমি বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকিরা সুস্থ হয়েছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ বা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে অবস্থা জানতে কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এ অবস্থায় তাদের প্রকাশিত মৃত্যু আর সুস্থতার পরিসংখ্যান নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগছে।'
এ বিষয়ে আরও জানতে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত তথ্য বিবরণী তৈরীর সঙ্গে সম্পৃক্ত তিন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিনিধি। তারা হলেন- চট্টগ্রামের জেলা স্বাস্থ্য তত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া, পরিসংখ্যান কর্মকর্তা গীতা ও সিনিয়র স্টাফ নার্স লতা। কিন্তু তাদের সবাই প্রসঙ্গটি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী বলেন, 'এখানে উভয় পক্ষের দায় আছে। অনেক সময় রোগীরা করোনা চিকিৎসার জন্য সঠিক মোবাইল নম্বরটি দেন না অথবা ফোন বন্ধ রাখেন। আবার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণেও মাঠ থেকে সঠিক তথ্যটি উঠে আসছে না। এ কারণে করোনা পরিস্থিতির সঠিক চিত্র আমাদের সামনে আসছেনা।'
৬৪ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়েছেন বাড়িতে
চট্টগ্রামে এক বছরে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে বাড়িতে থেকে সুস্থ হয়েছেন ৩১ হাজার ৫৬০ জন। যা মোট রোগীর প্রায় ৬৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। রোগীরা বলছেন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার মধ্যে ঝামেলা-ঝুঁকি দুটোই রয়েছে, তাই বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন রোগীরা।
শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, 'বর্তমানে চট্টগ্রামে করোনা রোগীদের সুস্থতার হার ৭৩ শতাংশ। চলতি মাসের শেষে তা ৮০ শতাংশ অতিক্রম করবে বলে আশা করছি। আক্রান্ত রোগীদের অধিকাংশই বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিয়েই সুস্থ হচ্ছেন। মৃদু লক্ষণযুক্ত রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই।'
পরিস্থিতি বদলেছে চলতি মাসে
করোনার সংক্রমণ শুরুর পর গত এপ্রিলে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি অতিক্রম করে চট্টগ্রাম। মাস জুড়ে চট্টগ্রামে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পায়। ২৫ এপ্রিল একদিনে রেকর্ড ১১ জনের মৃত্যু হয়। শহরের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় আইসিইউর হাহাকার ছিল গণমাধ্যমের প্রধান সংবাদ। শহরের মোট ১১০টি আইসিইউ শয্যার সবগুলোতেই রোগী ভর্তি ছিল।
তবে মাস না পেরোতেই চিত্র পাল্টেছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোর ৫৭ শতাংশ শয্যাই খালি পড়ে আছে।
মাস ভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এপ্রিল মাসের ৩০ দিনে ৫৪ হাজার ৭৯৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনা শনাক্ত হয় ৯ হাজার ৬৬২ জনের শরীরে। বাসায় হোম কোয়ারেন্টাইনে থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬ হাজার ৩৯২ জন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এক মাসে রেকর্ড ১৩২ জন। কিন্তু মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই সেই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটেছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রামে সরকারি ও বেসরকারি ২৮টি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। এসব হাসপাতালে করোনায় চিকিৎসায় সাধারণ শয্যা রয়েছে ১ হাজার ৬০০টি, যার মধ্যে ৯৯১টি শয্যাই বর্তমানে রোগী শূন্য। এছাড়া ১১০টি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন মাত্র ৭৭ জন।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির টিবিএসকে বলেন, 'চট্টগ্রামে করোনা পরিস্থিতি গত মাসে চেয়ে তুলনামূলক ভালো। মে মাসে রোগীতে ভরপুর ছিল প্রতিটি হাসপাতাল। তবে চলতি মাসে এসে হাসপাতালে রোগী ভর্তি কম হচ্ছে। রোগের তীব্রতা না বাড়লে এখন আর কেউ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন না। বাসাতেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠছেন।' তবে যাদের ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ ও হৃদরোগসহ জটিল সমস্যা রয়েছে তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের এই কর্মকর্তা।